ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ আষাঢ় ১৪৩২, ২৬ জুন ২০২৫, ০০ মহররম ১৪৪৭

মুক্তমত

মাহাথির বোঝেন ইউনূস বোঝেন না

মন্‌জুরুল ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯:৪৮, জুন ২৬, ২০২৫
মাহাথির বোঝেন ইউনূস বোঝেন না মন্‌জুরুল ইসলাম

মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী, আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার, রাজনৈতিক দার্শনিক, চিকিৎসক ডা. মাহাথির মোহাম্মদের শত বছর পূর্ণ হবে ১০ জুলাই। ১৯২৫ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।

তিনি বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। আমাদের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে তিনি পছন্দ করেন। দুজনের  বন্ধুত্বও অকৃত্রিম। সে কারণে একজন আরেকজনের খোঁজখবর রাখেন। ২৯ মে জাপানে দুজনের সাক্ষাৎও হয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি এবং বন্ধু ইউনূস সম্পর্কে সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আইটিভিতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অনেক কথাই তিনি বলেছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি  বলেছেন বিপ্লবের ঐক্য নিয়ে। সেই সঙ্গে বন্ধু ইউনূস যে সমস্যায় আছেন, তা-ও বলেছেন। ছাত্র-জনতার ইস্পাতকঠিন ঐক্যের মধ্য দিয়ে ড. ইউনূস দেশের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে যত দিন যাচ্ছে ততই সে ঐক্য  আলগা হয়ে যাচ্ছে। কোটারিস্বার্থে নষ্ট হচ্ছে ঐক্যের অংশীজনের সম্প্রীতি। শক্ত একটি স্বার্থান্বেষী দেয়াল ড. ইউনূসকে বন্দি করে ফেলেছে। সুদূর মালয়েশিয়ায় বসে মাহাথির বন্ধুর সমস্যা সম্পর্কে বুঝতে পারছেন অথচ বন্ধু ইউনূস নিজ দেশে বসে নিজের সমস্যা বুঝতে পারছেন না।

মাহাথির মোহাম্মদ আইটিভিতে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বন্ধু ইউনূসকে একজন বড় মাপের মানুষ বলে উল্লেখ করেছেন। দারিদ্র্যমোচনে মুহাম্মদ ইউনূসের কাজের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেছেন, ড. ইউনূস দরিদ্রদের জন্য যে উদ্যোগ নিয়েছেন, সেজন্য নোবেল পুরস্কার তাঁর প্রাপ্য ছিল। তিনি ক্ষমতার লোভ করেননি, কেবল দরিদ্র মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন। এমন প্রশংসা করলেও বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও গণতান্ত্রিক উত্তরণ বিষয়ে খুব বেশি আশাবাদী হতে পারেননি ডা. মাহাথির। বাংলাদেশের গণতন্ত্রে উত্তরণের পথ নিয়ে কিছুটা সংশয় প্রকাশ করেছেন তিনি। জুলাই বিপ্লবের ঐক্য ও বর্তমান বাস্তবতা সম্পর্কে তিনি বলেছেন, শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামাতে যে ঐক্য দেখা গিয়েছিল, অভ্যুত্থানের প্রায় এক বছরের মাথায় সে ঐক্য বাংলাদেশে দেখছেন না। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ শেখ হাসিনাকে সরাতে ঐক্যবদ্ধ ছিল। কিন্তু এখন কী ধরনের সরকার তারা চায়, সে বিষয়ে ঐক্য নেই। প্রত্যেকে চায় তার নিজের মতামতই দেশের সবাই মেনে নিক। আর তাতেই সমস্যা তৈরি হচ্ছে। এখন সেই লোকজনের মধ্যেই দ্বন্দ্ব দেখা দিচ্ছে, যারা কদিন আগেই ঐক্যবদ্ধ ছিল। ’ জাপানে ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের জবাবে ডা. মাহাথির  বলেন, ‘জাপানে আমি তাঁর (ইউনূস) কথা শুনেছি। আমি জানি তিনি সমস্যায় আছেন। কিন্তু বাংলাদেশ কীভাবে চলবে, তা বলার মতো যোগ্যতা আমি মনে করি আমার নেই। ’

মালয়েশিয়ার সাক্ষাৎকারে দেওয়া বক্তব্যের চুম্বক অংশ এখানে উদ্ধৃত করা হলো। বিপ্লবের ঐক্য বিনষ্ট এবং সার্বিক বিষয়ে ড. ইউনূস যে সমস্যায় আছেন তা প্রবীণ এই রাজনৈতিক দার্শনিক নিজ  প্রজ্ঞা দিয়ে উপলব্ধি করতে পেরেছেন। তিনি যা উপলব্ধি করেছেন, বর্তমান বাংলাদেশের বাস্তবতার সঙ্গে তার শতভাগ মিল আছে। এর সঙ্গে যদি কেউ দ্বিমত পোষণ করেন, তা হবে তর্কের খাতিরে তর্ক বা দ্বিমত। মাত্র ১০ মাস সময়ের মধ্যে আমাদের সরকার সম্পর্কে এমন নির্মোহ ও নিরেট সত্যকথনের জন্য দেশবাসী প্রস্তুত ছিল না। এর জন্য সরকার নিজেই দায়ী। ওপরে ওপরে নিরপেক্ষ, ভিতরে ভিতরে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের কারণে সরকার নিজেকে নিজে বিব্রত ও প্রশ্নবিদ্ধ করছে। সরকারপ্রধান ড. ইউনূসের চারপাশে যে নানান মেরুর, নানান মতলবের তোতা পাখির দেয়াল তৈরি হয়েছে, এ দেয়ালই তাঁকে বিভ্রান্ত করছে বলে অনেকেই মনে করছেন। বন্ধু ডা. মাহাথির মোহাম্মদের উপলব্ধি যদি ড. মুহাম্মদ ইউনূস অনুধাবন করতে পারেন, তাহলে দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে।

একটা দেশ একজন মানুষের সততা, দক্ষতা ও দূরদর্শিতায় কীভাবে উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে পারে তার জীবন্ত কিংবদন্তি হলেন ডা. মাহাথির মোহাম্মদ। ১৯৪৭ সালে তিনি সিঙ্গাপুরের কিং এডওয়ার্ড মেডিসিন কলেজে ভর্তি হন। লেখাপড়া শেষ করে ১৯৫৩ সালে সিঙ্গাপুর থেকে মালয়েশিয়া ফিরে আসেন। ফিরে এসে মাহাথির একজন চিকিৎসক হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। মালয়েশিয়ার স্বাধীনতার ঠিক আগে তিনি সরকারি চাকরি ছেড়ে নিজ শহর এ্যালোর সেটরে মাহা-ক্লিনিক নামে একটি প্রাইভেট ক্লিনিক শুরু করেন। শহরের পাঁচটি প্রাইভেট ক্লিনিকের মধ্যে এটি একমাত্র মালয় বংশোদ্ভূত ব্যক্তির মালিকানাধীন ক্লিনিক ছিল। তিনি রোগীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে চিকিৎসা করতেন।  ১৯৭৪ সালে মন্ত্রী হওয়ার আগ পর্যন্ত একজন নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসক হিসেবে তিনি চিকিৎসা পেশা অব্যাহত রেখেছিলেন। শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালন শুরু করেন। এরপর উপপ্রধানমন্ত্রী এবং ১৯৮১ সালের ১৬ জুলাই তিনি মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হন। তার পরই শুরু হয় মালয়েশিয়ার উন্নয়নযাত্রা। একসময় মালয়েশিয়ার মানুষ আমাদের অঞ্চলে ব্যবসা ও চাকরির জন্য আসত। আর এখন মাহাথিরের মালয়েশিয়ায় আমাদের জনশক্তি রপ্তানি করার জন্য ওই দেশের সরকারের পেছনে ঘুরতে হয়। মালয়েশিয়া শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়নই করেনি, উন্নয়ন করেছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইনের শাসন, মানবাধিকারসহ সব ক্ষেত্রে। পৃথিবীবিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাস এখন মালয়েশিয়ায়। আমাদের শুধু জনশক্তি নয়, বহু শিক্ষার্থী মালয়েশিয়ার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের লেখাপড়া করছেন। বর্তমান মালয়েশিয়ার পথপ্রদর্শক আর কেউ নন, তিনি একমাত্র ডা. মাহাথির মোহাম্মদ।

আমাদের ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষেও ‘নতুন বাংলাদেশ’-এর নির্মাতা হওয়ার সুযোগ ছিল। কত আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতীক হিসেবে বিপ্লবীরা এবং দেশবাসী তাঁকে গ্রহণ করেছিলেন, তা ভাবা যায় না। রাষ্ট্রের দায়িত্ব গ্রহণের পর অর্থাৎ ৮ আগস্টের পর তিনি যদি বাঘ ও হরিণকে এক ঘাটে পানি পান করার নির্দেশ দিতেন, তাহলে সম্ভবত তা-ই হতো। এর মাত্র ১০ মাস পর তিনি যখন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক করেন, তখন তাঁর উপস্থিতিতেই একজন আরেকজনের সঙ্গে ঝগড়া করেন। যে উদ্যম ও আকাক্সক্ষা নিয়ে রাষ্ট্র মেরামতের জন্য সংস্কার কমিশনগুলো গঠন করা হয়েছিল, তা এখন রাষ্ট্রের ওপর রীতিমতো বোঝায় পরিণত হয়েছে। আগামী মাসে ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা হবে বলে দেশবাসীকে জানানো হয়েছে। অথচ এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় আনতে পারেনি সরকার। লন্ডন বৈঠকে নির্বাচনি ধোঁয়াশা কেটে যাওয়ার মতো পরিবেশ তৈরি হলেও শতভাগ বিশ্বাসের পরিবেশ তৈরি হয়নি। এখনো প্রত্যাশিত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা হয়নি। কবে হবে তা-ও  অনুমান করা যাচ্ছে না। দেশের আইনশৃঙ্খলার অবস্থা এখনো নাজুক। কেউ কারও কথা শুনছে না। মব ফ্যাসিজম সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, দখল সবই চলছে যথারীতি। যেন উদ্ভ্রান্ত পথিকের মতো চলছে সবাই। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। নতুন কিছুর স্বপ্ন নিয়ে বিপ্লব করার পর আস্তে আস্তে সবাই হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছে। ধান্দাবাজ, চান্দাবাজ ও ক্ষমতালিপ্সুরা সব সময় ভালো থাকে, এখনো মনে হয় ভালোই আছে।

বিশ্ব এখন টালমাটাল। এর শেষ কোথায় কারও জানা নেই। বিশ্বরাজনীতি কোন দিকে মোড় নিচ্ছে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর পৃথিবীর ওপর একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ইরান- ইসরায়েল যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ভূমিকা আছে। ইসরায়েলের পক্ষ নিয়ে আবার যুদ্ধবিরতির মধ্যস্থতাও যুক্তরাষ্ট্রই করল। যুদ্ধ আপাতত বিরতি হলেও বন্ধ হয়নি। হয়তো আবার যে কোনো মুহূর্তে আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। পৃথিবীতে যুদ্ধ না হলে আমেরিকা ভালো থাকে না। অস্ত্রের ব্যবসা, ডলারের ব্যবসা, ক্ষমতার প্রভাব নিয়ে গোটা পৃথিবী এখন একচেটিয়া শাসন করছে যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের অশান্তির কারণে বাংলাদেশের মতো বিভিন্ন ছোট দেশকে নানামুখী চাপ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। জনশক্তি, জ্বালানিসহ অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের ওপর ঝুঁকি বাড়ছে। তার ওপর দেশের মধ্যে নেই রাজনৈতিক শান্তি। যুদ্ধবিরতির শর্ত ভেঙে আবার যদি  ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত-পাল্টা আঘাত শুরু হয় তাহলে আমাদের রাজনীতিতে নতুন কোনো ছুতা  দেখা দেয় কি না ভাবার বিষয়।

বাংলাদেশের ব্যাপারে ডা. মাহাথির মোহাম্মদের মূল্যায়ন বিবেচনায় নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান যদি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে দৃঢ়প্রত্যয়ী থাকেন, তাহলে ১৮ কোটি মানুষের কল্যাণ হবে। স্মরণীয় হয়ে থাকবেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। একটি শতভাগ নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্পন্ন করে আগামী দিনের নেতার কাছে যদি ক্ষমতা হস্তান্তর করেন, তাহলে উন্মুক্ত হবে নতুন বাংলাদেশ গড়ার পথ। আর যদি তা না হয়,  নতুন কোনো ছলছুতায় যদি কোনো পক্ষের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ড. ইউনূস নিজেকে বিকিয়ে দেন, তাহলে ব্যক্তি ইউনূসের সমস্যা বাড়াবে। আবার কখনো কোনো বিশ্বসভায় যদি দেখা হয়, তখন হয়তো ড. ইউনূসের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে ডা. মাহাথির মোহাম্মদ বলবেন, ‘আমি তো আগেই বলেছিলাম আপনি সমস্যায় আছেন। আপনার সমস্যা আমি বুঝতে পেরেছিলাম, আপনি কেন বুঝলেন না?’

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।