ভোটারের আচরণ একটি জটিল মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক প্রক্রিয়া। তথ্যের অভাব, শিক্ষার স্তর, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়, পার্টির প্রতি আনুগত্য নাকি প্রার্থীর ব্যক্তিত্ব— কোন বিবেচনায় একজন ভোটার তার রায় প্রদান করেন; তা নিয়ে আমাদের দেশে খুব একটা গবেষণা না থাকলেও আগামী নির্বাচনে প্রার্থীর যোগ্যতা তথা শিক্ষা, মেধা, সামাজিকতা, বিপদে আপদে মানুষের পাশে থাকার দৃষ্টান্ত, অভিজ্ঞতা, বার্গেনিং পাওয়ার অর্থাৎ জনপ্রতিনিধি হিসাবে নিজ এলাকার উন্নয়ন ও সমস্যা সমাধানে রাষ্ট্রের কাছ থেকে তা আদায় করে আনার ক্ষমতা যার যত বেশি; তাকেই ভোট দেওয়ার ব্যাপারে অধিক গুরুত্ব দেবেন ভোটাররা।
সাধারণত বাংলাদেশের গ্রামীণ এবং স্বল্প শিক্ষিত ভোটারদের ক্ষেত্রে পার্টির প্রতীক বা পরিচিতি প্রাথমিকভাবে ভোটের মূল নির্ধারক হিসেবে কাজ করে। অন্যদিকে, শহুরে এবং শিক্ষিত ভোটাররা প্রার্থীর চরিত্র, দক্ষতা, জনসম্পর্ক ও দৃশ্যমান উপস্থিতি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেন।
ভোটারদের মনস্তাত্ত্বিক দিক, তাদের প্রার্থী পছন্দের কারণ এবং প্রতীক দেখে ভোট দেওয়ার প্রবণতা নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীদের অসংখ্য গবেষণা পত্র ও বই রয়েছে। এটি একটি জটিল বিষয়, যেখানে মানুষের যুক্তি, আবেগ এবং সামাজিক পরিচয় একে অপরের সঙ্গে মিশে যায়।
১৯৫০-এর দশকে মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অ্যাঙ্গাস ক্যাম্পবেল, ফিলিপ কনভার্স, ওয়ারেন মিলার এবং ডোনাল্ড স্টোকস ‘দ্য আমেরিকান ভোটার’ বইটিতে একটি প্রভাবশালী মডেল ব্যাখ্যা করেন। এটিতে বলা হয়, ভোটারদের সিদ্ধান্তের পেছনে প্রধান কারণ হলো দলীয় আনুগত্য। দ্য মিশিগান মডেল অব ভোটিং বা দলীয় আনুগত্যের প্রভাব প্রসঙ্গে তারা বলেন, এটি ভোটারদের জন্য শক্তিশালী মনস্তাত্ত্বিক ছাঁকনি হিসেবে কাজ করে। পছন্দের দলীয় প্রার্থীর পক্ষে ভোট দিতে উৎসাহিত করে। এমনকি যদি প্রার্থীর ব্যক্তিগত যোগ্যতা কমও হয়।
আমাদের দেশেও নির্বাচনের সংস্কৃতি অনেকটা এমনি অর্থাৎ প্রতীক নির্ভর। ভালো হোক মন্দ হোক প্রতীকের বাইরে খুব একটা যেতে চান না ভোটাররা; কারণ কমবেশি অধিকাংশই কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থক। তারপরও প্রার্থীর ব্যক্তিত্ব ক্রমশ ভোটের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে উঠেছে।
ভোটারদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে ১৯৭৯ সালে মনোবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল কাহনেমান এবং আমোস তিভারস্কির লেখা ‘প্রস্পেক্ট থিওরি’ বইয়ে তাঁরা দেখিয়েছেন যে, মানুষ সব সিদ্ধান্ত যুক্তিসঙ্গতভাবে নেয় না। বরং মানসিক সংক্ষিপ্ত পথ বা ‘হিউরিস্টিকস’ ব্যবহার করে। নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভোটাররা প্রার্থীর যোগ্যতা বা নীতি যাচাই না করে কিছু সহজ সূত্র ব্যবহার করেন। দলীয় প্রতীক দেখে ভোট দেওয়া একটি সাধারণ হিউরিস্টিকস।
আমাদের দেশের ভোটারের মনস্তত্ত্ব বিষয়ক বিশ্লেষণের পূর্বে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে বাংলাদেশে দীর্ঘ ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে পরিকল্পিতভাবে নির্বাচনের প্রতি মানুষের অনীহা সৃষ্টি করা হয়েছে। সেই ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত একটিরও ক্ষেত্রে জনগণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি বিগত সরকার।
এই যে দীর্ঘ দশটি বছর ভোটের বাইরে থাকা এ দেশের মানুষ ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তাদের যে ভূলুণ্ঠিত নাগরিক মর্যাদা ফিরে পেতে চলেছে এবং দেশবাসীর অন্যতম এই অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার পেছনে যে লড়াই সংগ্ৰাম ও আত্মত্যাগ; তা তো এক-দুই দিন বা দুই-তিন মাসের ঘটনা নয়। এ দেশের রাজনীতিকরা বহুমাত্রিক প্রতিকূলতার মধ্যেও ভোটাধিকার ফিরে পাওয়ার লড়াই চলমান রাখতে গিয়ে লাখ লাখ নেতাকর্মী রক্তে রঞ্জিত হয়েছেন, ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন এবং মামলা মোকাদ্দমায় জর্জরিত হয়ে জীবন সংসার তছনছ হয়ে যাওয়া মতো বেদনাদায়ক ঘটনা অগণিত। এবং তা সমগ্ৰ বাংলাদেশ জুড়ে। যে ইতিহাসে আছে পিতার কাঁধে রাজনীতি করা সন্তানের লাশ, জেলখানায় বসে শোনা বাবা কিংবা মায়ের মৃত্যুর সংবাদ; মমতামাখা মুখটি শেষ বারের মত দেখতে ডান্ডাবেড়ি পরে জানাজায় অংশ নেওয়া, কারো কারো ক্ষেত্রে জেলখানায় নীরবে চোখের পানি ফেলা, নিখোঁজ হয়ে যাওয়া স্বামী কিংবা বাবার অপেক্ষায় আশা নিরাশার মাঝে দিন কাটানো রাজনৈতিক পরিবারগুলোর যন্ত্রণা, অভিভাবকহীন হয়ে পড়া সংসারের অভাব অনটন; এক কথায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এসব সামগ্রিক যন্ত্রণা ও ত্যাগ আসলে কার জন্য?
আপনার এবং আমার জন্য। আমাদের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। দেশ ও জনগণের স্বার্থে যারা নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয় সমুন্নত রেখে সাহসের সাথে রাজপথে থেকেছেন, লড়াই করেছেন; তাদের ত্যাগ, শ্রম ও ভালোবাসা নিঃসন্দেহে ভোটারদের মনস্তত্ত্বের উল্লেখযোগ্য একটি উপাদান।
যদিও জুলাই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে চুড়ান্ত বিজয়ের সূচনা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। পরবর্তীতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করলে তা আরও বেগবান হয়ে ওঠে। এবং ধীরে ধীরে সরকার পতনের দিকে নিয়ে যেতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে বিএনপি, জামায়াতসহ বাম রাজনৈতিক সংগঠন, মাদ্রাসা শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক এবং সবশেষ সর্বস্তরের জনতা রাস্তায় নেমে আসার মধ্যে দিয়ে সৃষ্টি হয় ৫ আগস্ট।
মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের এবারের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করা সত্যিকার অর্থে বেশ জটিল। কারণ, এবার এমন কিছু নতুন ও অপ্রত্যাশিত রাজনৈতিক বাস্তবতা সামনে এসেছে, যা অতীতের কোনো নির্বাচনের সঙ্গে তুলনীয় নয়। বিশেষ করে দীর্ঘদিনের ক্ষমতায় থাকা একটি দলের অনুপস্থিতি, তাদের সরকারের অংশীদার হিসাবে থাকা জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনের বাইরে রাখার জন্য দুই-একটি রাজনৈতিক দলের চাপ এবং এতে করে দলগুলোর যে ভোট ব্যাংক রয়েছে; সেগুলো কোথায় যাবে?
তবে দুঃখজনক হলো ৫ আগস্ট পরবর্তীতে দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক দল বিএনপি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে কমবেশি চাঁদাবাজি, দখলবাজি, মব সৃষ্টি, প্রভাব বিস্তারসহ নানামুখী অভিযোগ এবং এক শ্রেণির নেতাকর্মীর উচ্ছৃঙ্খল আচরণ জনগণের মাঝে সৃষ্টি করেছে তীব্র অসন্তোষ। এর সবকিছুই ভোটারদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে তুলবে নিঃসন্দেহে। এতে করে ধারণা করা যায় প্রচলিত রাজনৈতিক আনুগত্যের বাইরে গিয়ে কিছু ভিন্ন মানদণ্ডকে গুরুত্ব দিতে পারেন ভোটাররা। সেক্ষেত্রে বলা যায় ‘স্বতন্ত্র প্রাথী’ হিসাবে যদি যোগ্য মানুষ ভোটে দাঁড়ান; ভোটারদের মধ্যে একটি অংশ সেদিকে ঝুকেঁ পড়বেন। সেই সংখ্যাটি এবার বাড়লেও বাড়তে পারে।
২০২৬ সালের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতীক দেখে ব্যালটে সিল মারার গতানুগতিক চিন্তাধারা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন ভোটারদের বড় একটি অংশ। যদিও জনগণের মনোভাবকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো সাংগঠনিক শৃঙ্খলা রক্ষা এবং জনগণের আস্থা অর্জনে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে প্রসঙ্গক্রমে একটি কথা উল্লেখ করা যেতে পারে যে রাষ্ট্রের ক্ষমতায় থাকাকালে বিএনপি সন্ত্রাস দমনে কঠোরতা দেখিয়েছে। বিশেষ করে নিজ দলের নানা স্তরের সন্ত্রাসীর ক্ষেত্রে। দুই হাজার দুই সালে সেনা তত্বাবধায়নে ’অপারেশন ক্লিনহার্ট’ এর প্রথম দিনে আটক হয় এক হাজার চারশত সন্ত্রাসী এবং তাদের অধিকাংশই ছিল বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত। তিন মাসের সেই অভিযানে বারো হাজার সন্ত্রাসী এবং নানাভাবে অভিযিুক্ত ব্যক্তিরা আটক হন। এমন কি ঢাকা আন্ডার ওয়ার্ল্ডের ডন হয়ে ওঠা নারায়ণগঞ্জের যুবনেতা ডেভিড ওই সময় নিহত হন ক্রস ফায়ারে। আলোচিত ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ প্রমাণ করে সন্ত্রাস দমনের প্রশ্নে বিএনপি নিজ দলের পেশীশক্তিকে ছাড় দেয় না।
মানুষ স্বভাবতই এমন কাউকে বিশ্বাস করতে চায়, যাকে সৎ এবং নির্ভরযোগ্য বলে মনে হয়। আবার এমন সৎ মানুষ রাষ্ট্রের জন্য ভালো নয়; যিনি সর্বোচ্চ পদে বসে আছেন; কিন্তু কোথায় কীভাবে দুর্নীতি হচ্ছে, অধস্তনরা সামনে ফাইল ধরছেন, তিনি স্বাক্ষর দিচ্ছেন; কিন্তু ফাইলের ফাঁক ফোকড় ধরতে পারছেন না। মোট কথা অসততা বুঝতে পারার মতো চিন্তাশক্তি যার নেই; তিনি ব্যক্তিজীবনে শতভাগ সৎ হলেও প্রকৃত অর্থে রাষ্ট্রের খুব একটা উপকারে আসে না।
ভোটাররা মূলত প্রার্থীর মুখের অভিব্যক্তি, কথা বলার ধরন, পূর্ববর্তী কর্মকাণ্ডের মধ্যে সততার দৃঢতা, কোমলতা এবং জনগণের স্বার্থে যেকোন কিছু নিয়ন্ত্রণে কতটা সাহসী ও দূরদর্শী তা খুঁজে দেখার চেষ্টা করেন। যদি কোনো প্রার্থীকে দেখা যায় অতীতে বিভিন্ন সময়ে তিনি মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছেন, নিজ এলাকার মানুষের প্রতি আন্তরিক থেকেছেন এবং শত প্রতিকূলতার মধ্যে দেশ ও জনগণের স্বার্থে লড়াই সংগ্রাম থেকে পিছিয়ে যাননি; সে ক্ষেত্রে ভোটারদের মনে তার রাজনৈতিক পরিচয়ের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা। গণতন্ত্রের প্রতি দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকার মানসিকতা। দুর্নীতিমুক্ত ও স্বচ্ছ ভাবমূর্তি। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রার্থী যে রাজনৈতিক দল করে থাকুক না কেন, দলের শীর্ষ পর্যায়ে যার শক্ত অবস্থান রয়েছে; যিনি তার ব্যক্তিগত ক্যারিশমা, দক্ষতা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং জনগণের সঙ্গে থাকা শক্তিশালী অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে নিজ এলাকার প্রয়োজনীয়তা পূরণে যুক্তি উপস্থাপন করতে পারেন এবং সরকারের শীর্ষমহল তার দাবিকে গুরুত্ব দিয়ে পূরণে বাধ্য হন; তেমন প্রার্থীকে নির্দ্বিধায় ভোট দিতে উৎসাহ বোধ করেন ভোটাররা।
সবকিছু মিলিয়ে বলা যায়, ২০২৬ সালের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে যাচ্ছে। দীর্ঘদিনের বঞ্চনা এবং হতাশার পর জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগে অত্যন্ত সতর্ক ও সচেতন থাকবেন। তারা এমন প্রার্থীকে বেছে নিতে চাইবেন, যিনি শুধু রাজনৈতিক আদর্শের প্রতিনিধিত্ব করেন না, বরং গণতন্ত্র, সুশাসন, সততা এবং জনগণের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। এই নির্বাচন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে বলে প্রত্যাশা করা যায়।
সুজায়েত শামীম সুমন: অপরাধ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
এমজেএফ