ঢাকা, শনিবার, ১৮ আশ্বিন ১৪৩২, ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ১১ রবিউস সানি ১৪৪৭

মুক্তমত

প্রতীকী ও মানবিক নৌযাত্রা: ফ্লোটিলা এক অনন্য নজির

মাহবুব আহমেদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১:৫২, অক্টোবর ৩, ২০২৫
প্রতীকী ও মানবিক নৌযাত্রা: ফ্লোটিলা এক অনন্য নজির সুমুদ ফ্লোটিলাকে আটকে দেওয়ার প্রতিবাদে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিন্দার ঝড় বইছে। ছবি: আনাদোলু এজেন্সি

মানবসভ্যতার ইতিহাসে যুদ্ধ সবসময়ই সবচেয়ে ভয়াবহ ক্ষতের নাম। আজকের লেখাটি সেই যুদ্ধ বিধ্বংসী সময়ের আবহে, যুদ্ধের সময়ের।

আমরা সত্যিকার অর্থেই যুদ্ধ সময়ে বাস করছি। যুদ্ধ হচ্ছে এমন কর্মকাণ্ড যার ধ্বংসস্তূপের ভেতরে হারিয়ে যায় নিরীহ মানুষের আর্তনাদ, শিশুর ভবিষ্যৎ এবং সভ্যতার বিবেক।  

এই প্রেক্ষাপটে, প্রতীকী শিল্পকর্ম, নৌযাত্রা বা শান্তির উদ্দেশ্যে নেওয়া কার্যক্রম হয়ে ওঠে মানবতার এক জোরালো প্রতিবাদ। সম্প্রতি ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা (জিএসএফ)’— এমন একটি আন্তর্জাতিক নৌকামিছিল, যা গাজার অবরোধ ভাঙতে এবং সেখানে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে যাত্রা করেছিল। কিন্তু ইসরায়েলি নৌবাহিনী আন্তর্জাতিক সাগরেই সেটিকে বাধা দেয়, অনেক নৌকা আটক করে এবং শত শত কর্মীকে অন্তরীণ করে। এই ঘটনার আলোকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে—মানবতার প্রতীক শুধু শিল্পে নয়, বরং বাস্তব জীবনের সাহসী কর্মযজ্ঞেও বিদ্যমান। যতটুকু জানা যায়, সুইডিশ জলবায়ু কর্মী গ্রেটা থুনবার্গকেও গাজায় মানবিক সাহায্য বহনকারী জাহাজ থেকে আটক করা হয়েছিল।  

বাংলাদেশের খ্যাতিমান আলোকচিত্রী ও মানবাধিকারকর্মী শহিদুল আলম গাজার উদ্দেশে যাত্রা করা গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলায় যোগ দিয়েছেন এবং তিনি এখন গাজার কাছাকাছি আছেন। তিনি বৃহস্পতিবার (২ অক্টোবর) ফেসবুক পোস্টে গাজার পথে নিজের অবস্থান জানিয়েছেন এবং প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করছেন।

জিএসএফ নামে এই আন্তর্জাতিক মানবিক উদ্যোগ নিয়ে কিছু তথ্য তুলে ধরতে চাইছি।
▪️উদ্দেশ্য: ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশনসহসহ একাধিক আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক মিলে ২০২৫ সালে এই উদ্যোগ নেয়। লক্ষ্য ছিল গাজার অবরোধের অমানবিকতা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা এবং সরাসরি খাদ্য, চিকিৎস সরঞ্জাম, জরুরি সাহায্য পৌঁছে দেওয়া।
▪️অংশগ্রহণ: প্রায় ৪০–৫০টি নৌকা এবং ৫০০-এর বেশি কর্মী, যাদের মধ্যে ছিলেন মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী, সাংস্কৃতিক কর্মী, লেখক ও সাধারণ মানুষ।
▪️প্রতীকী তাৎপর্য: প্রতিটি নৌকা ছিল একেকটি সহায়তার হাত, একেকটি আশার বার্তা।

ইসরায়েলের বাধা ও পদক্ষেপ
▪️ইসরায়েলি নৌবাহিনী ফ্লোটিলাকে গাজার উপকূল থেকে প্রায় ৭০ নটিক্যাল মাইল দূরে, অর্থ্যাৎ আন্তর্জাতিক জলসীমায় থামিয়ে দেয়।
▪️বেশ কয়েকটি নৌকায় সরাসরি অভিযান চালানো হয় এবং অংশগ্রহণকারীদের আশদোদ বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়।
▪️ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ এই বহরকে ‘প্ররোচনামূলক কাজ’ বলে অভিহিত করে দাবি করেছে, গাজায় সহায়তা পৌঁছাতে হলে তাদের অনুমোদিত চ্যানেলের মাধ্যমেই যেতে হবে।

কিন্তু বিশ্বজুড়ে প্রতিক্রিয়া ছিল ভিন্নমুখী। মানবাধিকার সংস্থা, সংবাদমাধ্যম ও বহু দেশ একে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে নিন্দা জানায়। আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবাদ চলছে। চলছে মানবাধিকার সংস্থা গুলোর তীব্র প্রতিক্রিয়া।

▪️অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল: সংস্থাটি ফ্লোটিকা আটকানোর ঘটনাকে বলেছে ‘বেপরোয়া আক্রমণ, যা শান্তিপূর্ণ মানবিক মিশনের ওপর চালানো হয়েছে। তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে—ইচ্ছাকৃতভাবে গাজার জনগণকে অনাহারে রাখার কৌশল অবলম্বন করছে দখলদাররা।
▪️হিউম্যান রাইটস ওয়াচ: আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী মানবিক সহায়তাকে বাধা দেওয়াকে ‘সামষ্টিক শাস্তি’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

রাষ্ট্র ও সরকারগুলো যা করছে
▪️দক্ষিণ আফ্রিকা: প্রেসিডেন্ট সাইল রামাফোসা সরাসরি বলেছেন, আটককৃতদের মুক্তি দিতে হবে এবং ইসরায়েলের এ পদক্ষেপ ‘আন্তর্জাতিক নৌআইনের লঙ্ঘন’।
▪️তুরস্ক, স্পেন ও গ্রিস: এ দেশগুলো ঘোষণা করেছে, ইসরায়েলের এই কর্মকাণ্ড নৌচলাচলের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে সরাসরি আঘাত।
▪️জাতিসংঘ মহাসচিবের কার্যালয়: গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে অবরোধকে অবসানের আহ্বান জানিয়েছে।

সংবাদমাধ্যমের সরাসরি সংবাদ প্রকাশেও প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে এই নির্মমতার ইতিহাস।
▪️এপি রিপোর্ট করেছে যে, নৌবহরের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর ঘটনা সরাসরি ‘মানবিক উদ্যোগকে অবৈধভাবে ব্যাহত করার’ উদাহরণ।
▪️আল জাজিরা বিশ্লেষণে বলেছে, ফ্লোটিলা গাজার মানুষের প্রতি বিশ্বের একতাবদ্ধতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল।
▪️দ্য গার্ডিয়ান লিখেছে, এটি নতুন করে বিশ্বকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে—অবরোধ মানে কেবল রাজনীতি নয়, মানুষের জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন।

এই আয়োজন ও প্রতীকী তাৎপর্য
ফ্লোটিলা এক অনন্য অনুভূতির সৃষ্টি করেছে, যেখানে প্রতিটি ধাপে ধাপে মানবাধিকার ও মানবতার পক্ষে আওয়াজ উঠছে। সামষ্টিক প্রচেষ্টা নিয়ে বলা যায় ছোট ছোট নৌকা ও মানুষের প্রচেষ্টা মিলেই গড়ে উঠেছে এক বিশাল মানবিক প্রতিবাদ। সহানুভূতির শক্তি, যুদ্ধ নয় বরং সহায়তাই পারে জীবন বাঁচাতে।  

এই বার্তা শুধু গাজার নয়, সিরিয়া, ইউক্রেন, সুদান—যেকোনো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের প্রতীক হতে পারে। শিল্প ও বাস্তবতার মিলন হিসেবে এটি এমন এক কার্যক্রম, যা প্রতীকী শিল্পকর্মের মতোই বার্তা দেয় যে, মানবতা কখনো থামে না।

আমাদের কি কিছু করার নেই? 
গণমাধ্যমে প্রচার করুন—এই ঘটনার বিশ্লেষণ ও প্রতিবাদ ছড়িয়ে দিন। ছাত্র, তরুণ ও সাংস্কৃতিক সংগঠনকে জড়িত করুন আলোচনা ও সচেতনতা বাড়াতে। আন্তর্জাতিক আইন (UNCLOS, Geneva Convention) ও মানবাধিকার চার্টারের আলোকে তথ্যভিত্তিক বিতর্ক গড়ে তুলুন। বিশ্বব্যাপী অনলাইন ক্যাম্পেইন চালান, যাতে সাধারণ মানুষ বিষয়টি বুঝতে ও অংশ নিতে পারে।  

সুমুদ ফ্লোটিলা যা শেখাল
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা বা জিএসএফ আমাদের শেখায় যে যুদ্ধ ও অবরোধ কখনো মানবতার ওপর জয়ী হতে পারে না। যদিও নৌকাগুলো আটক হয়েছে, তবে তারা মানুষের চেতনায় আশার আলো জ্বালিয়েছে।

যদি যুদ্ধ হয় ধ্বংসের প্রতীক, তবে এই ফ্লোটিলা হয়ে উঠেছে মানবতার প্রতীক—যা দেখায়, প্রতিটি যুদ্ধের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত জয়ী হবে কেবল মানবতা। দার্শনিক এস্কিলাস বলেছিলেন, ‘যুদ্ধের প্রথম শিকার হচ্ছে সত্য’। আমার ধারণা এই যুদ্ধবিধ্বস্ত পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে আমরা বোধ হয় সত্য কে হত্যা করে ফেলেছি। সামনের দিনগুলো কেমন হবে আমি জানি না, তবে দ্বিধাবোধ নেই—মানবতার নৌকা কখনো থামে না।

লেখক
উদ্যোক্তা ও মানবাধিকার কর্মী

এইচএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।