ঢাকা, সোমবার, ২৩ আষাঢ় ১৪৩১, ০৮ জুলাই ২০২৪, ০০ মহররম ১৪৪৬

মুক্তমত

তোমরা যারা বিএনপি করো

মনোয়ার রুবেল, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২১৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১৩
তোমরা যারা বিএনপি করো

গতকাল বাংলানিউজ২৪.কম-এ আমি লিখেছিলাম ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতদের ক্ষমা চাওয়া উচিত, তারা স্মৃতিসৌধে না গিয়ে অন্যায় করেছেন। আমি অত্যন্ত বেদনার সাথে লক্ষ করলাম, ফেসবুকে বাংলানিউজ পেজে এবং আমাকে ই-মেইলে প্রেরিত পত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতদের আচরণে কিছু ব্যক্তি উৎফুল্ল।

কেউ আওয়ামী লীগকে, কেউ শেখ হাসিনাকে, কেউ আমাকে, কেউ মিডিয়াকে গালিও দিয়েছেন। দু’একজন বলেছেন, রাষ্ট্রদূতরা স্মৃতিসৌধে না গিয়ে শেখ হাসিনার প্রতি অনাস্থা জানিয়েছেন। কেউ বলেছেন, কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দেয়ায় প্রতিবাদ জানিয়েছেন রাষ্ট্রদূতরা। একজন বলেছেন, দেশে স্বাধীনতা আছে নাকি? স্মৃতিসৌধে যায় নাই ঠিকই আছে। কেউ বলছে, ইইউ অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করে দিলে কোথায় যাবেন? তাদের কি অদ্ভুত আত্মসম্মানহীন চিন্তা!!

এই যে এতো লোক মন্তব্য করেছেন, নেতিবাচক ইমেইল করেছেন তারা সবাই শিবিরকর্মী এটা আমি মনে করি না। এদের অনেকে বিএনপির আদর্শে বিশ্বাসী। জিয়াউর রহমানের জাতীয়তাবাদী আদর্শের ভোটার তারা। এই একটা জিনিস খুবই পীড়াদায়ক এবং হতাশার যে বিএনপি সমর্থকদের অনেকেই জামায়াত শিবির এবং বিএনপির মধ্যে পার্থক্য তৈরি করতে পারছে না। তারা চলনে- বলনে জামায়াত শিবিরকে অনুসরণ করছে। কেউ খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে কিছু বললে যেমন প্রতিবাদ করছে, তেমনি রাজাকারদের বিরুদ্ধে কিছু বললেও এরা প্রতিবাদ করছে। জামায়াতি আদর্শ এবং বিএনপির মধ্যে জোটগত সূত্রতা থাকতে পারে, কিন্তু আদর্শগত সূত্রতা নেই এটা তারা বুঝতে পারছে না।

তোমরা যারা বিএনপি/ছাত্রদল করো তারা হয়তো একটা জিনিস নিশ্চয়ই জানো, বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একটি দল। শহীদ জিয়াউর রহমান একজন মুক্তিযোদ্ধা। জিয়াউর রহমানে বীরত্বগাথা যুদ্ধের কাহিনী স্কুলগুলোতে পড়ানো হয়।

অন্যদিকে জামায়াতে ইসলাম মুক্তিযুদ্ধের সহিংস ও সশস্ত্র বিরোধিতাকারী দল। ’৭১ এর সময় বিবেচনায় জিয়াউর রহমানকে হাতের কাছে পেলে জামায়াতেরকর্মীরা হত্যা করতো।

জামায়াতে ইসলাম তারা ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতি করে, ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে। জিয়াউর রহমান ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতির বিরোধী ছিলেন। ১৯৮০ সালে সেপ্টেম্বরে এক কর্মীসভায় জিয়ার বক্তব্য পড়লে তোমরা বুঝতে পারবে। তিনি বলেছেন-

“ কোন রাজনৈতিক আদর্শ ধর্মকে ভিত্তি করে হতে পারে না। একটা অবদান থাকতে পারে। কিন্তু ধর্মকে কেন্দ্র করে কখনওই রাজনীতি করা যেতে পারে না। অতীতে আমাদের অভিজ্ঞতা হয়েছে যে ধর্মকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান সময়ে যখনই রাজনীতি করা হয়েছিল সেটা বিফল হয়েছে। কারণ ধর্ম ধর্মই। আমাদের অনেকে আছে যারা আমাদের দেশে যে বিভিন্ন ধর্ম রয়েছে, সেগুলোকে কেন্দ্র করে রাজনীতির পরিবেশ সৃষ্টি করতে চেষ্টা করেন। রাজনীতির রূপরেখা বানাতে চেষ্টা করেন, আমরা বারবার দেখেছি তারা বিফল হয়েছে। ধর্মের অবদান থাকতে পারে রাজনীতিতে, কিন্তু রাজনৈতিক দল ধর্মকে কেন্দ্র করে হতে পারে না। এটা মনে রাখবেন, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। "

(বই- তারেক রহমান : অপেক্ষায় বাংলাদেশ । অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমেদ, মাজেদুল ইসলাম )

বিএনপির মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল, জামায়াতে ইসলাম বিপক্ষের। জামায়াত ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করে, বিএনপি ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিরোধী। এই আদর্শগত ব্যাপারগুলো তোমরা যারা নতুন প্রজন্মের বিএনপি সমর্থক তাদের বুঝতে হবে। তাহলে প্রশ্ন করতে পারো আদর্শগত মিল না থাকলে জোট হলো কিভাবে। উত্তর হলো, এটা ভোটের জন্য জোট। দুটি ভিন্ন মেরুর দলও ভোটের জন্য জোট করতে পারে। কিন্তু এর মানে দুটি আদর্শের একীভূত হয়ে যাওয়া নয়। এভাবে জোট পৃথিবীর অনেক দেশে হয়। তাই বলে কোনো আদর্শের লোক অন্য আদর্শে চলে যাবে, অন্য আদর্শের পক্ষে কথা বলতে হবে তেমনটি কখনোই নয়। ভারতের জোটগুলো দেখ, তারা অন্যায্য মনে করলে মুহূর্তেই জোটের সঙ্গীদের বিরুদ্ধে কথা বলে। বেশি দূরে নয় কলকাতার নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে চোখ রাখলেই বুঝতে পারবে। আমাদের দেশে আরেকটি জোট আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির কথা মন্দ কী। জোট হলেও বামদলগুলো ঠিকই প্রতি বছর নূর হোসেন দিবস, ডা. মিলন দিবস পালন করে, এরশাদের স্বৈরাচারী আমলের সমালোচনা করে। এটাই রাজনীতির আধুনিক ও প্রগতিশীল শিক্ষা।

তোমরা যারা বিএনপি সমর্থন করো তারা জানো কাদের মোল্লা জামায়াতের নেতা। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ড পেয়েছেন। জামায়াত তাদের অস্তিত্বের কারণেই এই দণ্ডের বিরুদ্ধে নানা কথা বলছে, অভিযোগ করছে, অপপ্রচার করছে। তারা মাঝে মাঝে বলছে- কসাই কাদের এবং কাদের মোল্লা এক নয়। আমি এখানেও অত্যন্ত পরিতাপের সাথে লক্ষ্য করলাম তোমরা এই বিষয়টা নিয়েও অন্যদের সাথে তর্ক করছো। যদিও এটা শিবিরের দায়িত্ব, তবু এটা তোমরা শিবিরের দায় কেন কাঁধে তুলে নিলে বুঝতে পারি না। দলীয় কারণে শিবির কাদের মোল্লার শাস্তির বিরোধিতা করতে পারে, কাদের মোল্লা তাদের নেতা; কিন্তু তোমরা যারা বিএনপি সমর্থন করো তারা কেন? তিনি তো তোমাদের নেতা নন, তিনি তোমাদের আদর্শের কেউ নন। তোমরা নিশ্চয়ই জানো কাদের মোল্লার ফাঁসি নিয়ে পাকিস্তনেঁ প্রতিক্রিয়া হয়েছে। তোমরা নিশ্চয়ই পত্রিকায় পড়েছে পাকিস্তান-জামায়াতের আমির মি. মুনওয়ার বলেছেন- কাদের মোল্লা পাকিস্তানের সন্তান। পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মীর নিসার আলী খান বলেছেন, কাদের মোল্লা বাংলাদেশ সৃষ্টির মুহুর্ত পর্যন্ত অখণ্ড পাকিস্তানের জন্য কাজ করেছেন।

তোমরা হয়তো খেয়াল করেছো, আদর্শগত অবস্থান থেকে বিএনপি এই ফাঁসির রায় নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া বা নিন্দা বা উদ্বেগ জানায় নি। কারণ তারা আদর্শগতভাবে নিজেদের অবস্থান আলাদা পরিচয়ে পরিচিত করতে চেয়েছেন। তোমরা যারা নতুন প্রজন্ম, জামায়াত শিবির তোমাদের যুক্তি, বিশ্বাসে ও কথায় প্রভাব ফেলার চেষ্টা করে। তোমাদেরকেই আলাদা করতে হবে- তোমাদের আদর্শের বক্তব্য কোনগুলো, কোন কথাগুলো অন্য আদর্শের, তোমরা কোন কথা গুলো বলবে, তোমাদের কোন কথা অন্য আদর্শ থেকে ধার করা সেগুলো তোমাদের নিজেদেরকেই পৃথক করতে হবে।   “আমরা বিএনপি, এই কথাগুলো আমাদের",“এই কথাগুলো শিবিরের"- এভাবে যখন আলাদা করতে শিখবে তখনি আত্মবিশ্বাস বাড়বে। তখন যে কোনো অপশক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবে। এটা অবশ্যই জরুরি।

সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম চিরন্তন রাজনৈতিক ঐতিহ্য। সরকার জুলুম করছে মনে হলে বিরোধীদলকে তার প্রতিবাদ করতে হয়, প্রয়োজনে সরকারের পতন ঘটাতে হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বর্তমান আন্দোলন বিএনপির তেমনি একটি আন্দোলন বলেই আমি মনে করি। তোমরা যারা বিএনপি করো তারা অবশ্যই সরকারের সমালোচনা করবে, প্রয়োজনে মিটিং-এ মিছিলে যাবে, যতই গ্রেফতার নির্যাতন হোক আন্দোলনে থাকতে হবে, আন্দোলনের পথ মসৃণ নয়। কিন্তু সরকারকে হেয় করতে গিয়ে রাষ্ট্রকে এবং স্বাধীনতাকে অপমান করা হচ্ছে কিনা সেই বিষয়টা খেয়াল রাখা জরুরি। আজ যদি কোন বিদেশি কর্মচারী আমার স্বাধীনতাকে আমার রাষ্ট্রকে অপমান করে তবে সেটাকে বাহবা দেওয়া মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দলের আদর্শ হতে পারে না। আওয়ামী লীগ বিএনপির দ্বন্দ্ব- আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ। অন্যায় করলে দেশের জনগণকে নিয়েই ঘাড় ধরে শাসকদের তাকে নামাতে হয়।

কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা পাকিস্তান বা ভারত কেউই আমার দেশের স্বাধীনতার সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে কিছু বলবে বা কোনো কাজ করবে তা তোমরা মানতে পারো না। সবার উপরে নিজের দেশ, নিজের রাষ্ট্র ও স্বাধীনতা।

স্মৃতিসৌধে ফুল দেওয়া কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি নয়, এটা পুরো জাতিরই করণীয়, পবিত্র দায়িত্ব। কোনো দলের প্রোগ্রাম হলে সেখানে শুধু সেই দলের নেত্রীই যেতেন। খালেদা গিয়েছেন, হাসিনা গিয়েছেন--- সবাইকেই শ্রদ্ধা জানাতে যেতে হয়। তোমরা নিশ্চয়ই দল এবং রাষ্ট্রের পার্থক্য বোঝো। কিন্তু তোমরা যখন বলো, ‘ই.ইউ রাষ্ট্রদূতগণ স্মৃতিসৌধে না গিয়ে উচিৎ কাজ করেছে, সরকারের শিক্ষা হয়েছে’, তখন সেটা তোমাদের কথা নয়, সেটা তোমাদের নিজেদেরই অজান্তে হয়ে যায় শিবিরের কথা। শিবির এমন কথা বলতে পারে। কিন্তু তোমরা নও। তোমাদের আদর্শ ভিন্ন। তোমাদের আদর্শ একজন মুক্তিযোদ্ধার আদর্শ। তোমাদের কাছে সবার উপরে দেশ ও স্বাধীনতা। তোমাদের হাতেই স্বাধীনতার সম্মান।

লেখক: মনোয়ার রুবেল। ইমেইল: [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ০২০৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।