ঢাকা, বুধবার, ১৮ আষাঢ় ১৪৩১, ০৩ জুলাই ২০২৪, ২৫ জিলহজ ১৪৪৫

মুক্তমত

পিলখানা ট্র্যাজেডি ও গোয়েন্দা ব্যর্থতা!

জাহিদ নেওয়াজ খান, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১৪
পিলখানা ট্র্যাজেডি ও গোয়েন্দা ব্যর্থতা!

আদালতের ভাষায় সপরিবারে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ড আমাদের সেনাবাহিনীর জন্য চিরস্থায়ী এক কলংক। আর আমাদের সেনাবাহিনীর জন্য সবচেয়ে মর্মান্তিক ইতিহাস ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারির পিলখানা ট্র্যাজেডি।



দু’ ক্ষেত্রেই বারবার গোয়েন্দা ব্যর্থতার কথা এসেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে সেই গোয়েন্দা ব্যর্থতা কিছুটা আলোচিত হলেও পিলখানা ট্র্যাজেডিতে তা একেবারেই অনালোচিত। সেনাবাহিনীর নিজস্ব তদন্তে অবশ্যই তা উঠে আসার কথা। কিন্তু সাধারণ মানুষ তো অবশ্যই, গণমাধ্যমেরও তা অনেকটাই অজানা।

পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পর সেনাবাহিনীর সে-সময়ের কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল (কিউএমজি) লেফটেন্যান্ট জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত ২০ সদস্যের তদন্ত আদালত (কোর্ট অব ইনকোয়ারি) দীর্ঘ তদন্ত শেষে তাদের রিপোর্ট জমা দিয়েছেন। স্বাভাবিক কারণেই রিপোর্টটি সাধারণের জন্য প্রকাশ করা হয়নি। তবে বিভিন্ন সূত্রের বরাতে লেখক-সাংবাদিক মোস্তফা মল্লিক তার সদ্য প্রকাশিত ‘রক্তাক্ত পিলখানা: অপ্রকাশিত কথা অপ্রকাশিত ছবি’ বইয়ে রিপোর্টে উল্লেখ করা বিডিআর বিদ্রোহের ১১টি কারণ ও ২৭ দফা সুপারিশের কথা জানিয়েছেন।

মল্লিকের বইয়ের তথ্য অনুযায়ী ওই রিপোর্টের সারমর্ম এরকম - ঘটনার সাথে সুনির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দল বা নেতার সম্পৃক্ততা পাওয়া যায় নি। তবে কিছু বিডিআর সদস্য তাদের দাবি-দাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে এবং পরে কিছু বেসামরিক ব্যক্তি ও রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন।

বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সেনাবাহিনীর ওপর ক্ষুব্ধ হওয়া বেসামরিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিরা বিডিআর সদস্যদের দাবি আদায়ের চেষ্টাকে নিজেদের প্রতিশোধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে থাকতে পারেন। ঘটনার পরিকল্পনাকারী ও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের বেশিরভাগই অল্প বয়সী, সিপাহী পদবির এবং কেরানি পেশার ছিলেন। এছাড়া ঘটনার সাথে দেশি-বিদেশি কোনো জঙ্গি সংগঠনের সম্পৃক্ততার তথ্য, আলামত বা পূর্বাভাস পাওয়া যায় নি।

চারশ পৃষ্ঠার ওই রিপোর্টে সারসংক্ষেপে বিদ্রোহের কিছু কারণও উল্লেখ করা হয়েছে। এসবের মধ্যে আছে: একানব্বই সালে বিদ্রোহের পর অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ায় তারা এ ধরনের বিদ্রোহের পুনরাবৃত্তির দুঃসাহস দেখিয়েছে। অপারেশন ডাল-ভাত কর্মসূচির কারণে বিডিআর সদস্যদের সৈনিকসুলভ আচরণের অবক্ষয় ঘটে বলেও এতে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে বিডিআরে কর্মরত সেনা সদস্যদের সম্পর্কে বিরূপ ধারণার কথাও।

নির্বাচনের পর ডিএ বাবদ অর্থ প্রাপ্তিতে বিলম্ব, বিডিআরের সমস্যা সমাধানে স্বরাষ্ট্র ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের দীর্ঘসূত্রতা, বিডিআর সদস্যদের অনৈতিক সুযোগ-সুবিধায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির কথাও রয়েছে রিপোর্টে।

এছাড়া বিভিন্ন ঘটনায় অভিযুক্ত বিডিআর সদস্যদের বিরুদ্ধে নমনীয় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ, বিডিআরে কর্মরত সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিডিআরের নিজস্ব অফিসারদের মাধ্যমে উস্কানি ও অসন্তোষ সৃষ্টি এবং প্রশাসনে কিছু সিনিয়র সামরিক অফিসারের পরিবার, বন্ধু-বান্ধব এবং তাদের স্টাফ অফিসারের অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণে বিডিআর জওয়ানদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হওয়ার কথা রয়েছে এতে।

একটি ঘটনার পর তার অনেক বিশ্লেষণ এবং পর্যবেক্ষণ সম্ভব। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ঘটনা যাতে না ঘটে সেজন্য কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিলো সেটা। আর সেক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা গোয়েন্দা সংস্থার।

সেনাবাহিনীর তদন্ত আদালতের রিপোর্টেও বিদ্রোহ দমনে চারটি ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে গোয়েন্দা ব্যর্থতার কথা বলা হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে:

২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে বিডিআরের কিছু সদস্য কিছু সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ করলেও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এ বিষয়ে কোনো তথ্যই জানাতে পারে নি। বিডিআরের নিজস্ব গোয়েন্দা ইউনিট (আরএসইউ) সদস্যরা বিদ্রোহের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলো বলে আরএসইউ থেকেও কোনো তথ্য পাওয়া যায় নি। এছাড়া বিডিআর সপ্তাহ উপলক্ষে বিভিন্ন গোয়েন্দা রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী ২৪ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় যান। অথচ বিডিআর বিদ্রোহের বীজ বপন হয়েছিলো ওই ঘটনার আগেই।

অন্যদিকে সাবেক সচিব আনিস উজ জামান খানের নেতৃত্বে সরকার গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছে,  প্রায় দুই মাস ধরে বিডিআর বিদ্রোহের পরিকল্পনা চলে। পরিকল্পনার বিভিন্ন পর্যায়ে ষড়যন্ত্রকারীরা ঘটনার আগে পর্যন্ত বেশ কিছু বৈঠক করে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তারা ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস এমপি, শেখ ফজলুল করিম সেলিম এমপি এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন এমপির বাসা এবং অফিসে গিয়ে তাদের দাবি-দাওয়ার কাগজপত্র দিয়ে আসে।

সরকারের ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী পিলখানা যাওয়ার চারদিন আগে ২১ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীকে সম্বোধন করে লিফলেট বিলি করা হয় যা বিডিআর কর্তৃপক্ষের নজরে আসে। কিন্তু দেশের প্রধান গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এ লিফলেট সম্পর্কে কিছুই জানতো না। অথচ ওই লিফলেটে বলা হয়েছিলো: ‘বিডিআর বাহিনীতে ওদের (সেনাবাহিনী) দেখতে চাই না। প্রয়োজনে আন্দোলনের মাধ্যমে কুকুরের মতো সরাব’।

রিপোর্টে লিফলেটটি কোনো গোয়েন্দা সংস্থা পায় নি বলা হলেও সরকারি ওই রিপোর্টেই বলা হয়েছে: ‘২৩ ফেব্রুয়ারি তারিখে বিডিআর সদস্যদের দাবি-দাওয়া সম্বলিত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আহ্বান করা লিফলেটটি এনএসআই-এর নজরে আসে এবং তাৎক্ষণিকভাবে তারা মৌখিকভাবে আরএসইউ সদস্য মেজর মাহমুদুল হাসানকে অবহিত করে। কিন্তু বিষয়টি এনএসআই সরকারকে জানায় নি।

অন্যদিকে, সরকার প্রধানের পিলখানা আগমন উপলক্ষে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর ২২ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখে একটি প্রতিবেদন পাঠায় মহাপরিচালক, স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ)-এর কাছে। ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, সন্ত্রাসী চক্রের সংঘবদ্ধ বা বিচ্ছিন্নভাবে আক্রমণের সুনির্দিষ্ট কোনো হুমকির আশংকা নেই।

বিস্ময়করভাবে প্রতিবেদনে একথাও জানা গেছে যে, পিলখানায় এনএসআই, এসবি এবং ডিজিএফআইয়ের কোনো গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক নেই (তখন পর্যন্ত)। এ কারণে তারা ঘটনার আগে বা চলার সময় সরকারকে প্রয়োজনীয় তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

সরকারি তদন্ত প্রতিবেদনে একথাও বলা হয়েছে: কোনো সংস্থাই ঝুঁকি নিয়ে হলেও নিজস্ব সোর্সের মাধ্যমে ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানার ভেতরের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহের উদ্যোগ নেয় নি। উপরে বর্ণিত অবস্থাগুলো জাতীয় দুর্যোগকালে গোয়েন্দা সংস্থাসমূহের অদক্ষতা, অপেশাদারিত্ব ও অমার্জনীয় ব্যর্থতার চিত্র তুলে ধরেছে।

পিলখানা হত্যা মামলার রায়ে রেকর্ড সংখ্যক ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ডসহ অন্যদের শাস্তি দিতে গিয়ে বিচারক ড. মো. আখতারুজ্জামানও বিদ্রোহ শুরু হওয়ার আগেই তা দমনে তথ্য জানাতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ব্যর্থতার কথা বলেছেন।

পিলখানায় সেদিন যারা শহীদ হয়েছেন, তারা আর কখনও ফিরে আসবেন না। সন্তানরা আর কখনও ফিরে পাবে না তাদের বাবাকে, স্ত্রী তার প্রিয়তম স্বামীকে।   অনেক মা-বাবাকে পুত্রশোকের যন্ত্রণা নিয়েই কাটিয়ে দিতে হবে দীর্ঘ জীবন। যে কর্মকর্তা তার সহকর্মীর মরদেহ বহন করেছেন, সারাজীবনই তার চোখে টলমল করবে জল।

হয়তো তাদের বারবারই একটা কথা মনে হয়, বাহিনীগুলোর মধ্যে যে গোয়েন্দা জাল বিছানো আছে, সেখান থেকে কেউ যদি আগাম তথ্য জানাতে পারতো তাহলে হয়তো তাদের প্রিয় মানুষটিকে এভাবে চলে যেতে হতো না। কিন্তু সেরকম কিছু হয় নি; সেটাই বাস্তবতা।

তবে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ যেন ভ্রাতৃঘাতী এমন ট্র্যাজেডি আর না দেখে সেজন্য অনেক সুপারিশের মধ্যে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে নিয়ে পরামর্শ এসেছে। সংশ্লিষ্ট সকল গোয়েন্দা সংস্থা ও তাদের কার্যপদ্ধতি ঢেলে সাজানোর জন্য কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স ফোর্স গড়ে তোলাসহ একটি সমন্বিত গোয়েন্দা কার্যক্রম গ্রহণের সুপারিশ করেছে সরকার গঠিত তদন্ত কমিটি। ওই কমিটি সুস্পষ্টভাবে বলেছে, সকল গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্ব ও কর্তব্য পুনর্বন্টন এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ে একটি কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সমন্বয় কমিটি গঠনের মাধ্যমে সকল গোয়েন্দা তথ্য পর্যালোচনার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

গোয়েন্দা সংস্থা বিষয়টি যেহেতু স্পর্শকাতর, তাই এসব সুপারিশ আদৌ বাস্তবায়ন হয়েছে কি না জানা নেই। ওই ঘটনায় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ব্যর্থতার মূল্যায়নের ফলাফল এবং ভবিষ্যৎ নিয়েও সবকিছুই সাধারণের অজানা। তবে বাস্তবতা হলো, পিলখানা ট্র্যাজেডিতে স্বজনদের চোখের জল শুকিয়ে গেলেও তাদের হৃদয়ের কান্না এখনও অবিরাম জলধারা।

জাহিদ নেওয়াজ খান: সাংবাদিক, লেখক ( [email protected])

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।