ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

রাজনীতি মুক্ত হোক পাবলিক পরীক্ষা

ড. মঞ্জুরে খোদা, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১, ২০১৫
রাজনীতি মুক্ত হোক পাবলিক পরীক্ষা ছবি: রাজিব / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

এসএসসি পরীক্ষার্থীদের অভিভাবকদের একটি প্রতিনিধি দল শনিবার বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে যাতে পরিক্ষার্থীরা নির্বিঘ্নে পরীক্ষা দিতে পারে। একই সাথে অভিভাবক দলের পক্ষ থেকে উভয় নেত্রীকে এই বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে।



প্রশ্ন হচ্ছে, এই মৌলিক মানবাধিকার রক্ষা ও আদায়ে কেন অভিভাবকদের আকুল আকুতি নিয়ে নেতা-নেত্রীদের দ্বারে দ্বারে ধর্ণা দিতে হচ্ছে? যে দায়িত্ব রাজনীতিকদেরই পালন করার কথা! কিন্তু সেই স্থানটি আজ অনেকটা আশ্রয় না হয়ে পরিণত হয়েছে আতঙ্কে!  

রাজনৈতিক দলগুলো দেশের প্রচলিত গণতান্ত্রিক অধিকারের আওতায় তাদের দাবি আদায় ও জনমত গঠনের জন্য নিয়মতান্ত্রিক বিভিন্ন কর্মসূচি দেবে এটা স্বাভাবিক।

তবে তাদের কর্মকাণ্ড/কর্মসূচি সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত এবং নাগরিক অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হলে বলার কিছু নেই। কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে যেন নাগরিকের অধিকার ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেই বিষয় সচেতন ও দায়িত্বশীল থাকা। একই সাথে সময় ও বাস্তবতা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ বছর ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাস বাংলাদেশের এসএসসি শিক্ষার্থীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময় তাদের চুড়ান্ত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। যে প্রস্ততি শিক্ষার্থীরা বেশ আগে থেকেই জোড়ের সাথে নিতে থাকে।

সঙ্গতই এই সময় তাদের জন্য অবশ্যই একটি শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল পরিবেশ থাকাটা জরুরি। তাদের এই বিষয় ও প্রয়োজনটি নিশ্চিত করতে অভিভাবকরা যেমন প্রাণান্ত চেষ্টা করেন, এমনকি প্রতিবেশীরাও যথাসাধ্য সাহায্য করতে চেষ্টা করেন। রাজনীতিকরাও তো কোন পরিবারের অভিভাবক একই সাথে দেশ ও সমাজেরও অভিভাবক কিন্তু আমাদের রাজনীতিকরা কি সেই দায়িত্ব পালন করছেন? এর জন্য কে কতটা দায়ী ও অভিযুক্ত তা নিয়ে অনেক বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু এ কথা কোনভাবেই কেউ অস্বীকার করবেন না যে এর জন্য আমাদের শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ও হবে।

এর ফলে প্রধানত শিক্ষার্থীদের এক. পরীক্ষার প্রস্ততি ও ফলাফলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে দুই. তাদের জীবন থেকে কিছু মূল্যবান সময় হারিয়ে যাবে তিন. এই পরিস্থিতির মনস্তাত্তিক চাপ তাদের দীর্ঘদিন বয়ে বেড়াতে হবে চার. দেশের নেতা-নেত্রী ও রাজনীতির প্রতি বিতশ্রদ্ধ করবে পাঁচ. আর্থিক ভাবেও তাদের পরিবারকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

শুভ তাই নয়, এমন একটা অসাস্থ্যকর ও অনিশ্চিত পরিবেশে এই শিক্ষার্থীদের কচিমন নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে যার সূদুরপ্রসারী পরিণতি ভয়াবহ এবং জাতি গঠন ও উন্নয়নে এর প্রভাব হবে নিঃসন্দেহে নেতিবাচক। এই বিষয়গুলো যদি যুক্তিসঙ্গতভাবে বিবেচেনা হয় তাহলে কেন এই রাজনৈতিক দল ও নেতা-নেত্রীরা দেশের, নিজেদের ও এই ভবিষ্যৎ নাগরিকদের এত বড় ক্ষতি করছেন?

এ বছর প্রায় ১৫ লাখ শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। ফেব্রুয়ারির ২ তারিখে শুরু হয়ে তা শেষ হওয়ার কথা মার্চের ১৬ তারিখে। হরতাল বা অবরোধের কারণে একজন শিক্ষার্থীর একটি পরীক্ষা পেছানো মানে তাদের জীবন থেকে একটি করে দিন হারিয়ে যাওয়া। তাহলে জাতীয় ও সমষ্টিগত ভাবে ১৫ লক্ষ শিক্ষার্থীর জীবন থেকে একদিন করে হারানো মানে ১৫ লক্ষ দিন হারানো যা বছরের হিসেবে দাড়ায় প্রায় ৪ হাজার শিক্ষাবছরের উপরে! এরকম ৫ থেকে ১০টি পরীক্ষা অনিশ্চিত হলে শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে জাতীয় ভাবে হারাবে ২০ থেকে ৪০ হাজার শিক্ষাবছর! কে নেবে এর দায়? কে দেবে এর জবাব?

একটি পরীক্ষা স্থগিত বা অনিশ্চিত হওয়ায় শিক্ষার্থীর শিক্ষার ব্যয় নানা দিক থেকে বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে যেমন সরকারি ব্যয় বাড়ে তেমনি বেসরকারি বিনিয়োগ্ও বৃদ্ধি পায়। এই আর্থিক ক্ষতির সুনির্দিষ্ট হিসেব তাৎক্ষণিক বলা না গেলেও এর একটি সাধারণ ধারণা পাওয়া যায় এই ভাবে। একটি পরীক্ষার জন্য একজন অভিভাবকের যদি ৫০০ টাকা বাড়তি খরচ হয় তাহলে ১৫ লক্ষ অভিভাবকের খরচ হবে ৭৫ কোটি টাকা! এইভাবে যদি ১০টি পরীক্ষা অনিশ্চিত হয়- তাহলে আরও বাড়তি খরচ হবে ৭৫০ কোটি টাকা। এর সাথে সরকারের বাড়তি ব্যয় যুক্ত করলে যুক্ত এই ব্যয় হবে আরও অনেক বেশি। যে অংককে বলা যায় এই খাতে সরকারি বরাদ্দের কাছাকছি!
যেখানে আমাদের শিক্ষাখাতের সীমিত বরাদ্দের সাথে যুক্ত ছিল দুর্নীতি, তার সাথে আরেকটি বাড়তি উপসর্গ যুক্ত হয়েছে অপব্যয় বা অপচয়। যেটি আমাদের উন্নয়নাকাঙ্খী অনেকটা স্বতস্ফূর্ত ও অপরিকল্পিত (যথাযথ না) বিকাশমান সমাজ ও অর্থনীতির জন্য একটি বড় চাপ ও বাঁধা।  

দীর্ঘদিন ধরে আলোচিত হচ্ছে ‘পাবলিক পরীক্ষা’কে হরতালের আওতামুক্ত করার, কিন্তু সংশ্লিষ্টরা সে কথা কোনভাবেই বিবেচনা করার প্রয়োজন মনে করেন নি। ২০১৩ সালে একজন আইনজীবী হাইকোর্টে মামলা করেছেন-, কেন পাবলিক পরীক্ষাকে হরতালের আওতা মুক্ত রাখা হবেনা তা নিয়ে হাইকোর্টের রুল চেয়েছেন, যা এখন নিস্পত্তির অপেক্ষায় আছে!

১৫ লক্ষ শিক্ষার্থীর অভিভাবক ও স্বজনরা সবাই ভোটার। সেই সংখ্যাও কম নয়, তাও হবে কোটির উপরে। কিন্তু এই সকল অবিভাবক কি পারবেন, মুখ ফিরাতে.. এই নীতিহীন, দায়িত্ব জ্ঞানহীন রাজনীতি ও রাজনীতিকদের থেকে? যাদের কারণে তাদের পার করতে হচ্ছে আজ দুশ্চিন্তার নির্ঘুম রাত। এর সবটুকু দায় কেবল কোন একটি দলের একার নয়, কম বেশি দায় প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের কেউই এড়াতে পারেন না। '

দেশে যখন জাতীয় দুর্যোগ, জরুরি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তখন জরুরি অবস্থা জারি করার বিধান আছে। বাংলাদেশ একটি উদীয়মান অর্থনীতির দেশ। বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশের সংগঠন জি ২৫ এর পরে যে সম্ভাব্য ১১টি দেশের কথা বলা হয় বাংলাদেশ তার একটি। আর জাতি গঠনের এই সন্ধিক্ষণে শিক্ষা একটা অতি গুরূত্বপূর্ণ বিষয়, যাকে আমার একটি জরুরি বিষয় বলে মনে হয়।

দেশের পাবলিক পরীক্ষাগুলো যখন হয়, তখন তাকে জরুরি পরিস্থিতির মত বিবেচনায় নেয়াটাকে সমীচীন মনে করি। কারণ একজন শিক্ষার্থীর মান ও স্তর নির্ধারণের জন্য পরীক্ষা অতি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষণ। যে সময় তারজন্য প্রয়োজন একটি সুস্থ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ। একজন চিকিৎসক রুগী অপারেশনের ক্ষেত্রে যেমন সতর্কতা অবলম্বন করে থাকেন, পাবলিক পরীক্ষার বিবেচনাওতো সেরকমই হওয়া উচিত। হরতালের মধ্যে ক্লিনিক, হাসপাতাল, ওষুধ ও খাবারের দোকান যদি খোলা থাকে তাহলে কেন পাবলিক পরীক্ষার বিষয়টিকে সেই ভাবে বিবেচনা করা হবে না।

বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাতে কোন দৈবঘটনা না ঘটলে, এই অবস্থার আশু পরিবর্তনের সুযোগ দেখছি না। পাবলিক পরীক্ষা যদি কখনও হরতালের আওতা মুক্ত হয় তার মানে এই নয় আর কোন সমস্যা থাকবে না। আমি স্বীকার করছি এর সাথে যুক্ত আছে শিক্ষার্থীদের যোগাযোগ, নিরাপত্তা ও পরিবেশের বিষয়। সেটি নিশ্চিত করা আরও কঠিন কাজ। এর মাধ্যমে অন্তত পাবলিক পরীক্ষার একাডেমিক ক্যালেন্ডারের বিষয়টি নিশ্চিত হতে পারে। এমনিতে শিক্ষার মান, ধারা, নীতি, পদ্ধতি ইত্যাদি নিয়ে অনেক প্রশ্ন ও বিতর্ক আছে, তারপরও যা আছে তাও আজ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে হুমকির মুখে।

এই মুহুর্তে এটি প্রায় ১৫ লক্ষ পরিবার ও কোটি মানুষের উদ্বেগের বিষয়। বর্তমানে বাংলাদেশে ছাত্রসংখ্যা প্রায় সাড়ে ৪ কোটি যা প্রায় দেশের সমগ্র জনসংখ্যার ৪ ভাগের এক ভাগ। জাতি গঠন ও নির্মানের এই মূল কারিগরদের পথকে কণ্টকিত করে দেশকে নিরাপদ ও উন্নয়নের বক্তব্য কেবল স্ববিরোধীই নয় আত্মঘাতীও।

সঙ্গতই তাদের স্বার্থে ও প্রয়োজনে সংসদের আইন পাশ করতে হবে। প্রয়োজনে সময় ও পরিস্থিতির বিবেচনায় নতুন করে সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে হবে এবং পাবলিক পরীক্ষাকে তথাকথিত ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক কর্মসূচির আওতা মুক্ত করার।  

লেখক: মঞ্জুরে খোদা টরিক, গবেষক ও সাবেক ছাত্রনেতা। [email protected]        

বাংলাদেশ সময় : ১০৪০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০১, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।