ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

তবু কেন এই হরতাল-অবরোধ?

নিজামুল হক বিপুল, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭২০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৫
তবু কেন এই হরতাল-অবরোধ? ফাইল ফটো

কিছু দিন ধরে ভাবছিলাম হরতাল অবরোধ নিয়ে লিখবো। কিন্তু নানা ব্যবস্ততার কারণে হয়ে ওঠেনি।

দেরিতে লিখছি বটে। তবু প্রসঙ্গটি তাজা রয়েছে।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর গত একটা বছর বেশ ভালোভাবেই কেটেছিল দেশের মানুষের। কোথাও কোন ঝক্কি-ঝামেলা ছিল না। রাস্তাঘাটে কোন প্রতিবন্ধকতা ছিল না। এক বছর মানে ১২টি মাস গোটা দেশ জুড়েই পরিবেশ ছিল বেশ উৎসমুখর। এই সময়টায় দেশের মানুষের মধ্যে ছিল না কোন রকম উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা বা আতঙ্ক। ছিল না পেট্রোলবোমায় দগ্ধ হয়ে পুড়ে মরার ভয়। বরং সর্বত্রই ছিল সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা। ব্যবসা-বাণিজ্য চলছিল সমানতালে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে। সচল ছিল আমদানি-রপ্তানির চাকা। কল-কারখানায় সমানে চলছিল মেশিনারিজ। রাজপথ দাপিয়ে চলেছে দূর পাল্লার বিলাস বহুল যানবাহন থেকে শুরু করে বাস-ট্রাকসহ সব ধরনের যানবাহন। অর্থনীতির চাকা দ্রুত ঘুরতে থাকায় দেশের জিডিপিও বাড়ছিল। স্কুল কলেজে পড়ালেখা চলেছে নির্বিঘ্নে। এসএসসি, এইচএচসি, জেএসসি কিংবা পিএসসি পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়। প্রতিটি পরীক্ষা দিয়ে পরীক্ষার্থীরা ফলের প্রত্যাশা নিয়ে আনন্দ করতে করতে পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষায় ছাত্রছাত্রীরা অংশ নিয়েছে উৎসবমুখর পরিবেশে। হরতাল-অবরোধ কিংবা পেট্রোলবোমা হামলার ভয় এই সময়টায় একবারের জন্যও কাউকে  তাড়িয়ে বেড়ায়নি।

অথচ একটা বছর শান্তিপূর্ণভাবে পার করতে না করতেই হঠাৎ করেই যেন ঈর্ষার আগুণ জ্বলে উঠলো আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বর মধ্যে। সেই আগুনে পুড়ে ছারখার হচ্ছে দেশের বিপুল সম্ভাবনা। পুড়ছে সাধারণ মানুষ রাজনীতির সঙ্গে যাদের নেই কোন সম্পর্ক। দেড়টা মাস আমাদের পুরো ব্যবস্থাটা বেশ ধাক্কা খেয়েছে। কী শিক্ষা ব্যবস্থা, কী ব্যবসা বাণিজ্য, কী পরিবহন সেক্টর, কী আমদানি-রপ্তানি। সবক’টা সেক্টরেই এক ধরনের স্থবিরতা। এর মূল কারণ হচ্ছে যারা ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিতে পারেনি, আরেকটু স্পষ্ট করে বললে কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনবর্হাল চেয়ে নির্বাচনে অংশ নেননি; বিএনপিসহ সেই রাজনৈতিক জোটের তীব্র রোষানলে পড়ে আজ গোটা দেশের অস্বস্তি। নির্বাচনে অংশ না নেয়ার অনুশোচনায় তারা এখন শুধু দেয়ালে কপাল ঠোকাচ্ছেন। আন্দোলনের নামে সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করছেন।

বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন ২০দলীয় জোট, যার মধ্যে অন্তর্ভূক্ত রয়েছে আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী জামায়াতে ইসলামী। এ জোটটি ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিয়ে যে ভুল করেছিল, এখন তারা সেটি আন্দোলনের নামে মানুষ হত্যা করে শুধরানোর চেষ্টা করছে! নির্বাচনের ঠিক এক বছর পূর্তির দিনে বিএনপি জোট ৫ জানুয়ারিকে গণতন্ত্র হত্যা দিবস পালনের ঘোষণা দিয়ে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের ডাক দেয়। কিন্তু সমাবেশের অনুমতি না পেয়ে ৫ জানুয়ারি দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে না হতেই জোট নেত্রী খালেদা জিয়া দেশব্যাপী লাগাতার অবরোধ কর্মসূচির ঘোষণা দেন। তারপর থেকেই গত প্রায় দেড় মাস ধরে দেশে চলছে কথিত অবরোধ কর্মসূচি। এর সঙ্গে বাড়তি হিসেবে দেশবাসী প্রায় প্রতিদিনই পাচ্ছেন ‘হরতাল’র মত কর্মসূচি। বিশেষ করে এসএসসি পরীক্ষা শুরুর দিন থেকেই নিয়মিত সপ্তাহ জুড়ে হরতাল দিচ্ছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট। শুধু মাত্র সাপ্তাহিক ছুটির দিন হিসেবে শুক্র ও শনিবার হরতালের আওতামুক্ত থাকছে। তবে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না যদি এই ছুটির দিনেও হরতালের ডাক দেয় বিএনপি জোট।   কিন্তু বিএনপি জোট যে দিনের পর দিন অবরোধ আর হরতাল চালিয়ে যাচ্ছে তাতে কী কোন ফল আসছে? সাদা কিংবা কালো চোখে যেভাবেই দেখি না কেন আপাতত বিএনপি জোট কথিত আন্দোলন থেকে কোন ফল এখন পর্যন্ত নিজেদের ঘরে তুলতে পারেনি। মানুষের প্রশ্ন তবু কেন এই হরতাল আর অবরোধ?

১৫ দিনেরও বেশি সময় ধরে দেশে কার্যত কোন হরতাল পালন হচ্ছে না। দেশের বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে যতটুকু জানতে পেরেছি তাতে কোথায়ও হরতালের ছিটেফোঁটাও নেই। দূরপাল্লার বাস অপেক্ষাকৃত কম চললেও হাইওয়েতে বাস-ট্রাকসহ সব ধরনের যানবাহন চলেছে। আন্তঃজেলা পরিবহন ব্যবস্থাও স্বাভাবিক। এই হরতালের মধ্যেই দেশের এক জেলা থেকে অন্য জেলায়, বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রাজধানী ঢাকায় প্রয়োজনের তাগিদে নিয়মিতই আসা যাওয়া করছেন লোকজন। অবরোধ তো নয়ই, হরতালজনিত কারণেও কারো কোন কাজই থেমে নেই। এমনকি বিএনপি ও তার জোট শরিক দলের নেতাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প কারখানা কোন কিছুই বন্ধ থাকছে না। আর রাজধানীর কথা বাদই দিলাম। শুক্র ও শনিবার বাদে গত তিন সপ্তাহের টানা হরতালে রাজধানীতে প্রতিদিনই যানজট লেগেছিল। সব ধরনের পরিবহনই পথে নেমেছে। আর সাধারণ মানুষ তো প্রতিদিনই কাজের সন্ধানে পথে নামছেনই।  

তবে গণমাধ্যমগুলোতে প্রেসবিজ্ঞপ্তি পাঠানোর মাধ্যমে হরতাল আহ্বানের কারণে একটা সমস্যা হচ্ছে। সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস থেকে শুরু করে প্রায় পুরো সপ্তাহ জুড়ে যেসব পূর্ব নির্ধারিত তারিখে এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল সেটি করা যাচ্ছে না। অবশ্য সাপ্তাহিক ছুটির দিনে এই পরীক্ষা নিচ্ছে বোর্ড কর্তৃপক্ষ। একইভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্লাস হচ্ছে না সপ্তাহের পাঁচ দিন। শুধুমাত্র শুক্র ও শনিবারে ক্লাস নিতে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলোকে।

তাই বলি, এবার ক্ষ্যান্ত দিন। অন্তত একটি বারের জন্য দেশের মানুষকে হরতাল-অবরোধের হাত থেকে মুক্তি দিন। এসব কর্মসূচির নামে আর মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করবেন না দয়া করে। আমাদের সন্তানরা যাতে বাকী দিনগুলোতে নির্বিঘ্নে পরীক্ষা দিতে পারে সেই সুযোগটা দিন।
 
লেখক: সিনিয়র রিপোর্টার, বাংলাদেশ প্রতিদিন

বাংলাদেশ সময়: ০৭১৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।