ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের হুইলচেয়ার ক্রিকেট, দেশে কদর চাই

মোহাম্মদ মোহসিন, অধিনায়ক, বাংলাদেশ হুইল চেয়ার ক্রিকেট দল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৫৪ ঘণ্টা, মার্চ ২৯, ২০১৫
বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের হুইলচেয়ার ক্রিকেট, দেশে কদর চাই

ছোটবেলা থেকে খেলাধুলায় আমার আলাদা একটা শখ ছিল। কিন্তু শারীরিক সমস্যার কারণে খেলাধুলা করা প্রায় অসম্ভব ছিল আমার জন্য।

তারপরেও বন্ধুদের সহযোগিতায় ক্রিকেট খেলায় অংশ নিতাম। ধীরে ধীরে পুরোদমে ক্রিকেট খেলা শুরু করে দেই।
 
২০১০ সাল। একদিন হুইলচেয়ারে বসে ক্রিকেট খেলার একটি ছবি আমি আমার ফেসবুক প্রোফাইলে দেই। ছবিটি দেখে ভারতের হারুনুর রশিদ নামের একজন আমার সাথে যোগাযোগ করতে আগ্রহী হন। তিনি আমার ফোন নম্বর চান। ফোনের মাধ্যমেই তার সাথে দীর্ঘদিন যোগাযোগ চলে আমার।
 
এই হারুনুর রশিদ আমার কাছে বাংলাদেশের ক্রিকেট সম্পর্কে জেনে পরামর্শ দেন আমি যেনো প্রতিবন্ধী মানুষদের ক্রিকেট সংস্থা গঠনের ব্যাপারে আমাদের দেশের বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার সাথে যোগাযোগ করি। তার সাথে আবারও যোগাযোগ করতে বলেন তিনি।

এরপর আমি বাংলাদেশের বধির ও ব্লাইন্ড ক্রিকেট দলের কোচের সাথে যোগাযোগ করি। ক্রিকেট নিয়ে আমাদের পরিকল্পনার কথা তাদের জানাই। তাদের সহযোগিতাও চাই। তারা আমাকে হারুনুর রশিদের সাথে যোগাযোগ করতে বলেন এবং আশ্বাস দেন তারা আমাদের সাথে কাজ করবেন।

আমি হারুন ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করার পর কোচদের কাছ থেকে সাড়া পেতে ব্যর্থ হই। কিন্তু হতোদ্যম না হয়ে আবার বেশ কয়েকটি সামাজিক সংগঠনের সাথে যোগাযোগ করি। সেক্ষেত্রেও আমার আবেদন তেমন সাড়া পায় না।

এসময় একটি পত্রিকায় ‘টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া হুইলচেয়ার ভ্রমণ’ নিয়ে আমার একটি লেখা প্রকাশিত হয়। সে সুবাদে পত্রিকার সাথে সম্পৃক্তদের মাধ্যমে আমি সি আর পি-এর সাথে যোগাযোগ করি। পরিচয় হয় কিরণ ভাই, বাদশা ভাই, মহয়মা ভাই, রুবেল ভাইয়ের সাথে।

একদিন সি আর পি-তে এক আড্ডায় তাদেরকে আমার কথাগুলো খুলে বলি। জানাই, ভারতের ফিজিক্যাল ডিজ্যাবল্ড ক্রিকেট দল আমাদের সাথে খেলতে আগ্রহী। তাদের আমন্ত্রণ জানালে তারা আমাদের দেশে এসে খেলতে রাজি।

আমার প্ল্যান শোনার পর কিরণের ভাইয়ের মাধ্যমে সি আর পি-এর প্রতিষ্ঠাতা ভেলরির সাথে আমার যোগাযোগ হয় ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ভেলরি আমার কথা শুনে অনেক আগ্রহের সাথে ভারতীয় শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট দলকে বাংলাদেশে ক্রিকেট খেলতে আমন্ত্রণ জানাতে বলেন। পাশাপাশি তিনি সি আর পি- ক্রিকেট দল গঠনের কাজ করেন। একটি প্র্যাকটিস সেশনে ২৫ জন শারীরিক প্রতিবন্ধী খেলোয়াড়ের মধ্যে ১৬ জন খেলোয়াড় সিলেক্ট করা হয় টুর্নামেন্টের জন্য।
 
২০১৩ সালে ভারতের একটি দল আমাদের দেশে আসে সি আর পি-এর ক্রিকেট দলের সাথে তিনটি ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলতে। কিন্তু সেবার আমি ১৬ জনের দলে থাকা সত্ত্বেও হুইলচেয়ার ব্যবহার করার কারণে ১১ জনের দলে সুযোগ পাইনি। এতে ভারতের হারুনুর রশিদ ভাই মনঃক্ষুণ্ণ হন। তিনি আমাকে পরামর্শ দেন আলাদা একটি ক্রিকেট সংস্থা গঠনের। যারা শুধুমাত্র শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট খেলোয়াড়দের নিয়ে কাজ করবে।

আমি সি আর পি-কে প্রস্তাব দেই। ব্লাইন্ড ক্রিকেট টিমের সাথে দুই-তিনটা মিটিংও করি। কিন্তু সফলতার মুখ তেমন দেখিনি।

হারুন ভাই তাই বলেন যে, সি আর পি যেহেতু একটি হাসপাতাল তাই তাদের দিয়ে ক্রিকেটের কাজ সুদূর প্রসারী হবে না। পরবর্তীতে বাংলাদেশ প্যারা অলিম্পিকের কোচ ইঞ্জিনিয়ার মাকসুদুর রহমান ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করি। দীর্ঘ এক বছর পর তিনি আমাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরিতে যেতে বলেন তার সাথে দেখা করতে। তার সাথে দেখা করি এবং বাংলাদেশ শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট দলের কাজ শুরু করি। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে শারীরিক প্রতিবন্ধী খেলোয়াড়দের সংগ্রহ করি। ধীরে ধীরে সংস্থাকে আরো সংঘবদ্ধ করে তুলি।

২০১৪ সালের প্রথম দিকে ভারতের হারুন ভাই বাংলাদেশে আসেন আমাদের সংস্থার সাথে কথা বলতে। তিনি মিটিং-এর পর আমাদের প্রতিবন্ধী দলকে তাদের দেশে ৫টি ওয়ানডে ক্রিকেট খেলার আমন্ত্রণ জানান। আমরা আমন্ত্রণ গ্রহণ করি এবং স্পন্সরশিপের জন্য মাকসুদুর ভাইয়ের সাথে জনতা ব্যাংকের এমডি আবুল বারাকাত স্যারের অফিসে যাই। তার সাথে আমরা কথা বলি এবং তিনি আমাদের জন্য স্পন্সর হিসেবে কাজ করতে আগ্রহী হন।

আমরা ৬৫ জনের একটা ক্যাম্প শেষে ২০১৪ সালের জুন মাসে ভারতে তাজমহল ট্রফি খেলতে যাই এবং ২ -১ এ সিরিজ জিতে দেশে ফিরি।

তবুও, কোথাও যেন একটা ফাঁক থেকে যায় হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী খেলোয়াড়দের জন্য। মাঝে মাঝে বোঝা হিসেবেও প্রতিপন্ন হতে হয়। তাই, আমি এবং আমার মত হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় একসঙ্গে বাংলাদেশ হুইলচেয়ার ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন গঠনের জন্য কাজ করছি। কিন্তু, সমস্যা হচ্ছে একটি জায়গায়। আর্থিক স্বচ্ছলতা।

আর্থিক সমস্যার কারণে, আমাদের খেলোয়াড় থাকা সত্ত্বেও কোন প্র্যাকটিস করা হচ্ছে না বা কোন ক্যাম্পের আয়োজন আমরা করতে পারছি না। এমনকি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে খেলতে পারা সুযোগ পেয়েও আমরা হারাচ্ছি। পৃথিবীকে অনেক কিছু দেখাতে পারতাম। দেশকে বিশ্ব দরবারে নিয়ে যেতে পারতাম হুইলচেয়ার ক্রিকেটের মাধ্যমে। আশা করি, বড় মাপের সংস্থা বা মানুষেরা আমাদের পাশে থাকবেন। আমাদের সকল ধরণের সাহায্য সহযোগিতায় এগিয়ে আসবেন। যাতে আমরাও ক্রিকেট অঙ্গনে বিল্পব ঘটাতে পারি। বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে পারি ক্রিকেট বিশ্বের দিগন্তকারী ইতিহাসের পাতায়।

বাংলাদেশ সময় ১২৫৫ ঘণ্টা, মার্চ ২৯, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।