ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

শ্রম আইন তুমি কার!

আদনান সৈয়দ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩০ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩০, ২০১৫
শ্রম আইন তুমি কার!

দেখতে পাই সাভার রানা প্লাজার দু-বছর পূর্তিতে গোটা দেশ জুড়েই শ্রমিকের অধিকার নিয়ে জোড়েসোরে কথা হচ্ছে। শ্রমিকের জীবন নিশ্চিত করাতো বটেই পাশাপাশি শ্রমের যথাযথ মর্যাদা দেওয়া যে কোন দেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বৈকি! সেদিন পত্রিকায় দেখতে পেলাম বাংলাদেশে ট্রেড ইউনিয়ন এখন হুমকির সামনে।

কারখানা মালিকের অনেকেই ট্রেড ইউনিয়নকে তাদের ব্যবাসার হুমকি হিসেবে দেখছে। সে কারণে তারা কেউ চাচ্ছে না শ্রমিকরা ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত থাকুক।

২০১২ সালের দিকে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিস (বিলস্)-এর সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে শ্রমিক অধিকার,  শ্রমের যথাযত মূল্যায়ন, কর্মক্ষেত্রে নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত, কর্মক্ষেত্রে সুস্থ পরিবেশ, ট্রেড ইউনিয়ন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কিছু কাজ করার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল।

সত্যি বলতে শ্রমিকদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে অভিজ্ঞতা খুব আনন্দদায়ক ছিল না। এখানে বেশ কয়েকটি ঘটনা মনে পড়ে গেল এবং প্রাসঙ্গিক বলেই তুলে ধরতে চাই। খুলনা শহরের আশেপাশে প্রচুর চাতাল রয়েছে। এখানকার শ্রমিকদের বেশির ভাগ অংশই নারী। সেখানকার কারখানাগুলো সরজমিনে ঘুর দেখা গেল নারী শ্রমিকদের ত্রাহি দশা। পা দিয়ে ধান শুকাতে গিয়ে তাদের পায়ের তলায় ঘা হয়ে গেছে। কারো পায়ের তলা রক্তে রক্তাত্ব। তো চাতালগুলোতে ট্রেড ইউনিয়ন হলে কেমন হয় বিলস-এর এমন প্রস্তাবে মালিক পক্ষের  অনেককেই চেহারাই বদলে যেতে দেখেছি।

একই ভাবে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার স্টাডিস-এর সাথে গিয়েছিলাম পাটগ্রাম জেলার বুড়িমারি গ্রামে। সেখানে দেখা গেল, বিশ-ত্রিশ বছরের যুবকরা পাথর ভাঙতে গিয়ে পাথরের গুড়া তাদের ফুসফুস ছিদ্র করে সিলিকোসিস রোগের শিকার হচ্ছে এবং কিছুদিন পর পর সেখানে শ্রমিকরা মারা যাচ্ছে। নিরাপত্তা সিড়ি, আগুন থেকে বাঁচার কোন সরঞ্জাম, ফাস্ট এইড, হাতে গ্লাভস বা নাকে নিদেনপক্ষে মাস্ক ব্যবহারের কথা থাকলেও সেখানকার শ্রমিকরা তা জানেন না। বিষয়টি যে শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ  এবং জীবন বিধ্বংসী— তা সেখানকার মালিকরা যেন বুঝেও বুঝতে চান না। এই হলো আমাদের বাংলাদেশের শ্রমিকদের কঠিন বাস্তববার চিত্র। জানি, অনেক কারখানাই এখন শ্রমিকদের অধিকার এবং সুস্থ কর্ম পরিবেশ নিশ্চিত করতে নিবেদিত প্রাণ। কিন্তু সে সংখ্যা কত?

বাংলাদেশের শ্রম আইন ২০০৬-এর পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় শ্রমিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে কিন্তু বাস্তবে এর তেমন কোন প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায় না। কলকারখানায় কাজ করতে গিয়ে শ্রমিকের মৃত্যু যেন এখন দুধভাত। ভবন ধ্বসে শ্রমিকের মৃত্যু, কারখানায় আগুন লেগে শ্রমিকের মৃত্যু, দায়িত্বপালনকালীন সময়ে বহুতল ভবন থেকে পরে গিয়ে শ্রমিকের মৃত্যু এখন নিত্যদিনের ঘটন। যেখানে শ্রমিকের জানমালের নিরাপত্তা নেই, কর্মস্থলে স্বাস্থ্যগত আশাব্যঞ্জক কোন পরিবেশ নেই, মোট কথা শ্রমিকের জীবন যেখানে প্রতিনিয়তই বিভিন্ন কারণে হুমকির মুখে সেখানে কাগজে-কলমে শ্রম আইন শ্রমিক অধিকার রক্ষা করতে পারছে? সাভারের রানা প্লাজায় ভবন ধসে নিহত শত শত অসহায় শ্রমিকের লাশের পাহাড়কে সামনে রেখে এই প্রশ্নগুলো ঘুরে ফিরে চলে আসে। রানা প্লাজা ধস থেকে বেঁচে আসা কিছু ভাগ্যবান নারী শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি তারা কেউই মাতৃত্বকালীন সময়ে কোনরকম ছুটি-ছাটা পেতেন না। এতে অবশ্য খুব একটা অবাকই হইনি। কারণ আমরা জানি যে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে কর্মরত নারী শ্রমিকই অনেকেই এই অধিকার থেকে বঞ্চিত।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস্)-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ি বর্তমানে বাংলাদেশের শ্রমবাজারে নারী শ্রমিকের উপস্থিতি শতকরা ২৪.৪৪ ভাগ। পুরুষ শ্রমিকদের পাশাপাশি আমাদের এই নারী শ্রমিকরা ঝুকিপূর্ণ কাজ করে থাকে। বর্তমান গার্মেন্টস শিল্পে নারী শ্রমিকের পরিমাণ মোট শ্রমিকের ৮০ শতাংশ। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের নারী শ্রমিকরা তাদের কর্মক্ষেত্রে এখনও তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। অভিযোগ পাওয়া যায় কারখানার মালিক পক্ষ প্রতিনিয়তই অল্প মজুরী বা পুরুষের তুলনায় অর্ধেক মজুরীতে আমাদের এই অসহায় নারী শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে বাধ্য করছেন। অথচ বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এর ৩৪৫ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোন শ্রমিকের জন্য কোন মজুরী নির্ধারণ বা নিম্নতম মজুরির হার স্থিতিকরণের ক্ষেত্রে একই প্রকৃতির বা একই মান বা মূল্যের কাজের জন্য মহিলা এবং পুরুষ শ্রমিকগণের জন্য সমান মজুরীর নীতি অনুসরণ করিতে হইবে, এবং এতদসংক্রান্ত কোন বিষয়ে নারী-পুরুষ ভেদের কারণে কোন বৈষম্য কার যাইবে না”। আবারো সেই একই কথা। শ্রমিকের জন্য আইন আছে কিন্তু এই আইনের প্রয়োগ করবে কে?

বাংলাদেশের বিভিন্ন পেশার শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল যে, এদের বেশির ভাগই শ্রম আইন সম্পর্কে তেমন একটা জানেন না। এটি সত্যি দুঃখজনক। আমাদের শ্রমিকরা তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নন। একজন শ্রমিক জানতেও পারেন না যে শ্রমিক হিশেবে অন্য সবার মত তারও আইনের সহায়তা নেওয়ার অধিকার রয়েছে। বাংলাদেশ শ্রম আইনের ২০০৬-এর ২১৩ ধারা অনুযায়ী যে কোন শ্রমিক তার আইনি অধিকারের প্রয়োজনে শ্রম আদালতে দরখাস্ত করতে পারেন। কিন্তু আমাদের শ্রম বাজারে শ্রমিকদের জন্য রয়েছে ভিন্ন বাস্তবতা। দেখা  গেছে শ্রম বাজারে শ্রমিকের আধিক্য হওয়ায় শ্রমিক মালিকের যে-কোন অন্যায় আবদার মাথা পেতে নিতে বাধ্য হচ্ছে। মালিকপক্ষও এই সুযোগের পুরোপুরি ব্যবহার করছে। আর বলাই বাহুল্য সেক্ষেত্রে শ্রমিকের অধিকার আদায়ে এগিয়ে আসা ট্রেড ইউনিয়নগুলো বিভিন্নভাবে বাধা গ্রস্থ হচ্ছে। যার ফলে আমাদের শ্রমিকরা যেমন তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, পাশাপাশি বিপন্ন হচ্ছে মানবতা এবং পরিবেশ।

সন্দেহ নেই বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ আমাদের শ্রমিকদের রক্ষাকবচ। কিন্তু শ্রমিকরা কি সত্যি এর সুফল পাচ্ছে? এক্ষেত্রে বড় কথা হলো, এই আইনের যথাযথ প্রয়োগ খুব জরুরী। আমরা চাই শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ। আর সেই সঙ্গে আমাদের শ্রম বাজারে ট্রেড ইউনিয়কে আরো শক্তিশালী করা প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। একজন শ্রমিক তার প্রাপ্য অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকবেন এই আমাদের প্রত্যাশা।

এর জন্যে সরকারকে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। শুধু বড় বড় সভা সেমিনার আর বক্তৃতা দিয়ে কোন সুফল আসবে বলে মনে হয় না। শ্রম মন্ত্রনালয়ের উচিত সব শ্রমিক সংগঠনগুলোকে এক সঙ্গে নিয়ে কাজ করা। সেক্ষেত্রে যেসব বিষয়ের উপর শ্রম মন্ত্রণালয় গুরুত্ব দিতে:

এক: শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে ছোট ছোট (১ মিনিট/৩০ সেকেন্ড) বিজ্ঞাপন তৈরি করে তা গোটা দেশে ছড়িয়ে দিতে হবে।

দুই: শ্রম মন্ত্রনালয়, শ্রমিক সংগঠন এবং ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে সরাসরি একজন শ্রমিক যাতে তার ব্যক্তিগত সমস্যার কথা জানাতে পারেন, তার উপযুক্ত ব্যবস্থা রাখা। যেমন : চিঠির ড্রপ বক্স, ইমারজেন্সি হট লাইন যেখানে শ্রমিক বিনা খরচে কল করে তার সমস্যার কথা জানাতে পারবেন।

তিন: জাতীয়ভাবে মনিটরিং সেল তৈরি করা। কোন কারখানার মালিকের অনৈতিক কোন আচরণের জন্যে তার  দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান। গোটা দেশেই মনিটরিং সেল থাকবে এবং তা চালিত হবে সরকারের শ্রম মন্ত্রনালয়, ট্রেড ইউনিয়ন, শ্রমিক সংগঠন দিয়ে।

চার: যে সব কারখানার মালিকগণ শ্রম আইন মেনে চলছেন এবং শ্রমিকের প্রাপ্য অধিকার বুঝিয়ে দিচ্ছেন তাদের জন্যে থাকতে পারে বিশেষ পুরস্কার। খুব ঘটা করে তাদের সেই পুরস্কার জাতীয়ভাবে দেওয়া যেতে পারে।

পাঁচ: গোটা বাংলাদেশে বিলবোর্ডে বিভিন্নরকম আকর্ষনিয় ছবিসহ শ্রম আইন নিয়ে বিজ্ঞাপণ থাকতে পারে।
 
শেষ কথা হলো সরকার, কারখানা মালিক এবং শ্রমিকের স্বার্থরক্ষাকারী বিভিন্ন সংগঠনসহ দেশের সুশীল সমাজ সবাইকে এক সঙ্গে শ্রম আইন প্রতিষ্ঠায় আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। আইনের প্রয়োগ থাকতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই। ভুলে গেলে চলবে না শ্রমিক বাঁচলেই দেশ বাঁচবে। আর তা না হলে শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা শুধু সভা সেমিনারেই বন্দী হয়ে থাকবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৩০ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩০, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।