ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

‘পুলিশ’ বানান ও গলদ পাঠ

মো: আলমগীর হোসেন শিমুল, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩১ ঘণ্টা, মে ৩১, ২০১৫
‘পুলিশ’ বানান ও গলদ পাঠ প্রতীকী ছবি

“পুলিশ” আধুনিক রাষ্ট্র-যন্ত্রের একটি অপরিহার্য ও স্থায়ী অঙ্গ হিসেবে অবস্থান করে নিয়েছে। গত এক-দেড় শতাব্দীতে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ তাদের ‘পুলিশিং’ ব্যবস্থা  সুশৃঙ্খল ও জনগণের বন্ধু রূপে গড়ে তুলেছে।

আজ তথ্যপ্রযুক্তির যুগে পুলিশ-সেবা তারা এমন জায়গায় নিয়ে গেছে যে, পুলিশ প্রতিটি নাগরিকের সঙ্গে ছায়ার মতো থেকে তাঁর নিরাপত্তা বিধান করছে। সেজন্য এই পুলিশ যেকোনো মুহূর্তে যেকোনো পরিস্থিতিতে সম্পৃক্ত নাগরিকের অবস্থা-পরম্পরা বলে দিতে পারে এবং  মুহূর্তে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে সে তথ্য ছড়িয়ে দিতে পারে। অতি জনসম্পৃক্ত একটি বাহিনী হিসেবে বাংলাদেশে পুলিশকে কেনো নেতিবাচকতার বৃত্ত থেকে বের করে আনা সম্ভব হচ্ছে না সে-ব্যাপারেই বস্তুনিষ্ঠ, নির্মোহ আলোচনা সময়ের দাবি। আর এসব দিকের মধ্যে “পুলিশ” বানানটি কী কীভাবে নেতিবাচক এবং বানানরীতির সাথে সামঞ্জস্যহীন—এ নিয়ে আলোকপাত করা হবে।

বাংলা বানানরীতির শাশ্বত ধারাকে বাদ দিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই বাংলা বানান এমনভাবে লেখা হচ্ছে যা বিভ্রান্তিকর। আজও বাংলা বানান নিয়ে অনেক  দোদুল্যমানতা রয়ে গিয়েছে যার নিরসন করা প্রয়োজন। এই ধরনের বানানের একটি উদাহরণ “পুলিশ”। রবি ঠাকুরের কাব্যগ্রন্থ ‘খাপছাড়া’তে ‘নিধু বলে আড় চোখে’ কবিতায় ইংরেজি ‘police’ শব্দের বানান ‘পুলিস’ লেখা হয়েছে----‘পুলিস যখন করে ঘরে এসে চড়োয়া’।

কবিতাটি প্রথম অংশটি এমন:
নিধু বলে আড়চোখে, "কুছ নেই পরোয়া। '—/স্ত্রী দিলে গলায় দড়ি বলে, "এটা ঘরোয়া। '/   দারোগাকে হেসে কয়, "খবরটা দিতে হয়'--/পুলিস যখন করে ঘরে এসে চড়োয়া। / বলে, "চরণের রেণু নাহি চাহিতেই পেনু। '--/এই ব'লে নিধিরাম করে পায়ে-ধরোয়া।

বাংলা ভাষার প্রতিবেশী ভাষা হিন্দিতে ‘police’ শব্দের বানানও রবি ঠাকুরের লেখা বানানের অনুরূপ লেখা হয়েছে। যেমন, ভারতীয় পুলিশের উপর লিখিত বইয়ে এবং মধ্যপ্রদেশ ‘police’ -এর প্রতীকে ‘পুলিশ’ নয়, ‘পুলিস’ বানান লেখা হয়েছে। এব্যাপারে এ-ও বলা যায় যে, ভারতীয় ‘police’ সেবার কোথাও ‘police’ শব্দটি “পুলিশ” হিসেবে লেখা হয়নি। বেশিরভাগ জায়গাতে বানানটি লেখা হয়েছে “পুলিস”। যেমন উত্তর প্রদেশ পুলিস, মধ্যপ্রদেশ পুলিস, দিল্লি পুলিস ইত্যাদি। তবে কিছু জায়গায় ‘পোলিস’ লিখা হয়েছে যেমন মহারাষ্ট্র পোলিস। তাই বলা যায়, বাংলাতেই শুধু বানানটি ‘পুলিশ’ লেখা হচ্ছে।

বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক ব্যাপারের সাথে বাংলায় লিখিত “পুলিশ” শব্দের অনুরণন দেখা যায়। যেমনঃ ‘মড়া খায় ইলিশে,/ ঘুষ খায় পুলিশে’ বা ‘মাছের রাজা ইলিশ,/ জামাইয়ের রাজা পুলিশ। ’ উপরন্তু বাংলা ‘পুলিশ’ শব্দকে ইংরেজি “Foolish” শব্দের সাথে মিলিয়েও চালু আছে নানা মুখরোচক কথাবার্তা। অথচ শব্দটির বানান “পুলিস” লিখলে তা অনেক সুন্দর এবং প্রাঞ্জল হতো।

প্রাসঙ্গিকভাবে যদি আমরা বাংলা একাডেমির প্রমিত বানান খেয়াল করি তাহলে দেখবো শ,ষ,স-এর ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত নিয়মের কথা বলা আছে:
“তৎসম শব্দে শ, ষ, স-য়ের নিয়ম মানতে হবে৷ এ-ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রে সংস্কৃতের ষত্ব-বিধি প্রযোজ্য হবে না৷ বিদেশী মূল শব্দে শ, স-য়ের যে প্রতিষঙ্গী বর্ণ বা ধ্বনি রয়েছে বাংলা বানানে তাই ব্যবহার করতে হবে৷ যেমন: সাল (বৎসর), সন, হিসাব, শহর, শরবত, শামিয়ানা, শখ, শৌখিন, মসলা, জিনিস, আপস, সাদা, পোশাক, বেহেশ্ ত, নাশতা, কিশমিশ, শরম, শয়তান, শার্ট, স্মার্ট৷ তবে, পুলিশ শব্দটি ব্যতিক্রমরূপে শ দিয়ে লেখা হবে৷”

আর এই জায়গাটিই হচ্ছে আপত্তির। যেখানে বাংলার মতো সংস্কৃত ভাষা থেকে উদ্ভূত অন্যান্য প্রতিবেশী ভাষাতে সংস্কৃত ব্যাকরণের বিদেশি শব্দ বানানরীতির আদলে “পুলিস” লেখা হচ্ছে সেখানে বাংলায় কেনো এভাবে লেখা হবে তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। বরঞ্চ ভুল বানানের সাথে আবর্তিত হচ্ছে বহুল প্রচলিত এবং প্রতিনিয়ত ব্যবহার হওয়া এই শব্দটি। “পুলিশ”-- এই বানান প্রতিনিয়তই চোখে পড়ে থানা, প্রিজন ভ্যান, টহল গাড়ি ইত্যাদির মতো পুলিশের বিভিন্ন জনসম্পৃক্ত স্থাপনা ও যানবাহনের গায়ে। এগুলো বারবার জনসাধারণের চোখে পড়ে।

তাছাড়া শব্দটি ইংরেজি “Police” শব্দ থেকেই যেহেতু এসেছে, এইক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী বানানরীতি চালু করে ভাষার স্বাভাবিকতা ঠিক রাখা হলো কীনা সে প্রশ্ন করাই যায়। ঢাকার বহুল প্রচলিত ইংরেজি ভুল বানান Dacca আমরা কয়েক দশক ব্যবহার ও লালন করেছি। অবশ্য পরে-- ১৯৮২ সালের পর-- বাংলা উচ্চারণের সাথে মিল রেখে ঢাকার ইংরেজি বানান আমরা Dhaka করেছি।  

এছাড়া পুলিশের কোনো সদস্য কোনো অপকর্ম করলে সেই ক্ষেত্রে পুরো পুলিশকে দায়ী করে সংবাদপত্রে লেখার প্রবণতাও লক্ষ করা যায়। যেমন ‘শিক্ষককে লাঞ্ছিত করলো পুলিশ’। ‘তরুণীর শ্লীলতাহানি করলো পুলিশ’। মানে এখানে সমস্ত পুলিশ বাহিনীকেই প্রকারান্তরে যুক্ত করে ফেলা হলো। কিন্তু একই ধরনের আরেকটি শিরোনাম, ‘গাছে বেঁধে বউ পেটালেন সেনা সদস্য’। কিন্তু পুলিশ সদস্য বা কর্মী না লিখে এই ঘটনা পুলিশ সদস্য দ্বারা হলে বলা হতো ‘গাছে বেঁধে বউ পেটালো পুলিশ’। এই জাতীয় বৈপরিত্য কাম্য নয়। এই লেখার উদ্দেশ্য এই নয় যে, জনসাধারণ মনে করুক পুলিশ ফেরেস্তা অথবা শয়তান। বরং জনসাধারণ মনে করুক পুলিশ তাঁদের অংশ এবং মানুষ। এরাও ভুল করে, এরাও অপরাধে জড়ায়। এরা যাতে জনগণের সাথে সংগত ও কাম্য আচরণ করতে বাধ্য হয় সে-ব্যাপারে কার্যকরি পদক্ষেপ এবং যথাযথ আইন প্রণয়ন করাও জরুরি।

পরিশেষে বলা যায়, পুলিশিং আধুনিক বিশ্ব সভ্যতায় রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্ব হিসেবে সর্বত্র স্বীকৃত। কোনো রাষ্ট্র হয়তো সামরিক বাহিনী ছাড়াও সামরিক চুক্তির মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ভালো ভাবেই রক্ষা করতে পারবে কিন্তু অভ্যন্তরীণ আইন শৃঙ্খলা, নাগরিক নিরাপত্তা, উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিচার কোনো কিছুই সম্ভব নয় একটি সুশৃঙ্খল, জনবান্ধব পুলিশিং ব্যবস্থা ছাড়া। তাই পুলিশকে অধিকতর জনসম্পৃক্ত এবং জনবান্ধব করতে হলে এই ধরনের ভুল এবং নেতিবাচক মনোভঙ্গি প্রদানকারী বানানরীতি পরিহার করাও সময়ের দারি।

সর্বোপরি  স্বাধীনতা লাভের এত বছর পরেও সময়োপযোগী বানানরীতি না থাকা ভাষাগবেষক, ভাষাপ্রেমী প্রত্যেকের কাছে পীড়াদায়ক। তাই বাংলা একাডেমির প্রমিত বানানরীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা যদি এই ব্যাপারে উদ্যোগী হন এবং একাডেমি থেকে প্রকাশিত অভিধানগুলোতে যদি ‘পুলিস’ বানান অন্তর্ভুক্ত করেন তাহলে জাতির মননে তা গেথে যাবে সহসাই। তাছাড়া পত্রিকাগুলোতেও এই বানান লিখিত হলে সহজেই এ নেতিবাচকতা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যেতো।


মোঃ আলমগীর হোসেন শিমুল: সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ঢাকায় কর্মরত।


বাংলাদেশ সময়: ১১২৪ ঘণ্টা, মে ৩১, ২০১৫
সম্পাদনা: জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।