ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

মোদির দেশের মুক্তমত

দুই পারের রাজনীতি ও মোদির বাংলাদেশ সফর | সৌরাংশু সিংহ

মুক্তবিশ্লেষণ/মুক্তমত | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৩৬ ঘণ্টা, জুন ৫, ২০১৫
দুই পারের রাজনীতি ও মোদির বাংলাদেশ সফর | সৌরাংশু সিংহ

আগামী ৬ জুন বাংলাদেশ সফরে আসছেন প্রতিবেশী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। দু’দিনের এ সফর দুই বন্ধুদেশের মধ্যকার যোগাযোগ, বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সম্পর্ক জোরদারে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে।

সফর নিয়ে কী ভাবছেন মোদির দেশের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। বাংলানিউজের বিশেষ আয়োজনে থাকছে তাদের মতামত।  


লেখাটি শুরু করার আগে ব্যক্তিগতভাবে বলতে গেলে আমার বাংলাদেশ সম্পর্কে অতিরিক্ত আবেগও নেই, আবার খামোখা বিদ্বেষ মনোভাবও নেই বলেই বিশ্বাস। তাই সুদূর দিল্লিতে বসে একটি আবেগের সম্পর্ক নিয়ে নিরপেক্ষভাবে কিছু কথা বলার চেষ্টা করছি। আশা করব, আমার এ লেখার উদ্দেশ্য সফল হবে।

ওপারে থাকি আমি, তুমি রইবে এপারে
অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দশকে যখন মুঘলরা কোচবিহার রাজ্য আক্রমণ করে, তখন কেউ তার প্রভাব এতটা সুদূরপ্রসারী হবে বলে ভাবেনি নিশ্চয়। ১৭১৩ সালে যখন শান্তি চুক্তি হলো, তখন কেউ আর ভেবে দেখল না যে, কোচবিহার রাজ্যের কিছু জমিদার যারা শক্তিশালী ছিল, তাদের মুঘলরা উৎখাত করতে পারল না।
অন্যদিকে, যে সব ছোট ছোট জায়গা মুঘল সেনা দখল করে নিয়েছিল, তাও কোচবিহারের রাজার পক্ষে পুনর্দখল সম্ভব হয়নি। যেহেতু কোচবিহার রাজ্য নিয়মিত নজরানা দিল্লির দরবারে পেশ করত, তাই এসব ছোটখাট সীমান্ত সমস্যা নিয়ে ভাবার কোনো কারণও ঘটেনি।

ব্রিটিশরা তো স্বচ্ছন্দেই এ সমস্ত অঞ্চলে নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপন করেছিল। তাই সমস্যাটা কেউ ভেবেও দেখেনি। সমস্যা দেখা দিল যখন ১৯৪৭ সালে র‍্যাডক্লিফবাবু একমাসের মধ্যেই বিশেষ আলাপ-আলোচনা না করে গণ্ডি টেনে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান ও ভারত ভাগ করলেন কিন্তু কোচবিহার তখনও ভারতের অংশ হলো না। ফলে সেই ছোট ছোট জায়গাগুলো যা আমরা ‘ছিটমহল’ বলে জানি, তা কোচবিহারের অধীনেই রয়ে গেল। কোচবিহার ভারত রাষ্ট্রে বিলীন হলো ১৯৪৯ সালে আর ভারতে অবস্থিত ছিটমহলগুলোর হিসাব-কিতাব শেষ হয়ে গেল। কিন্তু তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত ছিটমহলগুলোর কী হবে? তাই অস্পষ্ট সীমারেখা বাংলাদেশে ভারতের ছিটমহল রেখে দিল ৫১টি আর ভারতে বাংলাদেশের ছিটমহল রইল ১শ’ ১১টি।

কিছু ছিটমহল আবার এর থেকেও জটিল। মানে বাংলাদেশের ভিতরে ধরুন একটা ছোট ভারত রয়েছে, তার মধ্যে কিছু অংশ আবার বাংলাদেশের হয়ে রয়েছে। আপনি আপনারসহ নাগরিকের বাড়ি যেতে গেলে রণপা বা হেলিকপ্টার ব্যবহার করে যেতে হবে।

সে যাই হোক, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠিত হবার পর ১৯৭৪ সালে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তিতে এই ছিটমহল হস্তান্তরের কথা ছিল, যা বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব সংসদে পাশও করিয়ে নেয়। কিন্তু রাজনৈতিক বা সামাজিক বা যেকোনো কারণেই হোক ভারতে চল্লিশ বছরের বেশি সময় লেগে গেল। শেষমেশ চলতি বছরের ৭ মে ভারতের সংসদ ১শ’তম সংবিধান সংশোধনী হিসেবে তা পাশ করে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন বাংলাদেশ সফরে এ চুক্তিতে সিলমোহর পড়তে যাচ্ছে। যা আপাত দৃষ্টিতে দেখতে গেলে সকলেরই মঙ্গলসূচক। আর এখানেই গল্পে মোড় আসছে।

ভারতে বাংলা মানেই তো শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়। একটি বড় সংখ্যার বাঙালি অসমের বরাক উপত্যকায় কাছাড়, করিমগঞ্জ, গোয়ালপাড়া ও ধুবড়িতে অবস্থান করছে, যাদের বর্তমানে অসম সরকারের নয়া নাগরিকপঞ্জী নবীকরণের পাল্লায় পড়ে ভারতীয় নাগরিকত্ব নিয়েই প্রশ্ন উঠে গেছে। সীমান্ত চুক্তির পরে আরেক দল পড়ে থাকে যারা উত্তর-পূর্ব ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে এসব অঞ্চলে বাস করছিল, যাদের পুনর্বাসন রাজ্য সরকারগুলোর কাছে ব্যাপক মাথাব্যথা নিয়ে রয়েছে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এ সমস্যাটি থাকবে। তবে অসম তথা বর্তমান ক্ষমতাসীন ভারত সরকারকেও এটা বুঝতে হবে, বাঙালি মুসলমান মাত্রেই বাংলাদেশ থেকে আসা অনুপ্রবেশকারী নয়। যদিও ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, ভারতের অনুপ্রবেশের সমস্যা কিছুটা হলেও এতে দূর হবে। কিন্তু আদতে যারা বর্তমানে ভারতের নাগরিক কিন্তু আসাম সরকারের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নীতির কারণে আজ দেশচ্যুত হতে বসেছেন, তাদের পায়ের তলার মাটি যেন দুর্বল হয়ে না যায়। এর বেশি বলা হয়তো এখনই সমীচীন নয়। তবুও ঘরপোড়া গরুর সিঁদুরে মেঘ দেখার প্রতিক্রিয়া তো মাথায় রেখেই চলতে হবে।

তিস্তা পানির বৃত্তান্ত
এ সমস্যা সার্বজনীন। নদীর প্রাথমিক গতিপথে যারাই অবস্থিত তারা সেই নদীর জলের সবটুকু সুবিধা চেটেপুটে নিতে চাইবেই। আর তার ফলে গতিপথের নীচে যারা রয়েছে তাদের হাতে শুধুমাত্র পেন্সিল থেকে যায়। কাবেরী জলবিবাদ, সিন্ধু জলচুক্তি, ব্রহ্মপুত্র নিয়ে ভারত ও চীনের সমস্যা আর তিস্তা নদীর জলবণ্টন সমস্যা। প্রাদেশিক এবং প্রান্তিক রাজনীতিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে এ বিষয়ে। এ যেন যার কাছে কলের চাবি সেই রাজা। বাকিগুলো নিয়ে এখানে আলোচনা না করে সরাসরি তিস্তা জলবণ্টনে চলে যাওয়া যাক।

তিস্তা নদী ভারতের সিকিম রাজ্য থেকে উৎপত্তি হয়ে উত্তরবঙ্গের ভিতর দিয়ে এসে প্রায় ৪৫ কিমি. বাংলাদেশে বয়ে শেষে যমুনা (বাংলাদেশের ব্রহ্মপুত্র) নদে মিশেছে। ১৯৮৩’র অস্থায়ী ব্যবস্থা অনুযায়ী, ভারতবর্ষ ৩৯ শতাংশ ও বাংলাদেশ ৩৬ শতাংশ জল পাবার কথা। কিন্তু নতুন যে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির জন্য বাংলাদেশ চাপ দিচ্ছে, তাতে সমবণ্টনের কথা বলা হয়েছে। যা আবার রাজনৈতিকভাবে পশ্চিমবঙ্গের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের কাছে আত্মহত্যার সমান হয়ে যাবে। তাই এতদিন ধরে তিনি চুক্তি স্বাক্ষরের পক্ষে মত দিচ্ছেন না। যদিও নরেন্দ্র মোদি এবার মমতা দেবীকে সঙ্গে নিয়েই যাচ্ছেন, যাতে প্রাথমিক দীর্ঘসূত্রিতা পেরিয়ে সম্মতিতে পৌঁছানো যায়। তবুও রাজনৈতিক সমীকরণ ও প্রাদেশিক জলবণ্টনের ইতিহাস অনুযায়ী আমার মতে, এ সমস্যার দ্রুত সমাধান এখনই সম্ভব নয়। কারণ, তিস্তার জলের ভাগ যদি উত্তরবঙ্গে কোনোভাবে কমে যায়, তাহলে কম বর্ষার ক্ষেত্রে দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। তবুও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কোনো না কোনো জায়গায় তো পৌঁছাতেই হবে।

দেখুক পাড়া-পড়শি
এসব সমস্যাগুলো ছাড়াও যেটা মূল সমাধানযোগ্য কাজ সেটি হলো, পারস্পরিক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক। বাংলাদেশের একটা বড় অংশের ধারণা, ভারত দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে বড়দাগিরি করে, ফলে পারস্পরিক সম্পর্ক যতটা সুগম হতে পারত তা অবিশ্বাস ও রাজনৈতিক পালাবদলের কারণে কাঁটা বিছানো হয়ে রয়েছে। ভারতকেও যেমন বিশ্বের দরবারে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কাসহ প্রতিবেশীদের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে, তেমনই বাংলাদেশকেও নিজের দেশের ভিতরের ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে অকারণে ভারত বিরোধিতা বন্ধ করতে হবে। আখেরে এভাবেই হয়তো উভয় দেশের লাভ হবে। বাণিজ্য চুক্তি, গৌহাটি থেকে বাস পরিষেবা, পরিকাঠামোগত ঋণ, বিদ্যুৎ চুক্তি, ভিসা প্রক্রিয়ার সহজিকরণ ও অন্যান্য পরিবহন পরিষেবাগত চুক্তি হয়ত এ দিকেই সঠিক পদক্ষেপ।

প্রধানমন্ত্রী হয়েই নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেছিলেন, প্রতিবেশীদের প্রতি বিশেষ নজর বিদেশনীতির একটি বড় অঙ্গ হয়ে উঠবে। আসন্ন বাংলাদেশ সফর সেই দিকে আমাদের এক পা এগিয়ে নিয়ে যাবে।

শুধুমাত্র সাম্রাজ্যবাদী ও সুবিধাবাদীদের মন্ত্রণা বা অঙ্গুলিহেলনে আমরা একে অপরের থেকে আলাদা হয়ে গেছি। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশের যারাই আমরা বাসিন্দা, তারা তো কোথাও না কোথাও একই। নাড়ির যোগাযোগ কী কলমের দাগ আর কাঁটাতার দিয়ে ছিন্ন করা যায়। কাঁটাতার লিখতে মনে পড়ল, সীমান্তে অনুপ্রবেশকারীদের হত্যাও একটা বড় ইস্যু। যত তাড়াতাড়ি আলোচনার মাধ্যমে ও যৌথ প্রয়াসে এ সমস্যার সমাধান হয় ততই মঙ্গল।

এ সফরের ফলে কূটনীতিক সম্পর্ক যেন জোরদার হয়। আর যারা কূট, যারা বিভেদের নীতি নিয়ে আখের গোছাতে ব্যস্ত, তাদের কালোহাতগুলো যেন দুর্বল হয় এ আশাই করি। জয় ভারত! জয় বাংলাদেশ! 

সৌরাংশু সিংহ: ভারত সরকারের মধ্যপদস্থ কর্মকর্তা

বাংলাদেশ সময়: ০৮৩৬ ঘণ্টা, জুন ০৫, ২০১৫
এসএস/এমজেএফ

** ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী এক নতুন যুগের ভোরে ‍‍| রাসবিহারী দত্ত
** ‘নিশিদিন ভরসা রাখিস ওরে মন হবেই হবে’ | গোপাল বিশ্বাস
** মোদি-মমতার বাংলাদেশ সফর | স্রোতস্বিনী চট্টোপাধ্যায়
** মোদির বাংলাদেশ সফর হোক বিশ্বের দৃষ্টান্ত | নৃপেন চক্রবর্তী
** সফর যেন আমাদের না বদলায় | সরোজ দরবার
** মোদি-মমতার যৌথ সফর | অরুণ চক্রবর্তী
** মোদির বাংলাদেশ সফরে ভারতীয় হিসেবে আশা ‍| অভীক দত্ত
** মোদির বাংলাদেশ সফর: কিছু ভাবনা | পরিচয় পাত্র
** অনেক কিছুই পাওয়ার আশা ‍| ড. অমিতাভ চক্রবর্তী

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।