ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

শিশুশ্রম বাস্তবতা ও আমাদের দায়

মো. গোলাম এহছানুল হাবিব, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০৫ ঘণ্টা, জুন ১২, ২০১৫
শিশুশ্রম বাস্তবতা ও আমাদের দায়

ঢাকা: প্রতিদিন রঙিন সব স্বপ্ন নিয়ে লাখো নিম্নবিত্ত মানুষ ভীড় করেন শহরে। স্বপ্ন পূরণে পরিবার-পরিজন নিয়ে তাদের গ্রাম থেকে শহরে আসা।



এমন স্বপ্নের প্রথম ধাপে পা রেখেই হোঁচট খান সহজ-সরল মানুষগুলো। নিজেদের মাথা গোজানোর ঠাঁই হিসেবে স্থান হয় বস্তির একটি ছোট্ট কুটিরে।

তারপর ব্যস্ত শহরের স্বার্থপরতা বুঝতে বুঝতে ভাঙতে শুরু করে স্বপ্ন। অভাবের জাঁতাকলে পরে দিনমজুরের কাজ করতে হয় স্বামী-স্ত্রী দু’জনকেই। দু’জনের টাকা দিয়েও যখন সংসার চলে না তখন শুরু হয় সংকট।

এ সংকট অর্থনৈতিক। যার সঙ্গে টাকার সম্পর্ক আছে। আর এ টাকার প্রয়োজনেই তখন পরিবারের ছোট শিশুটিকেও বাধ্য করা হয় শ্রমে। শিশুশ্রমিক হিসেবে বেড়ে ওঠার গল্পগুলো প্রায় এরকমই।

বুধবার (১০ জুন) কথা হচ্ছিল এমনই এক শিশুশ্রমিক দীপাবলির (১৬) সঙ্গে (ছদ্ম নাম)। মা আর ছোট দু’টি ভাই নিয়ে সে বাস করে চট্রগ্রামের বউবাজার এলাকার একটি ভাড়া ঘরে। মাসে ভাড়া গুনতে হয় আড়াই হাজার টাকা। মা-বাবার আদিনিবাস কুমিল্লার মুরাদপুরে। তার বাবা-মা একদিন স্বপ্নের চাবির খোঁজে এসেছিলেন বন্দরনগরী চট্রগ্রামে।

তারপর সংসারের নিত্য অভাবের কারণে সন্তান ও পরিবারের চাহিদার কাছে পরাস্ত হয়ে বছর পাঁচেক আগে তাদের রেখে পালিয়ে যান তার বাবা। দীপাবলি তখন তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী।

এরপর সন্তানদের নিত্যপ্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে দীপাবলির মা গৃহকর্মীর কাজ নেন। এ কাজ করে মাসে তার আয় হতো মাত্র ৩৫০০ টাকা। সেই টাকা দিয়ে তিনি সংসার চালাতে পারতেন না। বাধ্য হয়ে মা তার পড়াশোনা বন্ধ করে দেন।

লেখাপড়া আর খেলাধুলার করার বয়সেই দীপাবলিকে একদিন তার মা গৃহকর্মীর কাজে নিয়োজিত করেন। এরপর তার সংগ্রামী জীবনের শুরু। দীপাবলির কাজ শুরু হতো সকাল ৬টায়, আর শেষ হতো রাত ৯টায়। মাসে সে হাতে পেতো মাত্র ৬০০ টাকা। বাড়তি হিসেবে বাড়ির পরিচালিকা তিনবেলা খাবার দিতেন। জামা কাপড়, রান্নাবান্না, তিন মেয়ের স্কুলের খাবার তৈরি, ঘরমোছাসহ প্রচুর  কাজ করতে হতো তাকে। কাজে ভুল হলে নির্যাতন আর অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ তো থাকতই। খাবার যা দিত তাও উচ্ছিষ্ট!

দীপাবলির ইচ্ছে করত চকচকে ডাইনিং টেবিলে বসে ওদের মতো  মাছ, মাংস খেতে। তবে বাস্তবতা হলো, বাড়ির সবার খাওয়া হয়ে গেলে দীপাবলি খেতে বসত। তাকে খাবার দেওয়া হতো মেঝেতে, তার জন্য প্লেটটিও ছিলো আলাদা। অবশ্য দীপাবলি প্রতিবাদ করেনি কখনো। বরং প্রতিনিয়ত সহ্য করেছে অসহ্য যন্ত্রণা। এভাবেই কেটে যায় তার কয়েকটি বছর। শিশু থেকে সে কৈশোরে পা দেয়। শরীরে আসে পরিবর্তন।

এর মধ্যে হঠাৎ একদিন গৃহকত্রীর স্বামী দুবাই থেকে চলে আসেন। দীপাবলি সারাদিন কাজ করে। গৃহকত্রীর স্বামী তাকে নানা ছুতায় কাছে ডাকেন। খারাপ ইঙ্গিত করেন। টাকার চকচকে নোট দেখিয়ে আদর করতে চান...!

এরপর আর কথা বলতে চায়নি দীপাবলি। কাঁদতে কাঁদতে সে জানায়, চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি!

তুমি যাদের বাসায় কাজ করতে, তার পরিচয় বলবে? এ প্রশ্নে দীবালির উত্তর, ভাই, ওরা ওনেক বড়লোক। আমি বলতে চাই না।

এখন ওয়ার্ল্ড ভিশনের সহায়তায় টেইলারিংয়ের ওপর প্রশিক্ষণ নিচ্ছে দীপাবলি। সংস্থাটি সহযোগিতা করে একটি সেলাইমেশিন দিলে নিজেই বস্তিতে শেলাইয়ের কাজ করবে জানিয়ে বলল, আমি আর আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি না। আমার ছোট দু’ভাইকে লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করতে চাই।

শুধু মেয়ে শিশু শ্রমিকদের ক্ষেত্রেই যে এমন ঘটে তা নয়। ছেলে শিশু শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন ধরনের শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। গেল শীতে রংপুর বাস টার্মিনালে কথা হয় মোরসালিনের সঙ্গে। প্যারালাইজড বাবার সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম মোরসালিন। কাজ করত মোটর গ্যারেজে। মোটরের মেশিন খোলা আর লাগানোর কাজ করতে হতো তাকে। কাজের সামান্য ভুলের কারণে কয়েকবার মালিক হাতুড়ি দিয়ে তার হাতের আঙুল থেঁতলে দেন। দীর্ঘদিনের চিকিৎসা আঙুল ঠিক হয় তার। কিন্তু রাতের বেলা গ্যারেজের হেডমিস্ত্রী জোর করে তার সঙ্গে যা করত, তার ক্ষত এখনো সে কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিশুশ্রমিক আছে। শিশুদের শ্রমে জড়িয়ে পড়ার সঙ্গে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, অসেচতনতা এবং দারিদ্রতার সম্পর্কটি গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। শিশুশ্রম একপ্রকার বাধ্যশ্রম। এটা চাপিয়ে দেওয়া দাসত্ব।

আইএলও’র রিপোর্ট অনুযায়ী, সমগ্র বিশ্বে বর্তমানে ৫-১৭ বছর বয়সী ১শ’ ৬৮ মিলিয়ন শিশুশ্রমিক আছে। এর মধ্যে ৮৫ মিলিয়ন শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে জড়িত। আর এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় আছে ৭৮ মিলিয়ন শিশুশ্রমিক।

আইএলও’র ২০০৬ সালের জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৫-১৭ বছর বয়সী ৭.৪ মিলিয়ন শিশুশ্রমিক আছে। এর মধ্যে ১.৩ মিলিয়ন শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে এবং গৃহকর্মী হিসেবে কর্মরত প্রায় ৪২ হাজার শিশু।

এমআইসিএস (মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে) ২০০৭ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, ৫-১৪ বছর বয়সী শিশু শ্রমিকের হার জাতীয়ভাবে ১২.৮ শতাংশ। বস্তি এলাকায় এ হার ১৯.১ শতাংশ। বিবিএস’র ২০০২-২০০৩ সালের জরিপ অনুযায়ী, ২৮.৬ শতাংশ শিশু পারিশ্রমিকপ্রাপ্ত দিনমজুর। ১৪ শতাংশ শিশু বিক্রয় কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। ২৫ শতাংশ শিশু যানবাহনের কাজের সঙ্গে জড়িত। এভাবে শিশুরা প্রায় ৩৮ ধরণের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে থাকে, যা সরকারকর্তৃক স্বীকৃত। এসব কাজের মধ্যে রয়েছে, কেমিক্যাল ফ্যাক্টরির কাজ, বিড়ি সিগারেট বা তামাকজাত পণ্যের কাজ, জাহাজ ভাঙার কাজ, যানবাহনের কাজ।

বাংলাদেশে এগিয়ে চলছে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে। কিন্তু মাথাপিছু আয় বাড়াটা একটি গড় হিসাব। সে অনুযায়ী দেশের ২০ শতাংশ মানুষের আয় ৮০ শতাংশ মানুষের আয়ের সমান। সীমাহীন আয়বৈষম্য ও জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধি শ্রমজীবী সাধারণ মানুষদের চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। আর এ থেকে মুক্তির জন্য দরিদ্র পরিবারের বাবা-মা তার সন্তানকে শিশুশ্রমে ঠেলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন একশ্রেণির লোভী মালিক, যারা খুব অল্প টাকায় শিশু শ্রমিকদের কাজে নিচ্ছেন। আর এ ছোট্ট শিশুটিকে দিয়ে তারা করিয়ে নিচ্ছেন একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের সমান কাজ।

বিবিএস’র ২০০২-২০০৩ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী, শিশু শ্রমিকরা সপ্তাহে গড়ে প্রায় ২৮ ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় ধরে কাজ করে। আর তাদের সাপ্তাহিক আয় মাত্র ২শ’ ২২ টাকা ।  

যখনই কোনো শিশু বাধ্যশ্রমে যুক্ত হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে সে বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ছে। খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। পাশাপাশি ওই শিশুর মৌলিক অধিকারও দলিত হচ্ছে। শিশু শ্রমিকরা যে পরিবেশে কাজ করছে তার মানও যথেষ্ট উন্নত নয়। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন তো আছেই। সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে যৌন নির্যাতনের মতো বিষয়। গৃহকর্মীর কাজ করা প্রতি চার নারীশিশুর মধ্যে একজন একাধিকবার যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

বাংলাদেশ শিশুশ্রম নিরসনে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। শিশু আইন-২০১৩, জাতীয় শিশুনীতি-২০১১, জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতিমালা-২০১০, শিশুশ্রম নিরসনে গৃহীত জাতীয় পরিকল্পনা (২০১২-২০১৫), শ্রম আইন-২০১৩, গৃহকর্মীদের সুরক্ষা ও উন্নয়নের জন্য গৃহীত নীতিমালা (২০১০-খসড়া), জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০, ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ২০১১-২০১৫ এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এসব কারণে বাংলাদেশে শিশুশ্রম ধীরগতিতে হলেও কমছে। Household Income and Expenditure Survey (HIES, 2005, and 2010) পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, দেশে গত পাঁচ বছর শিশুশ্রম কমে দাঁড়িয়েছে ৩.২ মিলিয়নে।

আমরা নির্দিষ্ট করে কোনো এলাকাকে শিশুশ্রম মুক্ত বলতে পারব না। সার্বিকভাবে শিশুশ্রম হয়তো নির্মূল করাও সম্ভব নয়। এসব আইন ও পলিসির সুষ্ঠু বাস্তবায়ন করলে এর তীব্রতা অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব। এজন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

শিশুশ্রম বন্ধে আমাদের সুপারিশ হলো- ২০১৩ সালের শিশু আইনের দ্রুত বাস্তবায়ন। ওই আইনানুযায়ী প্রতিটি উপজেলা ও জেলায় একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রবেশনারি অফিসার নিয়োগ বা যতদিন পর্যন্ত এমন কাইকে দায়িত্ব না দেওয়া হয়, ততদিন পর্যন্ত অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে কোনো প্রথমশ্রেণির কর্মকর্তাকে শিশু সুরক্ষা নিশ্চিতের জন্য তত্ত্বাবধায়ক করা। প্রতিটি পুলিশ স্টেশনে শিশু বান্ধব ডেস্ক স্থাপন।

জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে শিশু সুরক্ষা বিষয়ক বোর্ড গঠন। শিশু বান্ধব কোর্ট স্থাপন। গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিমালা-২০১০ এর প্রয়োজনীয় সংশোধন, দ্রুত চূড়ান্তকরন ও বাস্তবায়ন। সরকার কর্তৃক অনুমোদিত ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমের তালিকায় ময়লা সংগ্রহ ও গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশুশ্রমকে অর্ন্তভুক্তকরণ। শিশুশ্রমের ক্ষেত্রে ন্যূনতম বয়সসীমা সংক্রান্ত আইএলও সনদ ১৩৮ ও গৃহকর্মীদের জন্য উপযুক্ত কর্মপরিবেশ সংক্রান্ত সনদ ১৮৯ অনুস্বাক্ষরকরণ। জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতিমালা-২০১০ অনুযায়ী শিশুশ্রম বন্ধে নিয়মিত পরীবিক্ষণের ব্যবস্থা করা।

মিডিয়ায় নিয়মিত শিশুশ্রম বিষয়ক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ ও শিশুদের জন্য আলাদা অনুষ্ঠান বরাদ্দ করা। নির্যাতনের শিকার শিশুদের নাম ও ছবি প্রকাশ না করে নির্যাতনকারীর বিস্তারিত পরিচয় ও ছবি প্রকাশ করা। বিভিন্ন কারখানার মালিককে শ্রমআইন মানতে বাধ্য করা ও শিশুশ্রমিক নিয়োগে নিরুৎসাহিত করা। জন্মসনদ প্রদানের সময় কেউ যেন কৌশলে বয়স বাড়িয়ে না নিতে পারে সে বিষয়ে স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের সক্রিয় ভূমিকা পালন করা। শিশুশ্রম বিষয়ে তৃণমূল পর্যায়ে সচেতনতামূলক প্রচারণার মাধ্যমে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।

মো. গোলাম এহছানুল হাবিব, রিজিওনাল এডভোকেসি, কমিউনিকেশন ও শিশু সুরক্ষা সমন্বয়কারী, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ সময়: ১৪০৫ ঘণ্টা, জুন ১২, ২০১৬
আরএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।