ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

মাহাথির-লি কুয়ান এগিয়ে নিলেন দেশকে, বঙ্গবন্ধুকে থামালো ঘাতকের বুলেট | রফিকুল বাহার

... | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩৩৬ ঘণ্টা, আগস্ট ১৪, ২০১৫
মাহাথির-লি কুয়ান এগিয়ে নিলেন দেশকে, বঙ্গবন্ধুকে থামালো ঘাতকের বুলেট | রফিকুল বাহার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, মাহাথির, লি কুয়ান

চট্টগ্রাম: আমি তখন গ্রামের সরকারি প্রাইমারি স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র। বাড়ি থেকে ৭শ’ গজ দূরে হাঁটা পথেই স্কুলে যেতাম।

সন, তারিখ, সময় কিছুই মনে নেই। বই-খাতা হাতে নিয়ে স্কুলে রওনা হওয়ার আগ মুহূর্তেই দাদা বললেন, শেখ সাহেবসহ তার পরিবারের সবাইকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। রেডিওতে সেই খবর প্রচারিত হচ্ছে। গ্রামের ধানি জমির মেঠো পথ ধরে স্কুলে পৌঁছে জানা গেলো ক্লাশ হবে না। দুরন্ত শিশু মনে তখন আনন্দ। একই পথে যখন বাড়ি ফিরছিলাম তখন মনে একটি প্রশ্নই বার বার উঁকি দিচ্ছিল, কেন এই হত্যাকাণ্ড, কেন এই নৃশংসতা?

আজ ৪০ বছর পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি আমার হৃদয় পটে এভাবেই ভেসে উঠলো। এর বেশি কিছু তখন আমি জানতে পারিনি, বুঝতেও শিখিনি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রাম ছেড়ে যখন চট্টগ্রাম শহরে এসে স্কুলে ভর্তি হলাম তখন নির্মম এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে নানা মিথ্যাচার, অপপ্রচার আর অতিরঞ্জন শুনছিলাম। শিশু থেকে কিশোর, প্রাইমারি স্কুল থেকে হাইস্কুল, কিশোর থেকে যুবক, হাইস্কুল থেকে কলেজ এবং কোনো এক সময়ে বাম ধারার ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর বুঝতে পারলাম বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পেছনে অনেক কারণ। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে পেছনে টানার সুগভীর ষড়যন্ত্র। আর এই ষড়যন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করতেই বঙ্গবন্ধু, তার ছেলে, আত্মীয়-স্বজনদের নিয়েই অপপ্রচার চলছিল সর্বত্র।

articleবাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পেছনে স্থপতি কে ছিলেন, কী তার ভূমিকা ছিল সেই সব জানবার, বুঝবার আগেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে প্রাণ দিলেন সেনাবাহিনীর উচ্ছৃঙ্খল কিছু কর্মকর্তার হাতে। স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে জানতে-বুঝতে পেরেছি তার অকাল প্রয়াণের পর। তাকে খুঁজে পাওয়ার জন্য তার ব্যক্তিত্বকে উপলদ্ধি করবার জন্য আমার মতো বয়সের অনেককেই এখনো বার বার শুনতে হয় ৭ই মার্চের সেই অসাধারণ কালজয়ী ভাষণ। সেই দিনের ভাষণের মেজাজ এতটাই উদ্বীপ্ত ছিল যে আজ এতো বছর পরও সে ভাষণ শুনে গা শিউরে উঠে আমার মতো অনেকের।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এতোটা শোকাবহ যদি না হতো তাহলে কী হতো এই দেশে এই সমাজে? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এখনও বেঁচে থাকলে তার বয়স হতো ৯৫ বছর। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন অগ্রগতি কোন ধাপে, কোন পর্যায়ে কাকে পেছনে ফেলে কতটা গতিশীল হতো সেটাই এখন আমরা দেখতাম। এশিয়ার উন্নত দেশ হিসাবে পরিচিতি পাওয়া মালয়েশিয়াকে বলা হয় মাহাথিরের মালয়েশিয়া। এখন তার বয়স ৯১ বছর। শক্ত, সামর্থ্য এক প্রাণপুরুষ মাহাথির মোহাম্মদ, মালয়েশিয়ার চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী। আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার তিনি। টানা ২২ বছর দেশ শাসন করেছেন। তার চেয়েও বর্ণাঢ্য এক জীবন প্রতিবেশী সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান ইউ-এর। তিনিও শক্ত হাতে সৃজনশীলতা আর প্রজ্ঞার সম্মিলন ঘটিয়েছেন রাষ্ট্র পরিচালনায়। ১৯৫৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু বিভিন্ন সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। স্বাধীন সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠাতা জনক তিনি। জেনে আর ভেবে যে কেউই আনন্দিত হবেন যে সিঙ্গাপুরের এখন বার্ষিক গড় আয় ৬২,৪০০ মার্কিন ডলার যা বিশ্বের ২২৮টি দেশের তালিকায় সপ্তম। আর মালয়েশিয়ার ১৭,৫০০ মার্কিন ডলার, বিশ্বে তাদের অবস্থান ৭৯ নম্বরে। অর্থাৎ এরা একেকজন মানুষ একেকটি রাষ্ট্রের আর্থিক ও সামাজিক জীবনমানের সীমানা এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন যা তাদের পৃথিবীতে দিয়েছে গৌরব আর অহংকারের অন্য এক মাত্রা।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরে আমরা এখনও আমাদের সম্পদ, সামর্থ, সৃজনশীলতা, মেধা, প্রজ্ঞাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের কাছে পৌঁছাতে পারিনি। মাহাথির-লি কুয়ানের কথা মনে হলে আমার নিজেরও মনে হয় আমাদের একজন বঙ্গবন্ধুর বেঁচে থাকা অনেক বেশি জরুরি ছিল। মাহাথিরের জন্ম ১৯২৫ সালের ১০ জুলাই। ১৯২৩ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেছিলেন লি কুয়ান। সম্প্রতি তিনি মারা গেছেন ৯১ বছর বয়সে। এখনও বেঁচে আছেন মাহাথির, বয়স তার ৯০। আর আমাদের বঙ্গবন্ধুর জন্ম ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। একই দশকে অর্থাৎ সমসাময়িক নেতাই ছিলেন তারা তিনজন। মাত্র ৫ বছরের ব্যবধানে তাদের জন্ম। যদি এমন হতো যে মাহাথির কোনো দুর্ঘটনায় অকালে মারা যেতেন কিংবা লি কুয়ানেরও একই পরিণতি হতো তাহলে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর আজ কোন অবস্থানে থাকতো!

বিশাল শরীর যেমন ছিল বঙ্গবন্ধুর তেমনি দৃষ্টিভঙ্গি, উদারতা, মানবিকতা, জনগণের প্রতি মমত্ববোধ তার চেয়েও বিশাল। এসব কথা বিভিন্নজনের লেখা থেকে যেমন জানা যায় তেমনি তার সঙ্গে যারা ঘনিষ্ঠ ছিলেন তাদের স্মৃতিচারণ থেকেও। আমি যখন লি কুয়ান কিংবা মাহাথিরের সাফল্যের কথা চিন্তা করি তখন ভাবনায় আসে একজন বঙ্গবন্ধুর কথাও। তার দূরদৃষ্টি এতো প্রখর ছিল যে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে তিনি সরাসরি দেশে ফিরেননি। লন্ডন হয়ে দেশে ফিরে আসার আগে পৃথিবীর সবাইকে জানিয়ে দিলেন আমরা আছি বাঙালিরা। আমরা বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছি।

আমার যুবক মন খুব সহজেই একটি প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যায় সেটি হলো অসাধারণ প্রতিভাবান কালজয়ী মানুষের জন্ম যেখানেই হোক নিজের ইচ্ছাশক্তি তাকে নিয়ে যায় সাফল্যের চূড়ায়। ফরিদপুরের (বর্তমানে গোপালগঞ্জ) টুঙ্গিপাড়ার মতো অজপাড়াগায়ের সাধারণ এক পরিবারে জন্ম নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে গেলেন স্বাধীন বাংলাদেশের ‘জাতির পিতা’ ও ‘বঙ্গবন্ধু’। মাত্র ৫৫ বছর বয়সে আততায়ীর বুলেটে প্রাণ দিয়েও তিনি আজ অমর ও অসাধারণ এক ক্ষমতাশালী এক মানুষে পরিণত হয়েছেন। এই বুলেট যদি তার বুকে না লাগতো, যদি তিনি বেঁচে থাকতেন তাহলে ভাবুন আমার এই প্রিয় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা কোন উচ্চতায় থাকতো। আমরা বিশ্বের ২২৮টি দেশের মধ্যে অর্থনৈতিকভাবে ১৯৩ নম্বরে অবস্থান করছি। বার্ষিক মাথাপিছু আয় ২,১০০ মার্কিন ডলার। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে বাংলাদেশের অবস্থান যে এর চেয়ে অনেক ভালো হতো সে বিষয়ে কেউ সন্দেহ করবেন বলে আমি মনে করি না। কারণ শুরুর দিকে যখন মাহাথির আর লি কুয়ান তাদের দেশের হাল ধরেন তখন তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল আমাদের দেশের মতোই।

সীমিত দোষ আর অসংখ্য গুণ কিংবা অসংখ্য দোষ আর অসামান্য সৃজনশীলতা মিলেই একজন মানুষ। তো একজন মানুষের স্বপ্ন ও ব্যক্তিত্ব যে তাকে অন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করতে পারে সেটি বঙ্গবন্ধুর জীবন কাহিনীতেই বোঝা যায়। ৫৫ বছরের জীবনে তিনি একটি দেশের স্বাধীনতার ‘সুপারস্টার’। মাহাথির ও লি কুয়ানের মতোই যদি জীবন পেতেন তাহলে না কত কীর্তি গড়তেন বঙ্গবন্ধু। আর এসব কীর্তির সুবিধাভোগী হতাম আমরা স্বাধীন দেশের বাঙালিরা। সিঙ্গাপুরের মতোই অসাধারণ সুন্দর এক নগররাষ্ট্র হতো আমাদের এই প্রিয় বাংলাদেশ।

রফিকুল বাহার, নির্বাহী সম্পাদক, সুপ্রভাত বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম

বাংলাদেশ সময়: ২১৩৫ ঘণ্টা, আগস্ট ১৪, ২০১৫
আইএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।