ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

বিলিভ ইট অর নট

আপনার সামনেই আপনার শিশু সেক্সুয়াল অ্যাবিউজড!

এম. এ. বাকী বিল্লাহ্ হৃদয় | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮১২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৫
আপনার সামনেই আপনার শিশু সেক্সুয়াল অ্যাবিউজড!

পরিণীতা ১০ বছর বয়সী শিশু। অনেক চঞ্চল প্রকৃতির মেয়ে সে।

তার দূরন্তপনায় মেতে থাকতো সমস্ত বাড়ি। হঠাৎ করেই সে যেন বদলে যায়। তার ব্যবহার অস্বাভাবিক মনে হয়। প্রায় সময়ই রুমের দরজা বন্ধ করে একা একা বসে থাকে সে। কারো সঙ্গে তেমন একটা কথা বলে না।

পরে জানা যায়, পরিণীতা সেক্সুয়াল অ্যাবিউজড বা যৌন নির্যাতনের শিকার।

৮ বছরের ছেলে দীপ্ত। সে তাদের কাজের ছেলেটিকে ভয় পায়। তার কাছে যেতে চায় না। তারপরেও তাকে জোর করে কাজের ছেলেটির কাছেই রাখা হয়। দীপ্ত তার পরিবারকে জানায়, কাজের ছেলেটি তাকে প্রতিদিন ব্যথা দেয়। কিন্তু বিস্তারিত কিছুই বলতে পারে না সে। তাই, তার কথা কেউ গুরুত্ব দিয়ে শোনে না। এভাবেই সে প্রায় প্রতিদিন কাজের ছেলে দিয়ে সেক্সুয়াল অ্যাবিউজের (যৌন নির্যাতন) শিকার হয়।

মাহিমের বয়স ৭ বছর। ২১/২২ বছর বয়সী খালাতো ভাই সিক্রেট মজার খেলা বলে তাকে সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ করে। তার অনেক কষ্ট হয়। ব্যথা পায় খুব। কিন্তু সে বুঝতে পারে না যে, তার সঙ্গে কী রকম নোংরামি করা হচ্ছে।

আধুনিকতার মোড়কে প্রতিনিয়তচাইল্ড সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ (যৌন নির্যাতন) বৃদ্ধি পাচ্ছে। চাইল্ড সেক্সুয়াল অ্যাবিউজকে  (CSA) বলা যায়- The imposition of sexual acts, or acts with sexual overtones, by one or more persons on a child (under 18)- Save the Children, CSA Draft Policy.

শিশুর গোপন অঙ্গে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত স্পর্শ, শিশুর সঙ্গে তার বয়স অনুপযোগী সেক্সুয়াল (যৌনতা) বিষয় নিয়ে আলোচনা করা, শিশুর নগ্নছবি তোলা বা তার সামনে নগ্ন হওয়া, শিশুকে পর্নোগ্রাফি দেখানো, তাকে ধর্ষণ করা বা ধর্ষণের চেষ্টা করা, এ সব কিছুই চাইল্ড সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ (sexual Abuse)।

আর এই চাইল্ড সেক্সুয়াল অ্যাবিউজের মাত্রা ক্রমান্বয়ে ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী আমরা জানি, চাইল্ড বা শিশু বলতে ১৮ বছর বয়সের নিচে সব মানব সন্তানকে বোঝায়। আর এই সময়টি তাদের জন্য খুব সেনসেটিভ।

বাংলাদেশ মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০০১-১৩ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরের কম বয়সী ২৮৬ জন শিশু সেক্সুয়াল অ্যাবিউজের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ৯৯ ভাগ শিশু-ধর্ষণের শিকার।

মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর একটি জরিপে দেখা যায়, গত চার মাসে (জানুয়ারি-এপ্রিল) দেশে শুধু ধর্ষণের ঘটনাই ঘটেছে ১৫৮টি। এর মধ্যে শিশুর সংখ্যা ৯৩ ও নারীর সংখ্যা ৬১ জন। বাকি ৪ জনের বয়স নির্ধারণ করা যায়নি।

৬৭টি শিশু সংগঠনের মোর্চা বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন মাসে (এপ্রিল-জুন) সারাদেশে হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, রাজনৈতিক সহিংসতা, গ্রেফতার, আত্মহত্যা, স্কুলে শারীরিক নির্যাতন, শিশুবিবাহসহ বিভিন্নভাবে নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হয়েছে ১ হাজার ২৯৯ জন শিশু।  

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) হিসাব মতে, প্রতিবছর ৪০ মিলিয়ন শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

‘বিলিভ ইট অর নট’ (বিশ্বাস করুন বা নাই করুন) চোখের সামনেই আপনার শিশু সেক্সুয়াল অ্যাবিউজের শিকার হচ্ছে। কিন্তু আপনি টের পাচ্ছেন না।

জামাই-বউ খেলা, কানামাছি খেলা, সিক্রেট ব্যাপার বলে নোংরামি করা, ভয় দেখানো, বাজে উদ্দেশ্যে আদর বা ভালোবাসার কথা বলাসহ ভদ্রতার লেবাসে চাইল্ড সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ করা হচ্ছে অতি সতর্কতার সঙ্গে, নানা উপায়ে।

এক্ষেত্রে অভিভাবক হিসেবে আপনার সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।   সেই সঙ্গে আপনার শিশুর সবচেয়ে ভালো বন্ধু হন; যেন সে তার সব কথা আপনার সঙ্গে নিঃসঙ্কোচে ভাগাভাগি করতে পারে।

আপনার শিশু কার কার সঙ্গে মেশে, সে সর্ম্পকে সজাগ থাকুন। যৌন নিপীড়ককে আপনার শিশু চিনতে না পারলেও একটু ভালোভাবে খেয়াল করলে আপনি ঠিকই চিনতে পারবেন। সে যতই আপনার কাছের কেউ হোক না কেন, তার কাছ থেকে আপনার শিশুকে নিরাপদ দূরত্বে রাখুন।

আপনার শিশুকে বোঝান, কোনটি ‘ভালো আদর’ আর কোনটি ‘মন্দ আদর’। কোন ধরনের মানুষ থেকে দূরে থাকতে হবে অর্থাৎ কাদের সঙ্গে কখনো মেশা যাবে না, সে বিষয়ে আপনার শিশুকে জানান। তার শরীরের গোপন জায়গাগুলো সম্পর্কে তাকে সতর্ক করুন। আপনার সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতা অনেকাংশেই আপনার শিশুকে সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ থেকে রক্ষা করবে নিঃসন্দেহে।

চাইল্ড সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ বা শিশু যৌন নির্যাতন যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, সে হারে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্তা নেওয়া হচ্ছে না।

বাংলাদেশ সরকার ও ডেনমার্ক সরকারের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রামের (Multi-Sectoral Programme) আওতায় নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ ন্যাশনাল হেল্পলাইন (National Help Centre) সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ২০১২ সালে।

দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে যে কোনো সময় ১০৯২১ নম্বরে বিনামূল্যে ফোন করে সাহায্য পেতে পারেন নির্যাতনের শিকার যে কোনো নারী ও শিশু।

কিন্তু বাজেট ও জনবল স্বল্পতা এবং প্রদত্ত শিশু সেবা সম্পর্কে প্রচারের অভাবসহ বিভিন্ন কারণে এক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরেও চাইল্ড সেক্সুয়াল অ্যাবিউজের ক্ষেত্রে এসব উদ্যোগের চেয়েও বেশি কার্যকরী হচ্ছে ‘সচেতনতা’ সৃষ্টি করা।

অপ্রিয় হলেও সত্যি যে, আমাদের শিশু সেক্সুয়াল অ্যাবিউজের শিকার হওয়ার ক্ষেত্রে আমরাও অনেকটা এর জন্য দায়ী। যেমন, শিশুর সামনে তাদের অনুপযোগী চলচিত্র, নাটক, বিজ্ঞাপন বা মিউজক ভিডিও দেখা, অশালীন কথাবার্তা বলা, তাদের বাসায় একা রেখে বাইরে যাওয়া অথবা তাদের বাইরে একা যেতে দেওয়া, যার-তার সঙ্গে মিশতে দেওয়া, তাদের একদম গুরুত্ব না দেওয়াসহ নানাভাবে আমরা দায়ী হচ্ছি।

কাজেই সময় থাকতে এসব ব্যাপারে দায়িত্বশীল না হলে পরবর্তীতে অপূরণীয় ক্ষতি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। শিশুদের সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার জন্য একটি সুন্দর পৃথিবীর প্রয়োজন অনেক বেশি। তাদের তেমন একটি পৃথিবী উপহার দেওয়ার দায়িত্ব আমার, আপনার, সবার।

আসুন, নিজে সচেতন হই এবং সচেতনতার সৃষ্টি করি। আর একটি শিশুও যেন সেক্সুয়াল অ্যাবিউজের শিকার না হয়, তার জন্য পরিবেশ তৈরি করি!

লেখক: সংগঠক, কলামিস্ট ও গল্পকার
[email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৮১১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৫
এবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।