বছর দশেক আগের ঘটনা। ড্রয়িং রুমে বসে অস্ট্রেলিয়ান বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছি, সামনে টেলিভিশন চলছে।
তিন সপ্তাহ আগে তাসমানিয়া রাজ্যের রাজধানী হোবার্টে একটা কনফারেন্সে গিয়েছিলাম। দ্বিতীয় দিনে ডারওয়েন্ট নদীর পাড়ে বিশাল হলরুমে কনফারেন্স ডিনার, হাজারখানেক অতিথির সমাগম। পুরো অস্ট্রেলিয়া থেকেই গবেষকরা এসেছেন, অন্য দেশ থেকেও। আমি বাংলাদেশের শুনেই উল্টোদিকে বসা অস্ট্রেলিয়ান ভদ্রলোক বলে উঠলেন, ’বাংলাদেশ তো এখন মধ্যম আয়ের দেশ’। পরের কয়েক মিনিট আলোচনাটা বাংলাদেশকে ঘিরেই চলতে থাকে। সেই সত্তর দশকের ’ষড়যন্ত্রমূলক’ তলাবিহীন ঝুড়ি, নব্বই দশকের তুলনামূলক অচেনা বাংলাদেশ এখন বিশ্বব্যাপী এক বিস্ময়ের নাম। উন্নয়ন নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করা মানুষের কপালে ভাঁজ তোলা, রাজনীতির এক ম্যাজিক রিয়েলিজম।
বাংলাদেশের এই আকস্মিক ঘুরে দাঁড়ানোর পেছনে রহস্য কী? একটি দেশের উন্নয়ন হয়তো কোন সরকারের একক কৃতিত্ব নয়, এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা তার ব্যতিক্রম দেখছি। এখানে তাই উন্নয়নের ধারাবাহিকতার চেয়ে ’শার্প রাইজ’ কথাটা বেশী প্রযোজ্য। আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যুগপৎ ভৌগলিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলেছিলেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা একটি স্বাধীন ভূখণ্ড পেয়েছিলাম, কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তির সূচনালগ্নেই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে সেই উন্নয়ন যাত্রাকে ব্যাহত করা হয়। তারপর থেকে বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রা আর কাঙ্খিত গতিলাভ করেনি, বরং ঢিমে তালে এগিয়েছে।
![Sheikh_Hasina_1 Sheikh_Hasina_1](files/September2015/September28/Sheikh_Hasina_1_741766057.jpg)
গত ছয় বছর ধরে বাংলাদেশের এক ভিন্ন যাত্রা শুরু হয়েছে। উন্নয়নের সব সূচকেই তরতরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। দেশে চলছে উন্নয়নের এক মহাযজ্ঞ। আর এই মহাযজ্ঞের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধুর কন্যা, বাংলার আপামর জনসাধারণের নেত্রী, দেশব্যাপী বিশাল এক কর্মীবাহিনীর আপা, জননেত্রী শেখ হাসিনা। যোগ্য সন্তান হিসেবে, নেত্রী হিসেবে জাতির জনকের আরাধ্য কাজ তিনি নিরলসভাবে, দক্ষতার সাথে করে যাচ্ছেন। জাতিসংঘের প্রতি সেপ্টেম্বরের অধিবেশনে আমরা নতুন করে তার প্রমাণ পাই। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি স্বাস্থ্য-শিক্ষা-নারী উন্নয়নসহ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বের অনেক দেশের কাছেই অনুকরণীয়, অনন্য এক মডেল। একজন প্রবাসী বাঙালি হিসেবে বাংলাদেশের এই অর্জন আমাদের খুব গর্বিত করে।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ শাখার এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে আমারও সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর নেতৃত্বে সান্নিধ্যে আসার, খুব কাছে থেকে তাঁকে ’আপা’ বলে ডাকার। কত দুপুর-বিকেল যে তখন কেটেছে ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরে, বঙ্গবন্ধু ভবনে। দুপুরে মলিন মুখ দেখে বলেছেন, কিরে খাসনি? পরের দৃশ্যে খাবার টেবিলে বসে সব্জি-মাছ-ডাল দিয়ে ভাত খাচ্ছি। এ সময়ে তাঁকে কেবল রাজনীতির নেত্রী নয়, মনে হত মা। প্রতিবছর পনেরো আগস্ট, জাতীয় শোক দিবসে বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে সন্ধানীর কর্মীরা রক্ত সংগ্রহ করত, তারা দুপুরে খেলো কী না তা নিয়েও তাঁর চিন্তা। কেবল রাজনীতি নয়, প্রতিটি নেতা-কর্মীর ব্যক্তিগত খোঁজখবর নেওয়াও ছিল তার প্রতিদিনকার কাজ। সংগঠনের কেউ প্রেম করছে কিন্তু বিয়েতে সমস্যা হচ্ছে, সে সময়েও তিনি হাজির। রাজনীতির সব পরিচয় ছাপিয়ে শেখ হাসিনা যেন তখন আপন বড় বোন। আমার এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে, তিরানব্বই সালে মিন্টো রোডের বিরোধী দলীয় নেত্রীর বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে বলছেন, ’কীরে অমুক ভাই মেয়ে দিতে চাইছেন না? তুই সোজা বিয়ে করে বউ নিয়ে আমার এখানে উঠবি’। এখন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েও শুনেছি শত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি নিয়মিতই নেতা-কর্মীদের খোঁজখবর রাখেন।
![Sheikh_Hasina_2 Sheikh_Hasina_2](files/September2015/September28/Sheikh_Hasina_2_600375638.jpg)
একজন মহান নেতার জন্মদিন মানেই স্রেফ মোমবাতি জ্বালিয়ে কেক কাটা নয়। কিংবা ব্যক্তিগত স্মৃতির জাবর কাটা নয়। আপাদমস্তক রাজনীতিতে মোড়া মানুষটার জন্মদিনের আলোচনায়-উৎসবেও তাই অনিবার্যভাবেই উঠে আসে রাজনীতি। শৈশব-কৈশোর থেকেই রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বড় হয়েছেন, ছাত্রজীবনে সক্রিয়ভাবে রাজনীতি করেছেন, তারপরেও স্বপ্নেও বোধ হয় কখনো ভাবেননি এভাবে রাজনীতিতে জড়িয়ে যাবেন। অথচ পচাত্তরের পনেরোই আগস্টের নির্মম ঘটনাটি তাঁর জীবনটাকে আমূল বদলে দিয়েছে। ঘাতকের বুলেটের নির্মম আঘাতে একরাতেই বাবা-মা, ভাই-ভাবীসহ আত্মীয়-স্বজনদের হারিয়ে বেদনায় ম্লান হয়ে গেছেন। কিন্তু সেখানেই সবকিছু শেষ হয়ে যেতে দেননি। বরং শোককে শক্তিতে পরিণত করে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। একমাত্র বোন শেখ রেহানাসহ প্রবাসে দুঃসহ জীবন কাটিয়ে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের মত বৃহৎ সংগঠনের দায়িত্ব নিয়েছেন। সময়ের পরিক্রমায় নিজেকে পরিণত রাজনীতিবিদ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। বাকীটা আজ চমৎকার ইতিহাস। বাংলাদেশের জননেত্রী থেকে শেখ হাসিনা আজ বিশ্বনেত্রী, দক্ষ রাষ্ট্রনায়ক।
জন্মদিন মানেই বয়সের আরো একটি সিঁড়ি ভাঙ্গা। পার্থিব নিয়মে শেখ হাসিনারও বয়স বাড়ছে। কিন্তু সেই তুলনায় বার্ধক্য তাঁকে স্পর্শ করতে পারছে না। বরং তিনি এখনো যে কোন বয়সের উচ্ছ্বল, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে মগ্ন এক তরুণী। জ্ঞাত সব অর্থনীতির সূত্র ভেঙেই এগোচ্ছে বাংলাদেশ। আজকের এই মহতী দিনে সঙ্গত কারণেই আমাদের প্রত্যাশা, অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি বাংলাদেশে দ্রুতগতিতেই সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে।
শেখ হাসিনা বড় লক্ষ্মী মেয়ে। তার নেতৃত্বের ছোঁয়ায় দ্রুত বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সেই সাথে উপরে উঠে চলেছে আমাদের প্রত্যাশার পারদ। আমরা চাই কেবল বিত্তে নয়, চিত্তেও দ্রুত ধনী হয়ে উঠুক আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। প্রিয় শেখ হাসিনার জন্মদিনে অনেক অনেক শুভেচ্ছা। দেশ ও দশের স্বার্থে আপনার জীবন দীর্ঘতর হোক। শুভ জন্মদিন আপা।
ডঃ আবুল হাসনাৎ মিল্টন: কবি ও চিকিৎসক, বর্তমানে অস্ট্রেলিয়াস্থ নিউক্যাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত, [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১০১১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১৫
জেডএম/