ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

মুক্তমত

মুক্তিযুদ্ধ ও বাবা’র দীর্ঘশ্বাস || এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪৭ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০১৬
মুক্তিযুদ্ধ ও বাবা’র দীর্ঘশ্বাস || এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান

মুক্তিযুদ্ধ দেখা হয়নি আমার। কারণ আমার জন্ম হয়েছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের এক যুগেরও কিছু পরে।

বই-পুস্তক, নাটক আর চলচ্চিত্রের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনেছি সাংবাদিকতায় আমার শিক্ষাগুরু বাবার মুখে।

আমার সাংবাদিক বাবা শামসুল আলম খান তখন বয়সে কিশোর। মুক্তিযুদ্ধ তাকেও ছুঁয়ে গিয়েছিল।

এখনো মহান স্বাধীনতা দিবসের মাস মার্চ এলেই তার বড় বেশি মনে পড়ে যায় একাত্তরের কথা। সেই মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধ স্মৃতি। বাবার মুখ থেকেই অনেকবার শুনেছি অগ্নিঝরা দিনগুলোর খণ্ড খণ্ড স্মৃতি।

বাবা বলতেন আর এক অদৃশ্য সেলুলয়েডে আমি মনে আঁকতাম মুক্তিযুদ্ধের চিত্রকল্প।

আমার বাবার কাছে মুক্তিযুদ্ধ আবেগঘন স্মৃতি; একটি দীর্ঘশ্বাস। বয়স কম ছিল বলেই মুক্তিযুদ্ধে যেতে পারেননি। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার জন্য ঘর ছেড়েছিলেন। বয়স কম থাকায় তাকে রণাঙ্গনে নেননি তার বীর মুক্তিযোদ্ধা মামা রফিকুল ইসলাম।

কয়েক বছর আগে তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন। হারিয়ে গেছেন দূর আকাশে।

কিশোর মনে স্বাধীনতার তীব্র আকাঙ্খা থেকেই স্বাধীকার রক্ষার আন্দোলনে জীবনবাজী রাখার ইচ্ছা ছিল বাবার। মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজ বাড়ি ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার জোরবাড়িয়া গ্রাম থেকে প্রথমে আশ্রয় নিয়েছিলেন স্থানীয় ইচাইল এলাকার নানার বাড়িতে।

পরে মুক্তিযোদ্ধা, কাদেরিয়া বাহিনীর সক্রিয় সদস্য মামার কাঁধে চড়েই পাশের মুক্তাগাছা উপজেলায় সিংগিলা মাদববাড়ি এলাকায় খালার বাড়ি পর্যন্ত গিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পথে সেই যাত্রাটি বাবার কাছে আজো স্মৃতি। সেই স্মৃতি মনে করতেই ছলছল করে উঠে বাবার চোখ।

বাবার মুখ থেকেই শুনেছি পাকিস্তানি সামরিক জান্তার শোষণ, বঞ্চনা, নির্যাতন ও বর্বরতার দীর্ঘ অধ্যায়ের বাস্তব চিত্র। বাবা বলতেন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক তেজোদীপ্ত ভাষণের পর গ্রামে গঞ্জে মুক্তিযোদ্ধা সংগঠকদের মাধ্যমে প্রস্তুতি চলছিল।

২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ২৭ মার্চ ময়মনসিংহ শহরের খাগডহরে রাতভর যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধের খবর ছড়িয়ে পড়লে এ উপজেলার গ্রামের পর গ্রামে মুক্তিযুদ্ধে যাবার জন্য যুবকদের মাঝে সাড়া পড়ে যায়। বাবার ধণাঢ্য চাচা আব্দুল মান্নান খানের থ্রি-ব্র্যান্ড রেডিও ছিল।

রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতার শোনা তখন যুদ্ধ অবরুদ্ধ মানুষজনের কাজ ছিল। সন্ধ্যার পর পরই স্থানীয় গ্রামের মানুষজন জড়ো হতেন এখানে। মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া না হলেও বাবা ও তার সমবয়সীরা খেলতেন ‘যুদ্ধ। ’ বড়রা যখন দেশের খবর বলতো তখন তিনি মনোযোগ দিয়ে শুনতেন।

ফুলবাড়িয়ার লক্ষীপুর যুদ্ধ স্মৃতির কথাও আজো তার ঝাপসা মনে হয়। পাকিরা ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করেছিল নিরীহ ৪ গ্রামবাসীকে। পুড়িয়ে দিয়েছিল কয়েকশ’ বাড়িঘর। নিরীহ বাঙালিদের যত রক্ত ঝরেছে, আন্দোলন ততই উত্তপ্ত হয়ে উঠে।

বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা আঘাত হেনে ওই সময় অর্ধ শতাধিক শত্রুসেনাকে খতম করে দিয়েছিল। এ যুদ্ধের পর বাবা ও তার বন্ধুরা রণাঙ্গনে ছুটে গিয়েছিলেন। সবার চোখে-মুখে ছিল উচ্ছ্বাস, উত্তেজনা।  

মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনার মাস মার্চ। বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের আহবানও এসেছিল এ মাসেই। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ মুক্তিকামী বাঙালির ভেতর ছড়িয়ে পড়ে।

বঙ্গবন্ধুর ভাষণে তারা উদ্দীপ্ত হন। জেগে উঠে বাঙালি জাতি। হায়েনাদের বিপক্ষে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে শুরু হয় প্রস্তুতি।

স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে স্থান করে নিতে জাতির অবিসংবাদিত নেতা, রাজনীতির মহানায়ক, অমর-অব্যয় কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উচ্চারণ করলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। ’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি....। ’

ত্রিশ লাখ প্রাণের আত্মদান এবং ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর বিজয়ের প্রভাতী সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল শিশিরস্নাত মাটি।

পাকিদের হটিয়ে মুক্তির স্বাদ নিয়েছিল বীর বাঙালি। অর্জিত হয়েছিল চির আকাঙ্খিত স্বাধীনতা। বিশ্ব মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটলো স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের।

স্বাধীনতার প্রতীক মার্চ। শত্রুসেনাদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার মাসও এ মার্চই। মার্চ বাঙালিকে শেখায় প্রতিবাদী হতে। চেতনার অগ্নিমশাল হাতে ঘুরে দাঁড়াতে।

মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তির অযুত ব্যর্থতা আর নানা কারণে ৭১’র পরাজিত শক্তি আবারো স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রে ভয়ঙ্কর থাবা বসিয়েছিল। হয়েছিল রাষ্ট্রক্ষমতার অংশ।

লাল-সবুজের পতাকার বিরোধীতাকারী ওই সামরিক জান্তার বিষবৃক্ষরাই দোর্দন্ড প্রতাপে নিজেদের গাড়িতে উড়িয়েছে লাখো শহীদের রক্তে কেনা পতাকা। বিলম্বে হলেও সেই কলঙ্ক মোচনের পাশাপাশি বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফেরার যুদ্ধ শুরু করেছে।

স্বাধীনতা বিরোধী শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মধ্যে দিয়ে শুরু হয়েছে নতুন যুগের সূচনা। লাল সবুজের পতাকাও যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। নতুন প্রজন্ম দেশকে ভালবাসে।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অন্যদিক দিক ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি। ইতোমধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে বাংলাদেশ। ক্রীড়া, সংস্কৃতি, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বীরদর্পে এগিয়ে যাচ্ছে রয়েল বেঙ্গল টাইগাররা।

মু্ক্তিযুদ্ধের চেতনা হচ্ছে দেশপ্রেমের চেতনা। ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান ও মর্যাদা আমাদেরই সমুন্নত রাখতে হবে।

একটি সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ চায় নতুন প্রজন্ম। যেখানে সাম্প্রদায়িকতা থাকবে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলবে। জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদ ঠাঁই পাবে না। থাকবে শুদ্ধ রাজনৈতিক পরিবেশ।

বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে, নিজস্ব স্টাইলে। আপন মহিমায় মাথা উঁচু করে। উন্নয়নের বহমান এ ধারা অব্যাহত থাকুক।

হীন রাজনৈতিক স্বার্থে ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান নিয়ে আর বিতর্ক তৈরি না হোক। তাদের অপরিসীম ত্যাগ আর বীরত্বগাঁথা অটুট থাকুক। পাকিপ্রেমীরা নির্বাসিত হোক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে শাণিত করার মাস মার্চে এ হোক আমাদের দৃপ্ত অঙ্গীকার।

লেখক : স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম, ময়মনসিংহ।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৮ ঘণ্টা, মার্চ ২১, ২০১৬
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।