ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

মুক্তমত

মহাসড়কের ধার ঘেঁষে স্বাধীনতা || মাজেদুল নয়ন

মাজেদুল নয়ন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯০৯ ঘণ্টা, মার্চ ২৭, ২০১৬
মহাসড়কের ধার ঘেঁষে স্বাধীনতা || মাজেদুল নয়ন

সৎ সাহসেই বলতে পারি এর আগে নিজের দেশটার জন্যে এতোটা টান অনুভব করিনি। মাঝখানে আনুমানিক ৫০ মিটার পথের দূরত্ব।

দু’পাশে রেল ক্রসিংয়ের মতোই বাশঁ দিয়ে পথ রোধ করে দেওয়া। আমাকেও ভারতীয় ভেবেই একজন আগরতলাবাসী বলে উঠলেন, ‘ওই তো বাংলাদেশ। ’ চোখে পানি আসলো। ‘হ্যাঁ, ওটাই আমার দেশ। ’
 
গত নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল মোটর র‌্যালির বাংলাদেশ পর্বে প্রবেশের সময়কার কথা এটি। এই আমার বাংলাদেশ। এই সেই ভূখণ্ড যার জন্য জীবন দিতে হয়েছিল, ৩০ লাখ মানুষের। মনে হচ্ছিল উড়ে এসে আছড়ে পড়ি এই ভূখণ্ডে।
 
চার দেশের সেই র‌্যালিতে গিয়ে নতুনভাবে চিনলাম আমার দেশকে। ফর্মূলা ওয়ান খ্যাত ভারতীয় রাইডার ষাটোর্দ্ধ এজি কে উনামেষ। যিনি গাড়ি চালিয়ে আফ্রিকার ১৭টি দেশ ভ্রমণ করেছেন। মাউন্ট কিলিমাঞ্জারো পর্যন্ত গিয়েছেন। ১৫ নভেম্বর আমরা উড়িষ্যার রাজধানী ভুবনেশ্বর থেকে ঝাড়খন্ডের রাজধানী রাঁচি যাচ্ছিলাম। ব্যাঙ্গালুরুর এই রাইডার বেশ কয়েকবার এসেছেন বাংলাদেশেও।

জানতে চাইলাম, ‘বাংলাদেশের সবচেয়ে কোন জিনিসটা আপনার কাছে আকর্ষণীয়। ’ এজি এক কথায় উত্তর দিলেন, ‘সেখানে রাস্তার দু’পাড় ধরে প্রচুর উদ্যোক্তা। কেনা-বেচা হচ্ছে, কেউ বসে নেই। ’ সঙ্গে থাকা আরেক ভারতীয়কে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘যখন দেখবে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ছে, সেই দেশটার অর্থনীতি বুঝবে ভাল করছে। ’
 
তিনি বলেন, ‘এই ক্রয়-বিক্রয়ের স্বাধীনতার জন্যেই ১৯৭১ সালে তারা পাকিস্তানকে প্রতিরোধ করে স্বাধীনতা ছিনিয়েছে। এই জন্যই বাঙালি রক্ত দিয়েছে বারবার। নিজের টাকায় নিজেরা ব্যবসা করবে বলে। ’
 
আমি অবাক হয়ে এজির কথা শুনি। স্বাধীনতার অন্যতম দাবি ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি। তবে রাস্তার ধার ঘেঁষে এই বাজার-দোকানগুলোর কেনাবেচাই যে স্বাধীনতা সেটা এই প্রথমবার মনে হলো।

এই মার্চে আমার সহকর্মীদের অনেকের ‘'স্বাধীনতা’ নিয়ে লেখা পড়লাম। ৪৫ এর কিছু বেশি বয়সীরাও যে স্বাধীনতার গল্প মা-বাবার কাছ থেকেই শুনবেন সেইতো স্বাধীনতা। সেই গল্পগুলোর মাধ্যমেই মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের কল্পনায় এক নায়কের রূপ। সেই নায়ককেই আমরা লালন করি, যারা সত্যের জন্যে জীবন দিতে প্রস্তুত।
 
আমার মা নিজেও স্বাধীনতা যুদ্ধের যে স্মৃতিগুলো আওড়ান, সেগুলোতেও রয়েছে কল্পনার মিশ্রণ। কারণ তিনি নিজেই বলেন, সে সময় খুবই ছোট ছিলেন তিনি। তবে বাবার কিন্তু বেশ হয়েছিল। গল্পের প্রেক্ষাপট একই রকম। কিন্তু অর্থনীতির একটি বিষয় নিশ্চিত হওয়া যায়, এজির স্বাধীনতার সংজ্ঞার সঙ্গে।
 
মায়ের কাছে শোনা, যুদ্ধের সময় অনেকেই বাজারে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। যারা ফিরে এসেছেন, রাস্তার দু'পাশে পড়ে থাকতে দেখেছেন অসংখ্য মানুষের লাশ।
 
দাদার শেষ বয়সের একমাত্র ছেলে ছিলেন বাবা। তাই এলাকার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারও ট্রেনিংয়ে নিলেন না বাবাকে। কিন্তু রাজাকারদের মাধ্যমে খবর পৌঁছে যায় হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে। হানাদার বাহিনী আসছে শুনে পুরুষ এবং তরুণীরা সবাই লুকিয়ে পড়েন। বৃদ্ধা দাদীর সামনে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে তার বসতভিটা। সামনে গরু লাগামের দড়ি ধরে চোখের পানি ফেলতে থাকেন তিনি। যুদ্ধের আগে স্কুলের বই না কিনে, তা দিয়ে ব্যবসা করার স্বপ্নও ধুলিস্মাৎ হয়ে যায় বাবার।
 
বাবার কাছ থেকে শোনা, হাটে যাওয়ার সময় যাদের দেখা যেত, আবার ফেরার সময় দেখা মিলতো না। লাল হয়ে থাকতো রাস্তার দু’পাশ। সেই সময়ে অভাবও দেখা দেয়। দেশের রিজার্ভ ছিল শূন্য। কারণ, মানুষের আয়ের লাভ ভোগ করতো পূর্ব পাকিস্তান। বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র বলেছিল, একটি তলাবিহীন ঝুড়ি। কারণ ক্রয় বিক্রয়ের স্বাধীনতা ছিল না মানুষের। লাভ ভোগের স্বাধীনতা ছিল না। আজ দেশের মহাসড়কগুলোর পাশ ধরে এগিয়ে চলছে অর্থনীতি। গড়ে উঠেছে বাজার।
 
মহাসড়কের পাড় ধরে বাজার গড়ে ওঠা সড়কের নিরাপত্তার জন্যে ধণাত্মক নয়। তবে এখন ঢাকার বাইরে যাওয়ার সময় মহাসড়কের পাশের ক্রয় বিক্রয় দেখলে এজির কথাই মনে পড়েন। এইতো স্বাধীনতা। এখানে পণ্য কিনে ঘরে নিয়ে যাবে মানুষ। বিক্রি করে লাভ ঘরে তুলবেন বিক্রেতা।
 
এই বাংলাদেশ, এই স্বাধীনতা, এক এগিয়ে যাওয়া বীরের গল্প, যা আমার মায়ের মুখে শুনি। এই স্বাধীনতায় আবেগ রয়েছে, গলা ফুলে কান্না রয়েছে, চিৎকার রয়েছে।

লেখক: সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।