ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

নববর্ষ আর বৈশাখ এলেই তাকে মনে পড়ে

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২০৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ২১, ২০১৬
নববর্ষ আর বৈশাখ এলেই তাকে মনে পড়ে

রুমী কবির, অতিথি লেখক

প্রবাসে বাঙালির নববর্ষ, বৈশাখ কিংবা রবীন্দ্রনাথের কোন অনুষ্ঠানের আয়োজন দেখলেই তাকে মনে পড়ে, যিনি নিঃশব্দে  চলে গেছেন যোজন-যোজন দূরের অসীম শূন্যতায়। জীবনের অধিকাংশ সময় যিনি বাঙালির আবহমান সংস্কৃতির নিবেদিতপ্রাণ সৈনিক ছিলেন।

হ্যাঁ, আমি সেই মানুষটির কথাই বলছিলাম। বাংলাদেশের এক সময়ের বিশিষ্ট সাংবাদিক, শিক্ষক, রবীন্দ্র গবেষক ও ছায়ানটের সহ সভাপতি এবং জাতীয় রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সংগঠক প্রয়াত ওয়াহিদুল হকের কথা বলছি আজ।

জীবনের নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে পোড় খাওয়া পরিপূর্ণ এই মানুষটি তার অধিকাংশ সময় বিচরণ করেছেন বাঙালির গৌরবময় সংস্কৃতির সকল শাখায়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান যখন থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক গতিধারার উপর নানা বিধি-নিষেধ জারি করে খবরদারি করা শুরু করেছিলো, ঠিক তখন থেকেই সেইসব ষড়যন্ত্র ও নানা বাধা অতিক্রম করে বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠা করার আন্দোলনে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন এই অকুতোভয় সংস্কৃতিপ্রেমিক ওয়াহিদুল হক। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্ম শতবার্ষিকীকে কেন্দ্র করে আইয়ুব সরকার রবীন্দ্র বিরোধী তৎপরতায় মেতে উঠলে সেই অপশক্তির বিরুদ্ধে এই ওয়াহিদুল হকই জনমত গঠন করেছিলেন এবং প্রতিবাদের প্ল্যাটফরম হিসেবে সেই সময়কালেই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সনজিদা খাতুনসহ সমমনা সহযোগীদের নিয়ে আজকের এই ছায়ানট।

এরপর একাত্তুরে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হওয়ার পরও দীর্ঘদিনের দাবিয়ে রাখা সংস্কৃতিকে বাঙালির মাঝে নিশ্চিন্তে সুস্থ্যধারায় বিকশিত করার লক্ষে তিনি শুরু করেছিলেন একই নিরন্তর যাত্রা। সেই সাথে বাঙালির আধুনিক সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক উত্তরণের প্রাণ-পুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সকল সৃষ্টিকে সামনে নিয়ে এসেছিলেন তিনি।

ম‍ূলত বাঙালির বর্ষবরণ ও বৈশাখী মেলা-পার্বনের এসব উৎসব যুগ যুগ ধরে দেশের গ্রামে-গঞ্জে আনাচে-কানাচে সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উদযাপিত হলেও শহরগুলিতে এই চর্চাটি স্বাধীনতার পরও ছিল নৈরাশ্যজনক। কেননা পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে সেই যে সামরিক শাসনের কালো অধ্যায় শুরু হয়েছিল, এরপর থেকে এই স্বাধীন দেশে মূলত আবারও চেপে বসেছিল সেই একই পাকিস্তানি ভূত। ফলে সাংস্কৃতিক উত্তরণের অগ্রযাত্রায় নতুন করে শুরু হয়েছিল নানা ষড়যন্ত্র ও বিভ্রান্তির জালে ঘেরা সংকট। একদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধূলিসাৎ করতে নানা ইতিহাস বিকৃতি, আর অন্যদিকে সাংস্কৃতিক উত্তরণের পথিকৃৎ রবীন্দ্রনাথসহ  বাঙালির বর্ষবরণ, বৈশাখী মেলা, বসন্ত বরণ, শীতের পিঠা-পুলির উৎসব, শুভ হালখাতা এসব বংশ পরম্পরার প্রাণের অনুষ্ঠানগুলিকে ভারতের হিন্দু সংস্কৃতি বলে অপসংস্কৃতির ধুয়া তুলে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে চিরতরে মুছে ফেলার চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছিল সামরিক ছায়ায় সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক চক্র। ঘোর অমানিশার সংকটে নিপতিত বাঙালির আত্মপরিচয়ের এই সুস্থ ধারাকে ওয়াহিদুল হক তখন থেকেই সাম্প্রদায়িক বলয় থেকে মুক্ত করে স্বাধীন দেশের সুস্থপরিমণ্ডলে ফিরিয়ে আনার চ্যালেঞ্জে নেমেছিলেন এবং তা প্রতিষ্ঠিত করতে সফলও হয়েছিলেন তিনি।

আমার এখনও মনে পড়ে, স্বাধীনতার পর থেকে ছায়ানটের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ঢাকায় প্রতি বছরই বৈশাখের প্রথম প্রভাতে রমনার বটমূলে রবীন্দ্রনাথের এসো হে বৈশাখ... গানের ভেতর দিয়ে বর্ষবরণের শুভ সূচনা অব্যাহতভাবে এগিয়ে গেছে। পচাত্তর পরবর্তী সামরিক সরকারের প্রতিবন্ধকতায় থেকেও শত বাধা অতিক্রম করে ছায়ানটের এই ধারা থেমে থাকেনি। তখন ছায়ানটের কার্যক্রম ছাড়াও এই ওয়াহিদুল হকই সারা দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন ধর্ম বর্ণের উর্ধে থেকে বাঙালির যে নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয় ও নানা উৎসব, মেলা পার্বণ রয়েছে, সেই ঐতিহাসিক  সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে। বাঙালির এই সংকট থেকে উত্তরণে তিনি তার অন্যান্য সহকর্মীদের নিয়ে ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জাতীয় রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদ।

১৯৮৪ সালের দিকে আমি তখন জামালপুরে এসে কর্মজীবনে প্রবেশ করেছি। সেই সময় থেকে আমি নিজেও লেখালেখির পাশাপাশি জাতীয় রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদের জামালপুর শাখা কমিটিতে যুক্ত হয়ে পড়ি। মনে পড়ে, সে সময় ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনার সম্মেলনের সেইসব স্মৃতিগুলি। সংগঠনের নিয়ম ছিল, এক বছর ঢাকায় সম্মেলন হলে তার পরের বছরই হতে হবে ঢাকার বাইরের কোন শহরে। ফলে চট্রগ্রাম ও খুলনার সম্মেলনে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। চট্টগ্রামের সম্মেলনে সেবার মধ্যমণি হয়ে উপস্থিত ছিলেন আমাদের সবার প্রিয় খালাম্মা কবি বেগম সুফিয়া কামাল। সেসময় গুণীজনদের আলোচনায় শুনেছি বাঙালির এই সাংস্কৃতিক চেতনা, জীবনবোধ ও সাহিত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে রবীন্দ্রনাথকে আত্মস্থ করা এবং সেই সাথে হাজার বছরের সংস্কৃতিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার নানা কর্মসূচি ও পরিকল্পনার কথা। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে, অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কথা। খুলনার সম্মেলনেও ছিল একই চেতনা। একই অঙ্গীকার। আর এর সকল অঙ্গনেই ছিল ওয়াহিদুল হকের নিঃস্বার্থ ও নিবেদিতপ্রাণ পদচারনা। জামালপুরে সেসময় আমরা একটি সংগীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। সুস্থ সংস্কৃতির চর্চায় আমাদের উদযোগকে উৎসাহিত করতে ওয়াহিদুল হক ঢাকার সব কাজ ফেলে চলে এসেছিলেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শুভাশিস জানাতে। আরও একজন নিবেদিতপ্রাণ রবীন্দ্র প্রেমিক ছিলেন নীলোৎপল সাধ্য, ওয়াহিদ ভাইয়ের সরাসরি শিষ্য ও ভক্ত বলা চলে, এখনও সক্রিয় রয়েছেন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। তিনি আসতেন প্রতি সপ্তাহে ঢাকা থেকে দ্রুতযান ট্রেনে চেপে এবং গানের শিক্ষক হয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের শিখিয়ে বিকেলের দ্রুতযানেই আবার ফিরে যেতেন ঢাকায়। কি অদম্য আগ্রহ আর বাঙালির সংস্কৃতির ফল্গুধারাকে নতুন প্রজন্মের ভেতরে প্রবাহিত করার আকুতি ছিল সেইসময়! জাতীয় রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদ, জামালপুর শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সেসময় সুস্থ ধারার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অগ্রজ সংগঠক ও দৈনিক সংবাদের বার্তা পরিবেশক উৎপল কান্তি ধর (পরে অবশ্য তিনি সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন), সভাপতি ছিলেন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রবীণ অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুস সাত্তার, আর সম্পাদক মণ্ডলীতে ছিলেন অগ্রজ সাংবাদিক ও কবি আলী জহির, সংগীত শিল্পী ও সংগঠক এডভোকেট প্রয়াত সেজনু সাজ্জাদ, আমি এবং অনুজ কবি সাজ্জাদ আনসারি। কমিটিতে আরও ছিলেন সৈয়দ শরীফ, অধ্যাপক স্বপন সাইয়েদ, সৈয়দ নোমান, সৈয়দ তরিকুল ইসলাম, পার্থ ভৌমিক প্রমুখ।

এছাড়া আমাদেরকে সহযোগিতা করেছেন উদীচীর আলী ইমাম দুলাল, স্বপন রহমান, জাহিদ হোসেন রবিসহ বেশ কয়েকজন সংস্কৃতি কর্মী। আর এই সংগঠিত হওয়ার পেছনে পুরোটাই ছিল ওয়াহিদ ভাইয়ের প্রেরণা।

সেসময় মাঝে মাঝেই চলে আসতেন ওয়াহিদ ভাই। ছাত্র-ছাত্রীদের নিজ হাতে হারমোনিয়াম ধরে শুদ্ধ সংগীত শিখিয়ে গেছেন তিনি। জামালপুরে যতবারই তিনি এসেছেন, মনে পড়ে, তার জন্য সার্কিট হাউজের একটি কক্ষ বরাদ্দ করে রাখা সত্ত্বেও তিনি কারো বাসায় থাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। দেখেছি, ট্রেন থেকে নেমে উৎপল দা’র টিন শেডের সাদামাটা বাড়িতে সরাসরি চলে এসেছেন। দেখেছি, কি করে উৎপল দা’র মা’ মরা একমাত্র ছোট্ট কন্যা সুমিকে নিজ হাতে হারমনিয়াম ধরে ‘পৌষতোদের ডাক দিয়েছে...” গানটি শিখিয়ে যাচ্ছেন। যতক্ষণ না সুমি সেটি পুরোপুরি আত্মস্থ করতে পারছে, ততক্ষণ ধরে তিনি তালিম দিয়েই যাচ্ছেন। এইসব আজকের দিনে রূপকথার গল্পের মতো মনে হয়।

হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথকে চিনতে ও তাঁর গান শুদ্ধভাবে গাইতে এবং বাঙালির হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সঠিকভাবে আত্মস্থ করাতে ওয়াহিদুল হকই ছিলেন একমাত্র দিক নির্দেশক। তিনি এইভাবে আমৃত্যু শহরে, গ্রামে গঞ্জে ঘুরে বেরিয়েছেন আগুনের পরশ মণিকে বাঙালির প্রাণে ছড়িয়ে দিতে। ওয়াহিদ ভাইয়ের সাথে আমার তেমন কোন ঘনিষ্ঠতা বা ওঠা-বসা ছিল না, এরপরও যতটুকুই কাছাকাছি হয়েছি, সেটা ছিল আমাদের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের কর্মকাণ্ডকে ঘিরেই। তবে আশির দশকের ক্যামেরায় তোলা একটা ছোট্ট ছবি এখনও আমার কালেকশনে রয়েছে, রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদের খুলনার সম্মেলন থেকে ফেয়ার পথে একসাথে বাসে করে আসছিলাম আমরা সবাই। সেসময়টায় কোন বন্ধু ছবিটি তুলেছিলেন, সামনে প্রয়াত ওয়াহিদ ভাই, তার সাথে প্রয়াত স্বনামধন্য শিল্পী পটুয়া প্রয়াত কামরুল হাসান, আর পেছনের সারিতে আমরা তিনজন বসা ছিলাম, মাঝে আমি আর আমার দুই পাশে ছিলেন উৎপল কান্তি ধর ও আলী জহির। সেটিই আজ তার পুরনো দিনের স্মৃতি হিসেবে ধরে রাখার চেষ্টা করি। প্রবাসে  বাঙালির বর্ষবরণ, বৈশাখ কিংবা রবীন্দ্রনাথের কোন অনুষ্ঠান সামনে এলেই সেই ছবিটাকে কাছে নিয়ে আসি। আর নিমিষেই সোনা ঝরা দিনগুলির ফ্ল্যাশ ব্যাক তরতরিয়ে ছুটে আসে চোখের সামনে।
অথচ মজার ব্যাপার আমাদের গ্রুপে একমাত্র সেজনু সাজ্জাদ বা আমাদের সহযোগী আলী ইমাম দুলাল বা স্বপন রহমান ছাড়া আমরা বাদ বাকী কেউই কিন্তু সংগীত শিল্পী ছিলাম না, জানতাম না কিভাবে হারমোনিয়াম বাজাতে হয়। শুধু সম্পৃক্ত হয়েছিলাম রবীন্দ্রনাথ আর বাঙালির সুস্থ ধারার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একজন কর্মী হিসেবে।

ওয়াহিদুল হক এসবের পাশাপাশি সংস্কৃতির অন্যান্য শাখা প্রশাখাতেও বিচরণ করেছেন। ব্যস্ত থেকেছেন সর্বক্ষণ। তিনি প্রমিত বাংলা উচ্চারণ ও বাচনিক উৎকর্ষ সাধনের লক্ষ্যে কণ্ঠশীলন নামের আবৃত্তি সংগঠন গড়ে তোলেন। অন্যান্য সংগঠনের মধ্যে আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ, নালন্দা (বিদ্যালয়), শিশুতীর্থ, আনন্দধ্বনি প্রভৃতি সংগঠনের সাথেও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। সঙ্গীত ছিল তার প্রাণের খোরাক ও ধ্যান । নতুন প্রজন্মের কাছে তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীতের গুরু হিসেবেই পরিচিত ছিলেন।

শুনেছি, ১৯৭১-এ ‘স্বাধীন বাংলা শিল্পী সংস্থা’ গড়ে তোলার মাধ্যমে স্বাধীনতা যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন ওয়াহিদ ভাই। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল মাত্র বারো বছর, ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। এখন মনে হয়, সেই বালক বয়স থেকেই তার সাথে কেন পরিচয় হল না! এই মানুষটির জীবনাবসান হয় ২০০৭ সালের ২৭ জানুয়ারি। নিঃশব্দে চলে যান সব কাজ ফেলে।

যে মানুষটি এইভাবে আমাদেরকে চিনতে শিখিয়েছেন আধুনিক বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির পথিকৃৎ রবীন্দ্রনাথকে,  বাঙালির কাছাকাছি নিয়ে এসেছেন বর্ষবরণ ও বৈশাখী মেলাকে, সেই মানুষটি মৃত্যুর পরও নিজেকে বিলিয়ে গেছেন অকাতরে। মৃত্যুর আগে তার মরদেহটিও চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণার জন্যে দান করে যান। তাই জানাজার পর প্রয়াত ওয়াহিদ ভাইয়ের মরদেহ চলে যায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে। এইভাবে তিনি তার সর্বস্বই দিয়ে গেছেন। অথচ জীবিতকালে পাননি কোন জাতীয় পুরষ্কার, নেননি কোন বিশেষ খেতাব বা পদবী। বাঙালির জন্যে, জাতির জন্যে নিজেকে নিঃস্ব করে দেয়ার দৃষ্টান্ত এর চেয়ে আর কিই বা হতে পারে ?   

আজ দেখি সারা দেশে প্রতিটি শহরে গঞ্জে বন্দরে একটি মাত্রই উৎসব, যেটি ধর্মকে উর্ধে রেখেশুধুই বাঙালির একান্ত নিজস্ব, যেটি স্বতঃস্ফূর্ত সর্বজনীন উৎসব হিসেবে প্রতিটি মানুষের অন্তরে পেয়েছে স্থান, সেটি আমাদের এই প্রাণের বৈশাখী মেলা ও বর্ষবরণের উৎসব। আর তা সম্ভব হয়েছে আমাদের ওয়াহিদ ভাইয়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার জন্যই।

তাই স্বদেশ থেকে যোজন-যোজন দূরের যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে বাংলা নববর্ষ এলেই, বৈশাখী মেলার ঢাক-ঢোল, খোল করতালের শব্দ কানে এলেই প্রয়াত ওয়াহিদুল হকের কথাই মনে পড়ে সবার আগে। আর প্রবাসে জন্ম নেয়া নতুন প্রজন্মকের মাঝেও তাদের নিজস্ব আত্ম-পরিচয়ের ধারক-বাহক বাঙালির এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তুলে ধরার চেষ্টাও করে যাই নিরন্তর। অথচ প্রবাসে অনেকেই জানেন না এই ওয়াহিদুল হকের নাম। দেশের নামী দামী তারকা বা খ্যাতিমান নেতা মন্ত্রী, সেলিব্রেটির মত তিনি কখনোই আত্মপ্রচারে উন্মুখ ছিলেন না বলেই অনেকের আড়ালেই ছিলেন এবং এখনও রয়ে গেছেন। এ কারণে আমি মাঝে মধ্যে একটি তাগিদ অনুভব করি। চেষ্টা করি তার কথা বন্ধুদের কাছে, বাংলাদেশি কমিউনিটির কাছে তুলে ধরতে। তাই এই প্রবাসের মাটিতে বাঙালির বর্ষবরণের কোন অনুষ্ঠান বা বৈশাখী মেলা বা রবীন্দ্র জয়ন্তীর কোন আয়োজন হলে আমি ব্যাক্তিগতভাবে হলেও কখনো উপস্থাপক কিংবা কখনো আলোচক হিসেবে তাকে স্মরণ করি শ্রদ্ধার সাথে। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের এই মুকুটহীন রাজার কথা দর্শক-শ্রোতাদের কাছাকাছি নিয়ে আসার চেষ্টা করি। যে মানুষটি বাঙালির হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে, গৌরব গাথাকে আর রবীন্দ্রনাথকে চিনতে শিখিয়েছেন, সেই নিঃস্বার্থ সাদা মনের মানুষটিকে আজ কে চিনিয়ে দেবে? এই দায়িত্ব আজ আমাদের সবার। কেননা তার ত্যাগের ফসল আজ আমাদের গৌরবের এক বিশাল অর্জন, আমাদের আত্মপরিচয়।

আমাদের প্রচেষ্টা কিছুটা হলেও যদি সফল হয়,তখনই হয়তো প্রয়াত ওয়াহিদ ভাইয়ের বিদেহী আত্মার শান্তি হতে পারে। ওয়াহিদ ভাই, আমরা তোমাকে ভুলবো না।     

রুমী কবিরঃ  যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী লেখক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক সংগঠক  

বাংলাদেশ সময়: ২২০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২১, ২০১৬
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।