ঢাকা: ট্রেনে চেন্নাই যাচ্ছিলাম। রাত ১১টায় এলেন দু’জন।
কিছুটা ভয়ও মনের মধ্যে কাজ করছিল। না জানি কোনো হয়রানির শিকার হই কিনা। আবার জিজ্ঞেস করলেন- আইডি কার্ড! পকেটে থাকা বাংলাদেশি পাসপোর্ট একজনের হাতে তুলে দিলাম। ভদ্রলোক তার হাতে থাকা কম্পিউটারে প্রিন্ট করা তালিকার সঙ্গে নাম মিলিয়ে দেখে ফেরৎ দিলেন পাসপোর্ট।
আমার পাশের আসনে থাকা রাজ মুখার্জির আইডি কার্ডও হাতে নিয়ে মিলিয়ে দেখলেন। এভাবে পুরো বগিতে একে একে পরীক্ষা করলেন। কারোরই টিকেট চাইলেন না। লোক দু’টি চলে যাওয়ার পর রাজ মুখার্জিকে জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? উত্তর, এরা টিটির বাবা। বাপরে বাপ। এদের হাতে ধরা পড়লে রক্ষা নেই। এরা টিটিকেও জেলে পাঠাতে পারে। মস্ত ক্ষমতা এদের।
টিকেট না দেখে আইডি কার্ড দেখার বিষয়টি বুঝতে তখনও ঢের বাকি। আবারও রাজ মুখার্জির দারস্থ হলাম। দাদা এরা টিকেট না দেখে আইডি কার্ড দেখছে কেন? স্বভাবজাতভাবেই খানিকটা পেছন থেকে শুরু করলেন রাজ মুখার্জি। ও আপনি তাহলে বুঝতে পারেননি দাদা। এরাই তো ইন্ডিয়ান রেলটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এদের কারণেই তো রেলের টিকেট কিনতে পেরেছেন আপনি। না হলে সব টিকেটতো কালোবাজারির পকেটে উঠতো।
দীর্ঘ ভূমিকার পর জানালেন আসল কথা। বললেন, এরা টিকেটের সঙ্গে আপনার নামের মিল আছে কিনা পরীক্ষা করে দেখছে। একজনের নামে টিকেট কেটে অন্যজন যাতে যেতে না পারে। যদি কারো আইডি কার্ডের সঙ্গে টিকেট না মেলে তাহলে নির্ঘাত জেল।
রাজ মুখার্জি এবার বললেন, বাংলাদেশে নাকি ট্রেনের টিকেট পাওয়াই যায় না। সব দু’নম্বরিদের পকেটে চলে যায়। আপনাদের ট্রেনের টিকেট কালোবাজারির খবর শুনলে আমাদের লোকজন (ভারত) হাসাহাসি করে। কালোবাজারি বন্ধ করা তো এক তুড়ির ব্যাপার। এইটা কেন করে না।
আপনারাও এই পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারেন। ট্রেনে আইডি কার্ডের সঙ্গে টিকেট মিলিয়ে দেখলেইতো কেল্লাফতে। কালোবাজারিদের টিকেট কেউ নিতে চাইবে না। চেন্নাই এক্সপ্রেসের পর ফিরতি পথে হাওড়া মেইলেও একই দৃশ্যের মুখোমুখি হতে হলো। পরে মনে হলো সত্যিই বিষয়টি দারুণ তো।
বৃহস্পতিবার (২১ এপ্রিল) সহকর্মী মহিউদ্দিনের লেখা ‘কালোবাজারিদের দখলে টিকেট কাউন্টার’ শিরোনামে নিউজটি দেখার পর রাজ মুখার্জির কথা ও ভারতের সেই দৃশ্যপট মানসপটে বার বার ভেসে উঠছিল।
সহকর্মী মহিউদ্দিন আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। কিভাবে রেলওয়ে পুলিশ, রেলের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য, পুলিশ কর্মকর্তার আত্মীয়, রেলের বাণিজ্যিক শাখার কর্মচারী, ফোন ফ্যাক্সের দোকানের মালিক-কর্মচারীরা টিকেট হাতিয়ে নিচ্ছেন। আর সেই টিকেট উচ্চদরে বিক্রি করছে।
আরও জানতে পারলাম এদের অনেকের কাছেই টিকেট কালোবাজারিই হয়ে উঠেছে প্রধান এবং মূল পেশা। কেউ কেউ আবার চাকরি ও ব্যবসার আড়ালে কালোবাজারে টিকেট বিক্রি করে সম্পদশালী বনে গেছেন। যে কারণে লাইনে দাঁড়িয়েও টিকেট পাওয়া যায় না।
অন্যদিকে রেল কর্তৃপক্ষ বলছে চাহিদার তুলনায় আসন সংখ্যা কম। তাই টিকেট বিক্রি শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে শেষ হয়ে যায়। নিউজটিতে ভুক্তভোগী যাত্রী আলমগীর চৌধুরী আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন আমাদের দৈন্যতা।
আলমগীর চৌধুরী ১৬ এপ্রিল রাত দু’টায় তূর্ণা এক্সপ্রেস ট্রেনের দুটি টিকেটের জন্য ৫ নম্বর লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। তখন তার সামনে কেবল দুইজন লোক ছিল। সকালে কিছু লোকজন এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে পড়েন। পিছিয়ে পড়েন আলমগীর চৌধুরী। এভাবে পর দিন গেলেও তার ভাগ্যে টিকেট মেলেনি। পরে বাধ্য হয়ে কালোবাজারিদের কাছ থেকে দ্বিগুণ দামে টিকেট নিয়েছেন।
কর্তাদের যদি জিজ্ঞেস করেন, শুনতে পাবেন কতশত মহাপরিকল্পনার কথা। শুনিয়ে দেবেন তাদের নিরন্তর চেষ্টা আর কসরতের কথাও। শুনলে তাদের প্রতি মায়াও জন্মাবে কারো কারো। আহারে তারা আমাদের জন্য তার জীবন-যৌবন সব উজাড় করে দিচ্ছে। কিন্তু আমরা মিছে মিছি তাকে দোষ দিচ্ছি।
রেলওয়ের কর্তাবাবুদের কমন ডায়লগ রয়েছে, কালোবাজারিদের কাছ থেকে টিকেট না কিনলেই তো তারা এই পথ ছাড়তে বাধ্য হবে।
অনেকে আবার কালোবাজারিদের মোটিভেশন করার কথা বলেন ইনিয়ে বিনিয়ে। বলেন, এরা যদি স্বভাব না ছাড়েন রেলের পক্ষে সম্ভব নয়। তাদের জন্য বলি, কসরত দরকার নেই। দরকার নেই মহাপরিকল্পনারও। ট্রেনে উঠে টিকেটের নামের সঙ্গে আইডি কার্ডের নাম মিলিয়ে নিন। চোরাকারবারিরা তো আর ফেরেস্তা নন। যে নির্দিষ্ট ব্যক্তির নামে টিকেট কেটে রাখবে।
আর এই কাজটি খুব কঠিন নয়। সবার ন্যাশনাল আইডি কার্ড রয়েছে। ট্রেন ভ্রমণের সময় আইডি কার্ড সঙ্গে রাখা বাধ্যতামূলক করা হলেই সব সমস্যা চুকে যায়। জনগণের জন্য জীবন-যৌবন উজার করে দিতে হয় না কর্তাবাবুদের। তারাও তাদের ফ্যামিলিকে কিছুটা সময় দিতে পারেন। জনগণও শান্তিতে রেল ভ্রমণ করতে পারে।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৩২ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০১৬
এসআই/আইএ