আহা! কান ধরে উঠ-বস করতে করতে স্যার কেমন করে বসে পড়লেন!
জানি স্যার! জানি কী ওজনদার এক অপমানের বোঝা আপনার গায়ে ওরা চাপিয়ে দিয়েছিলো। নয়তো হতে পারে নিজেই টেনে নিয়েছিলেন।
আপনি হয়তো ভেতরে ভেতরে এতটাই ভেঙ্গে পড়েছিলেন, এমনই অবশ হয়ে গিয়েছিলো আপনার শরীর। এমনই অমানিশা নেমে এসেছিলো আপনার চারিদিকে যে আপনি বসে পড়েছিলেন ধুলির মেঝেতে।
নইলে গোটা দশবার উঠবস, তা সে যতই বয়স হয়ে যাওয়া শরীর হোক, করা তো যায়ই।
স্যার ওরা আপনাকে কান ধরিয়েছে। আমরা যারা ছাত্রজীবনে পড়া না পেরে, দুষ্টুমি করে শ্যামলকান্তিদের আদেশে বার বার কান ধরেছি, ওঠ-বসও করেছি কখনো কখনো তারা কিন্তু কোনও দিনই তাকে অপমান মনে করিনি। সেতো গুরুর দেওয়া শাস্তি। কত স্বস্তিতে তা মেনে উঠ-বস করেছি। মজাও পেয়েছি কখনো কখনো।
হ্যাঁ লজ্জ্বা যে একেবারে লাগতো না, তা নয়। বিশেষ করে সহপাঠী মেয়েগুলো চোখপাকিয়ে থাকতো, আর মজা লুটতো তাতেই ওই লজ্জ্বা।
কিন্তু কানে ধরায় যে এত অপমান, স্যার আপনার এই ঘটনাটি না ঘটলে জানতেই পারতাম না। স্যার মনে হচ্ছে নারায়ণগঞ্জের ওই স্কুল ঘরের সামনে সেদিন গোটা দেশ কান ধরে ওঠ-বস করলো। আমি সুনির্দিষ্ট করে বলতে চাই এই কানধরা কেবল এক শ্যামলকান্তির নয়। এ কান ধরা দেশের প্রতিটি বিবেকবান মানুষের।
স্যার স্কুলে শাস্তির কথা আরও মনে পড়ে। কত অপরাধে, কত অনিয়মে আপনারা আমাদের কখনো বেতিয়েছেন, কখনো চড়-থাপ্পড় মেরেছেন, কত কান ধরে উঠবস করিয়েছেন। আমাদের সুশিক্ষিত মানুষ হয়ে গড়ে তুলতেই আপনারা তা করেছেন। স্যার আজ এই আপনার অপমানে নিজেও যে ভীষণ অপমানিত বোধ করছি, হয়তো সেটা আপনাদের ওই শিক্ষারই ফল।
স্যার সংখ্যালঘু, সংখ্যাগুরু নিয়ে কথা উঠছে। কে বলেছে আপনি সংখ্যালঘু। আপনি শিক্ষক। আপনি বা আপনারা কতবড়, কোথায় আপনাদের অবস্থান তা বোঝার বোধ তাদেরই হয় যারা মানুষ হয়ে জন্মায় আর বড় হয়েও মানুষই থেকে যায়।
স্যার, আমি যে স্কুলে পড়েছি সে স্কুলেও কয়েকজন শিক্ষক ছিলেন, যারা আপনার ধর্মের। কিন্তু কোনও দিন কি আমরা স্যারদের ভেবেছি তারা সংখ্যালঘুদের দলে!
না। ভাবিনি। কারণ ভাবার সুযোগটিও নেই। কারণ একজন শিক্ষক তিনি হাজার জনের সমান। সুতরাং শিক্ষকের কোনও সংখ্যালঘু কিংবা সংখ্যাগুরু নেই। শিক্ষক যিনি তিনি সবার উপরে।
এই চরম অপমানের ঘটনার গোড়ায়, তিনি একটি রাজনৈতিক দলের হয়ে সংসদ সদস্য। সে তিনি হতেই পারেন। তার ব্যক্তিগত শিক্ষা, বোধ ও বিশ্বাসের দায় দল নেবে কি নেবে না সে দলের বিষয়। তবে এটা সত্য তিনি গোটা দলকেই হেয় করেছেন। সে আলোচনা রাজনৈতিক। কিন্তু আমি এও মনে করি, তিনি গোটা জাতিকে হেয় করেছেন।
বাঙালির চেতনার স্লোগান ‘জয় বাংলা’। এই স্লোগান দিয়ে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন। এই স্লোগান চেতনায় ধারন করে পদ্মা-মেঘনা-যমুনাকে ঠিকানা করে নিয়ে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে একটি জাতি। অথচ এমন একটি ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটানোর সময়ও সেখানে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান শোনা গেছে। আর সেখানে ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ও বলা হয়েছে। জাতির জনকের এতটা অবমাননা বুঝি কমই হয়েছে। আর বঙ্গবন্ধুর উদারতা, তার বিশালতা, শিক্ষা ও শিক্ষকের প্রতি তার শ্রদ্ধা ও সম্মানবোধের কথা কে না জানে।
সুতরাং স্যার, এখানে আপনি একা অপমানিত হননি, এখানে অপমানিত হয়েছে আমাদের দেশ, আমাদের মূলবোধ, আমাদের জাতীয় চেতনা। আশাকরি এর সুবিচার হবেই।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তিনিও জাতির জনকের কন্যা। শিক্ষকের মান-সম্মানকে তিনি সবার উর্ধে স্থান দেন সে কথা তার কাজে ও কথায় স্পষ্ট। এরই মধ্যে সরকারের একাধিক মন্ত্রীও এ বিষয়ে কথা বলেছেন। সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কর্মসূচি দিয়েছেন। স্যোশাল মিডিয়ায় প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। অনেকেই নিজের কান ধরে ছবি পোস্ট দিচ্ছে ফেসবুক টুইটারে।
স্যার, এভাবেই আমরা আপনার অপমানের কিছুটা ভাগ নিতে চাই।
সন্দেহ আছে, তাতেও কি অপমানের যে জগদ্দল পাথর আপনার শরীরে চেপে বসেছে তা নেমে যাবে! মনে হয় না!
তারপরেও চাই, শ্যামলকান্তি স্যার আপনি শান্ত থাকুন, ভালো থাকুন।
বাংলাদেশ সময় ১৩১৮ ঘণ্টা, মে ১৭, ২০১৬
এমএমকে