ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

স্মরণ

‘পালন করে যাবো তোমার জন্মদিন’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪৩ ঘণ্টা, মে ৩০, ২০১৬
‘পালন করে যাবো তোমার জন্মদিন’

১৯৫০-এর ৩০ মে থেকে ২০১৬-এর ৩ এপ্রিল। এই ছিল তোমার জীবনকাল।

আজ প্রথম তোমাকে ছাড়া তোমার জন্মদিন পালন করছি।

প্রতি বছর এ দিনটি আমাদের জন্য ছিল খুবই স্মরণীয় একটি দিন। আমার আয়োজন থাকতো খুব সাধারণ। মেয়েরা যখন ছোট ছিল, তখন আমার ছিল দরিদ্র আয়োজন। যেমন পায়েস রান্না আর আড়ং থেকে তোমার জন্য একটি সূতি শার্ট কেনা। আর একটি ফুল। এবং আমার বিশেষ আশীর্বাদ কুলায় থাকত ধান, দূর্বা আর একটি প্রদীপ।

তুমি অফিস থেকে ফেরার পর আমার আয়োজন দেখে খুশি হতে। কিন্তু তোমার মধ্যে তো কখনোই উচ্ছ্বাস দেখিনি। আমাকে প্রথমেই জিজ্ঞেস করতে- ‘ক্যামিদের বলেছো?’ আমি বলতাম, ‘হ্যাঁ বলেছি’। তখন তোমার চোখে-মুখে আমি শান্তি দেখতে পেতাম।

তারও পরে মেয়েরা যখন একটু বড় হল, তখন তোমার জন্মদিনের আয়োজনে একটু পরিবর্তন এলো। যেমন বড় মেয়ে তোমাকে কখনো একটা ঘড়ি কিনে দিল, আবার কোনো জন্মদিনে হয়তো একটি ফোন কিনে দিল। তুমি মেয়েদের উপহার পেয়ে যে কি ভীষণ খুশি হতে। প্যাকেটটা খুলে গিফ্‌টটা বের করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে। তোমার মুখে একটা আনন্দের হাসি দেখতে পেতাম। আমরাও খুশি হতাম তোমাকে খুশি দেখে।

তারপর এক সময় তুমি রান্নাঘরে ঢুকে আমি যে রান্না করে রেখেছি, তা এক এক করে দেখতে থাকতে এবং বলতে, ‘এতোটুকু রান্না করেছ? এতো আমি একলাই খেয়ে ফেলতে পারবো...’।

এসব এখন সবকিছুই অতীত, তুমি নেই। তুমি নেই মানে স্বশরীরে নেই। কিন্তু প্রতিটা মুহূর্তে আমি বুঝতে পারি, তুমি আছো, আমাদের পাশে। সেই আগের মতোই আমাদেরকে দেখে রাখছো। আমাদের পরামর্শ দিচ্ছো।

গত চার বছর। তার মানে ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল। এ চার বছর আমাদের জন্য ছিলো খুবই উৎকণ্ঠার। তুমি বারবার অসুস্থ হয়ে পড়ছো। বার বার তোমাকে হাসপাতালে নিতে হচ্ছে। বাবাকে নিয়ে অস্থির ছিল দুই মেয়ে অনন্যা ও অদিতি। এর মধ্যেই চলে এলো তোমার জন্মদিন। গত বছর ২০১৫ সালের ৩০ মে আমরা গিয়েছিলাম গুলশানের ফিস অ্যান্ড কোম্পানিতে। সেখানে সামুদ্রিক মাছের নানা আইটেম ওরা ওদের বাবার জন্য অর্ডার করলো।

এখানে ছোট করে বলি, আমার স্বামী ডেভেলপমেন্ট সাপোর্ট লিংকের নির্বাহী পরিচালক অচিন্ত্য কুমার দাশগুপ্তের ব্যক্তি ও কর্মজীবন। তাদের আদি নিবাস মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় উপজেলার তেওতা গ্রামে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোলে স্নাতকোত্তর পাস করার পর কিছুকাল শিক্ষকতা, এরপর দৈনিক গণকণ্ঠে সাংবাদিকতার পর্ব শেষে আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে আত্মনিয়োগ করেন উন্নয়ন গবেষণায়।

সমাজ উন্নয়ন গবেষণায় ব্যয় করেছেন তিন দশকেরও বেশি সময়। কোয়ালিটেটিভ গবেষণা করতেন তিনি। কখনো প্রচার চাইতেন না। মানুষের জন্য ছিল তার গভীর মমত্ববোধ। তার মধ্যে আমি দেখেছি আভিজাত্যবোধ, শিষ্টাচার, সংস্কৃতিবোধ আর উদারতা। শখ ছিল আবৃত্তি, অভিনয়, আড্ডায়। দেখেছি তার নির্লোভ ব্যক্তিত্ব এবং তার মেধা। তাকে অন্য সকলের থেকে আলাদা মনে হতো।

সেই কারণে আমি আমার দুই মেয়ের মধ্যে বাবার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো দেখতে পাই। ফিশ অ্যান্ড কোম্পানিতে গিয়ে মেয়েরা বাবার জন্য সবচেয়ে ভালো, সবচেয়ে দামি খাবার অর্ডার করলো। ওদের বাবাও খুব আস্তে ধীরে খাবারটা উপভোগ করছিলেন।

২০১৫ সালে ৩০ মে। এটাই ছিলো আমাদের সঙ্গে নিয়ে তোমার শেষ জন্মদিন পালন। তুমি আজ নেই। যতোদিন বেঁচে থাকবো, ততোদিন আমরা, আমাদের মতো পালন করবো তোমার জন্মদিন। তুমি ভালো থেকো।

আমাদের শোবার ঘরে রেখেছি তোমার যুবক বয়সের সবচেয়ে সুন্দর একটা ছবি। তুমি এমনিভাবেই থেকো আমাদের সঙ্গে।

সৎভাবে জীবন যাপনের জন্য তোমাকে যে কি কঠিন লড়াই করতে হয়েছে। সেই লড়াই থেকে তো তুমি মুক্ত। তোমার জীবন অনেক আনন্দময় হোক নতুন পৃথিবীতে।

তোমার মিতু

বাংলাদেশ সময়: ১৪৪০ ঘণ্টা, মে ৩০, ২০১৬
এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।