নন্দিত লেখক,সুবক্তা ও সাবেক সচিব রণজিৎ কুমার বিশ্বাসের আকস্মিক মৃত্যু আমার পক্ষে মেনে নেয়া কঠিন। এই মৃত্যু তার সঙ্গে আমার আড়াই দশকের নিবিড় সম্পর্কের নানা স্মৃতির গায়ে লেপ্টে দিয়েছে এক আকস্মিক বেদনাবিধুরতা।
রণজিৎ বিশ্বাসের সঙ্গে আমার শেষ দেখা গত মাসে। ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোর তিনি ছিলেন নিয়মিত শ্রোতা। এ সেন্টারে নিয়মিত আমারও যাতায়াত। সচিব থাকাকালে কয়েকবার দেখা হলেও সেন্টারের একটি অনুষ্ঠানে দেখা হলো বহুদিন বাদে। আবেগে তিনি জড়িয়ে ধরলেন। জানালেন, ইতোমধ্যে তিনি অবসর নিয়েছেন এবং মারাত্মক দুর্ঘটনার পর মৃত্যুর দুয়ার থেকে প্রাণে বেঁচে এসেছেন। এখন লাঠি নিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে। সর্বশেষ যে অনুষ্ঠানে দেখা হলো, সেটি ছিল মোস্তফা জামান আব্বাসী ও তার প্রবাসী কন্যা সামিরা আব্বাসীর যুগলবন্দি গজল। গজল শেষ হওয়ার পর সাবেক সচিব ও সংস্কৃতিপ্রাণ মানুষ হিসাবে তাকে কিছু বলার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিনি চমৎকার করে গুছিয়ে কথা বলতেন। প্রত্যুৎপন্নমতি হওয়ায় তাৎক্ষণিক বলতে পারতেন। খুব চমৎকার করে তিনি বললেন, আব্বাসী পরিবার এদেশের সংস্কৃতিমনা মানুষকে নানাভাবে দিয়েই চলেছেন। প্রজন্ম পরম্পরায় তাদের এই দেয়া অন্তহীন।
এই পাঠকনন্দিত লেখক ও সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে পরিচয় আমার জনকন্ঠ-জীবনে। সেখানে সিনিয়র সাংবাদিক থাকার সময় রণজিৎ দা অফিস শেষ করেই প্রায় প্রায় জনকন্ঠভবনে আসতেন এবং আমরা সাহিত্য সম্পাদক কবি নাসির আহমেদের কক্ষে আড্ডা দিতাম। এ সময় তিনি উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা ছিলেন। এটা নব্বুই দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা।
রণজিৎ দা’র স্ত্রী শেলি সেনগুপ্তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী হিসাবে আমার এক বছরের সিনিয়র। তিনি বিভাগের পরিচিতি মুখ এবং তার সঙ্গে প্রায়ই দেখা হতো। বিবাহিত অবস্থাতেই সম্ভবত তিনি মাস্টার্স শেষ করেন এবং শিক্ষকতায় যোগ দেন। তারা সে সময় নিউমার্কেটের কাছে আজিমপুর কলোনির একটি সাধারণ সরকারি বাসায় থাকতেন। একবার রণজিৎ দা’র পরিবার পুত্রকে নিয়ে একটা সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তখন তার স্ত্রী খুব ভেঙে পড়েছিলেন। খবর পেয়ে আমি ও আমার স্ত্রী তার আজিমপুরের বাসায় উপস্থিত হই। এটা নব্বুই দশকের শেষদিকের কথা।
১৯৯৭ সালে আমি মালদ্বীপ যাই সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের সংবাদ কভার করতে। তখন রণজিৎ দা’ প্রধানমন্ত্রীর দফতরের উপপ্রেসসচিব। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তিনি মালদ্বীপ সফরে যান। সফরে আরও ছিলেন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার তৎকালীন সিনিয়র সাংবাদিক শফিকুল করিম সাবু। মনে পড়ে, সার্ক শীর্ষ সম্মেলন চলাকালে আমরা তিনজন মালে’তে মালদ্বীপ প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল গাইয়ুম এর বাসভবন পরিদর্শনসহ নানা দর্শনীয় স্থান দেখেছিলাম। সম্মেলন চলাকালে সাগরপারের ভিলিঙ্গিলি ভিউ নামের হোটেলে রণজিৎ দা ও সাবু ভাই ছিলেন। আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল ‘বুরুনে গে’ নামের হোটেলে। এ সময় সংবাদ কভার করার ক্ষেত্রে পূর্ব সখ্যের সুবাদে রণজিৎ দা’ বেশ সাহায্য করেন।
একবার আমার পুরো পরিবারের পাসপোর্ট করার জন্য চটজলদি পাসপোর্ট ফরমের সত্যায়িত করা দরকার। তখন আমার বন্ধু কর্মকর্তাদের কাউকেই হাতের কাছে পাচ্ছিলাম না। পাসপোর্ট ফরমের সত্যায়নের ক্ষেত্রে অফিস বাসার নম্বর ইত্যাদি দিতে হয় বলে অনেকে আবার কুন্ঠিত থাকেন। রণজিৎ দা’কে ফোন করতেই তিনি সব ফরম নিয়ে তখনই তার অফিসে যেতে বললেন। তিনি তখন অতিরিক্ত প্রধান তথ্য কর্মকর্তা। সচিবালয়ের পিআইডি ভবনে তার অফিস। সেখানে গিয়ে কাজ সেরে নিলাম।
যতদূর মনে পড়ছে, সচিব হওয়ার পর রণজিৎ দা’ প্রথমে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। দেখা হতেই বললেন, এ সংক্রান্ত কাজ থাকলে যেন তাঁর শরণাপন্ন হতে কুন্ঠিত না হই।
জনকন্ঠে সংবাদ ও ফিচার লেখার ক্ষেত্রে আমি শব্দচয়ন ও ব্যবহারে সাহিত্যসচেতন ছিলাম। কবি রফিক আজাদ এর পর আরেকজন আমার এ ধরনের সংবাদ ও ফিচারের নিয়মিত পাঠক, সমালোচক ও পরামর্শক ছিলেন-তিনি হচ্ছেন রণজিৎ কুমার বিশ্বাস। বলাবাহুল্য, রম্যরচনা ছাড়াও ভাষার ওপর রণজিৎ দা’র দখল ছিল অসাধারণ। এ সংক্রান্ত তার বইও আছে।
রণজিৎ কুমার বিশ্বাসের সঙ্গে অগুনতি স্মৃতি আজ মনের কোণে ভিড় করছে। এ স্বল্পপরিসরে কয়েকটি মাত্র উল্লেখ করলাম। এ লেখার মধ্য দিয়ে প্রয়াত রণজিৎ কুমার বিশ্বাসের প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
বাংলাদেশ সময়: ১২২৬ ঘণ্টা, জুন ২৪, ২০১৬
আরআই