‘ঢাকার সাংবাদিক-শিক্ষক মার্কিন মুলুকে ছাগল খামারি’
শীর্ষক নিবন্ধের প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গ....
এক.
বহুল আলোচিত সংবাদপত্র দৈনিক জনকন্ঠে বিশেষ প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করার সময় কিছুদিনের জন্য আমাকে ‘ছাগল’ খেতাব নিতে হয়েছিল। সহকর্মীরা আমাকে এই নামে ডেকে ‘ফান’ করতো।
তোয়াব ভাইয়ের এ্যাসাইন্টমেন্ট- ঢাকার অদূরের বিশেষায়িত ‘ছাগল’ খামারের ওপর একটা ফিচার লিখতে হবে। সরেজমিন গিয়ে ঢাকায় ফিরে ফিচার লিখলে জনকন্ঠের শেষ পাতায় তা ‘বক্স’ করে আলাদা ট্রিটেমন্টে প্রকাশিত হয়। সঙ্গে সঙ্গে হৈচৈ পড়ে যায় দেশজুড়ে। সহস্র মানুষের আগ্রহ উদ্দীপনা আর আলোচনা জনকন্ঠ ভবন পর্যন্ত পৌঁছে। দেশে কিছুদিনের জন্য ছাগলের খামার বানানোর হিড়িক পড়ে। অফিসে বহুদিন পর্যন্ত আমাদের আড্ডা-আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে ‘ছাগল’। আর খেতাবটি সেখান থেকেই আসে।
শ্রদ্ধেয় তোয়াব খান, কামরুল ইসলাম খান, শুভ রহমান, আবদুল হালিম, নাসির আহমেদ ছাড়াও রিপোর্টিংয়ের প্রিয় সহকর্মী আহমেদ নূরে আলম, মোস্তাক মোবারকী, খায়রুল আনোয়ার মুকুল, পাভেল রহমান, হাসান হাফিজ, সৈয়দ আবদাল আহমদ, আমান উদ দৌলা, শংকর কুমার দে, রেজোয়ানুল হক রাজা, মোস্তফা ফিরোজ, মাসুদ কামাল, ওবায়দুল কবির, হাসনাইন খুরশেদ, কাওসার রহমান, আলী আসগর স্বপন, আহমেদ দীপু, মোয়াজ্জেম হোসেন, আরিফ রহমান শিবলী, মজিবর রহমান, আরিফুর রহমান বাবু, মশিউর রহমান টিপু, প্রভাষ আমিন, আশীষ উর রহমান শুভ, আশরাফ আলী, ইলিয়াস খান, শরিফুজ্জামান পিন্টু, মনির হায়দার, মীর আহমেদ মিরু, ইয়াসিন কবির জয়, কামরুল হাসান, হাসানুজ্জামন তরুণ, মনিজা রহমান প্রমুখের সে খেতাবের বিষয়টি মনে থাকার কথা।
তখনও ফেসবুক প্রজন্ম আসেনি। চমকপ্রদ কোন প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর ব্যাপক আলোচনা হতো। ইস্যুটি নিয়ে প্রেসক্লাব, ডিআরইউসহ সাংবাদিকদের নানা আড্ডার জায়গা মেতে উঠতো গঠনমূলক আলোচনা তর্ক-বিতর্কে।
লোকজন এ নিয়ে চায়ের টেবিল সরগরম করতো। কিন্তু এখন কোন প্রতিবেদন বিতর্কিত বা ব্যতিক্রমী হলে ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিস্তৃতি পায়। একে ‘ভাইরাল’ হয়ে যাওয়া বলে। সম্প্রতি ছাগলের খামার নিয়ে বাংলানিউজে প্রকাশিত আমার ফিচার বিশ্বজুড়ে বাংলাভাষাভাষী, সাংবাদিকদের মধ্যে ভাইরাল হয়েছে। চলছে আলোচনা, সমালোচনা, আগ্রহ-উদ্দীপনা। সে সব প্রতিক্রিয়ার সমালোচনা কিংবা জবাব দেয়ার জন্য এ লেখা নয়। ছাগল সম্পর্কিত স্মৃতিকাতরতা ও আগ্রহীদের সামনে নিজের একটা ছাগলীয় বিশ্লেষণ মাত্র।
দুই.
আবু নাসের রাজীবের ছাগলের খামার নিয়ে আমার ‘ডিসক্লোজার’ ফিচার প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ভাইরাল হয়ে গেছে। শতশত শেয়ার, মন্তব্য, বিরূপ মন্তব্য, আলোচনা, সমালোচনায় মুখর হচ্ছে অন্তর্জালবিশ্ব।
লাইক আর মন্তব্যে-মন্তব্যে ভরে উঠেছে ফেসবুক পাতা, বাংলানিউজ, ফিচারের নায়ক ও নিবন্ধকারের ইনবক্স ও ফোনের ম্যাসেজ বক্স ও মেইল। দেশ-বিদেশের পাঠককুলের বিপুল আগ্রহ থেকে বুঝতে পারা যায় ছাগল খামারের ফিচার কতোটা প্রভাব সঞ্চারী।
বহু মানুষ নিজের ছাগল-ভেড়ার খামারের ছবি পাঠিয়ে জানান দিয়েছেন, তারা আনন্দের সঙ্গে খামারি হয়েছেন। বহু মানুষের স্বপ্ন ও পরিকল্পনা ছিল ছাগলের খামার করার, বাস্তবে তা হয়ে ওঠেনি বলে এখনো কষ্টে ভুগছেন। বহুজন আলোচ্য খামার পরিদর্শন করে নিজে তা শুরুর আগ্রহ দেখিয়েছেন। অনেকে ফিচারের হেডলাইন, লেখা বা নিবন্ধের নায়ককে উপস্থাপনের ভঙ্গিটির সমালোচনা করেছেন। নিবন্ধ নায়ক মিডিয়া জগৎ-সংশ্লিষ্ট হওয়ায় তার ডিজিটাল নেটওয়ার্ক পেশাদার সাংবাদিক, সাংবাদিকতারশিক্ষক-ছাত্র দ্বারা পূর্ণ। তাদের অনেকেই সাংবাদিকতার চিরায়ত নীতিমালার নিরিখে এ লেখা বিচারের চেষ্টা করেছেন। আবার কারও কারও মন্তব্য এসেছে ফিচারটি না পড়ে কিংবা নিরেট ঈর্ষা কাতরতা থেকে।
প্রসঙ্গক্রমে ব্যক্তিগত বিশ্লেষণ এখানে অতিরঞ্জিত হওয়ার কথা নয়। বলাবাহুল্য, আবু নাসের রাজীব আমার স্নেহভাজন। তার সঙ্গে আমার সম্পর্কটি একান্ত নীবিড়। একই অঞ্চলের বাসিন্দা এবং বন্ধু ভাতুস্পুত্র হিসাবে মেধাবী ছাত্র, ঈর্ষণীয় পেশাদার, নিবেদিত শিক্ষক ও দায়িত্ববান সংসারী হিসাবে আমাদের সামনেই তার বেড়ে ওঠা। নম্র, ভদ্র, বিনয়ী রাজীব একের পর এক সাফল্য ছুঁয়েছেন তার আকাঙ্খানুসারী পরিশ্রম ও কর্মনিষ্ঠায়। এই রাজীবকে আমার চেয়ে বেশি কে আর চেনে?
যে রাজীব সম্পর্কে কারোরই জানা নেই, তাকে বিশেষ নাটকীয় চমৎকারিত্বে প্রাদপ্রদীপে নিয়ে আসা ছিল আমার লেখার উদ্দেশ্য। তার যে পরিচয় সমাজের উপরিতলে ইতোমধ্যে আছে, আমার এ নিবন্ধ তাকে ভাল করে চিনতে চায়নি বা গুরুত্বে আনতে চায়নি বলেই এটি সংবাদ উৎস। চেনা রাজীব কখনো সংবাদ উৎস নয়। শিরোনামের মধ্যে ‘টুইস্টিং’য়ের আভাস মেনে নিলেও সম্পূর্ণ অজানা-রাজীবকে তুলে ধরতে এ ধাক্কাটারও প্রয়োজন ছিল। এখানে রাজীবের জানা অতীতের ওপর অভিনব অচেনা বর্তমান আকস্মিক একটা ধাক্কা দিয়ে যায় বলে আলোচনা-সমালোচনার সূত্রপাত। কারণ মনে আঁকা অতীতের বিপরীতে নতুন বর্তমানকে মেনে নিতে আমাদের সময় লাগে বটে! বলাবাহুল্য ডিসক্লোজারের পর এই খামারটি যদি বিশ্বের সবচেয়ে বৃহত্তম খামারেও পরিণত হয়, আর তার ওপর যদি অগুণতি ফিচার লেখা হয়, তবু আমাদেরকে এতোটা অভিভূত করবে না, যতোটা প্রথমবার করেছে।
সব দেশে সব সমাজে সব ঘরানা বা শ্রেণীতে সবসময় কিছু নেতিবাচক সমালোচনাকারী অহেতুক বিষয়কে ঘোলা করেন। অতীতের তিক্ততা ও অভিজ্ঞতা থেকে জানি, এই ক্রিটিকরা প্রথম রিপোর্ট বা ফিচারের বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। সেটাতে না পারলে তারা বইয়ে চিরায়ত প্রচলিত প্রথার নিরিখে সেটা সংজ্ঞার বাইরে পাঠান। সবশেষে হাত দেন সে লেখার উপস্থানভঙ্গি কিংবা অন্যকিছুতে। এসব ক্রিটিকরা মিডিয়া, লেখক-সাংবাদিক বা লেখার পাত্রপাত্রীকে নানাভাবে উত্যক্তও করেন। সবকিছুতে ব্যর্থ হলে বলে ওঠেন ‘এতো ভালও ভাল না’ জাতীয় কথা।
এ নিবন্ধের প্রেক্ষিতে প্রকাশ্য ও প্রকাশ্যের বাইরে ফোন, মেইল, ক্ষুদে বার্তা আকারে যেসব ক্রিটিসিজম এসেছে সেগুলোর চারিত্র্যও এরকম। এ দেশে এ ধরনের সমালোচনার বড় এক ভিক্টিম অনুজাপ্রতিম সাংবাদিক মুন্নী সাহা। তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে রাজীবকে ধন্যবাদ দিয়ে মুন্নী লিখেছেন, ‘আমি জানি, বাংলাদেশে তোমার বন্ধুরা এগুলো নিয়ে রঙ্গ করবে, করুক, তুমি তোমার আনন্দে থেকো’।
এ রচনা রাজীবের সাংবাদিক-শিক্ষক পরিচয়কে গৌণ রাখলেও মোটেও অস্বীকার করেনি। বরং শেষের একটিমাত্র লাইনের মাধ্যমে পাঠকমনে মধ্যে গেঁথে দিতে চেয়েছে, খামারি নায়ক কার্যত একজন শিক্ষক। এই নিবন্ধের কারণে নায়কের প্রোফাইলে অবশ্যই ধাপান্তর ঘটবে। তবে সে ধাপটি যে উচ্চতামুখী, বেশিরভাগ ইতিবাচক মন্তব্যকারীর অভিমতে তা ফুটে উঠেছে।
বস্তুনিষ্ঠতার প্রয়োজনে কোন স্টোরিতথ্য অভিন্ন হলেও বিষয়নিষ্ঠ বর্ণনা ও উপস্থানভঙ্গি লেখকভেদে আলাদা। ব্যকরণের নিয়মনিগঢ় বস্তুনিষ্ঠতাপ্রশ্নে চললেও সাংবাদিকতা আসলে ওই দু’য়ের মেলবন্ধনে সভ্যতার এক অপূর্ব সৃজনশীলতা। এই সৃজনকর্ম সতঃশ্চল, বই ও প্রথাতাড়িত নিয়মের ধার ধারে না তা। তবে এই সৃজনশীলতার বহমানতা পাঠকপ্রান্তে আপাত সমাপ্ত বলে তথ্যভুক পাঠক অভিমত তথ্যকারবারির কাছে সর্বদাই স্বাগত। এ নিবন্ধে অংশগ্রহণের জন্য সবাইকে তাই সাধুবাদ।
বাংলাদেশ সময় ১০৫৭ ঘণ্টা, জুন ৩০, ২০১৬
এমএমকে/