জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ নির্দিষ্ট মানচিত্রে সীমাবদ্ধ নেই। দেশ-অঞ্চল-মহাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে এখন বৈশ্বিক রূপ নিয়েছে।
এ দুর্ঘটনা রোধ করা যেতো কিনা সে বিতর্ক অবান্তর। যদিও সে বিতর্কের মাঝে ভবিষ্যতের প্রতিকার বা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাপত্র থাকলেও থাকতে পারে। তবে এখন আমাদের মূল মনোযোগের জায়গাটি হচ্ছে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ।
জিম্মি সংকটে জঙ্গিদের লক্ষ্য ছিল আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণ। সে লক্ষ্যে তারা সফল। সংকট অবসানের পর সরকারও দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করে বিশ্বের ইতিবাচক দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছে। জিম্মি সংকট উদ্ভব হওয়ার সাথে সাথেই আমাদের সরকার তথা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দ্রুততম সময়ের মধ্যে রেসপন্স করেছে। এতে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও বিশ্বের কাছে এ সংকট মোকাবেলায় আমরা আস্থা অর্জন করতে পেরেছি।
এখন যেসব বিদেশি নাগরিক নিহত হয়েছেন তাদের তাদের স্বজনদের কাছে, নিজ দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা জরুরি। এবিষয়ে সরকার ইতোমধ্যে ব্যবস্থাও নিয়েছে।
সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদের বিশ্বায়ন হয়েছে। তাই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে। কোনো ধর্মেই সন্ত্রাসের জায়গা নেই। যে নামেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালিত হোক, এর বিরুদ্ধে রাষ্ট্র-সমাজ-পরিবার এমনকি ব্যক্তি পর্যায়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় শান্তি ও প্রগতির শত্রুর ধারণা বদলে গেছে। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে এক সময় রাষ্ট্রকেই বিশ্বশান্তির জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি মনে করা হতো। কিন্তু রাষ্ট্রশক্তির চেয়েও এখন বড় হুমকি বহুজাতিক বা আন্তর্জাতিক দল, গোষ্ঠী বা চেতনাগত জোট। এরা রাষ্ট্র ও জনগণের মাঝে বিভাজন সৃষ্টি করে। রাষ্ট্রের মাঝে রাষ্ট্র (state within state) গড়ে প্রতিষ্ঠা করতে চায় দখলদারিত্ব। এদেরকেই বলা হয় non-state actor। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে আইএস ইরাকের ফালুজ্জা দখল করে। পরে সিরিয়া-জর্ডান-লেবাননের অংশবিশেষ দখল করে ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। সেই ফালুজ্জাকে আজও আইএস-এর দখলমুক্ত করা যায়নি।
এসব non-state actor-এর কাছে বিশ্বের কোনো ভূখণ্ডই মুক্ত নয়। তাই জিম্মি সংকট ছিল আমাদের জন্য একটি wake up call। সস্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে এতোদিন আমরা যে রক্ষণশীল কৌশল প্রণয়ন করেছি সময় এসেছে তা পুনর্বিবেচনা করার। জঙ্গি নেতৃত্ব-সংগঠন-পৃষ্ঠপোষকদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে।
একটি ঘটনা অন্য ঘটনার প্রেরণা জোগায়। ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বা চেতনাগত অবস্থান থেকেই এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। তাই এসব ঘটনার সাথে সাংগঠনিক বা অফিসিয়াল সংযোগ জরুরি আবিষ্কার নয়। গুলশানের ঘটনায় আইএস জড়িত কিনা সে প্রশ্নের চেয়েও বড় বাস্তবতা হলো ঘটনাটি আন্তর্জাতিক মানের (আন্তর্জাতিক দৃষ্টান্তের) এর আন্তর্জাতিক ও কূটনৈতিক মূল্য রয়েছে।
যেহেতু এসব সন্ত্রাসবাদ ভাবাদর্শ বা চেতনাগত অবস্থান থেকে উৎসারিত তাই পরিবার থেকে রাষ্ট্র-সবক্ষেত্রেই এর বীজ উপ্ত থাকতে পারে। তাই পরিবার-রাষ্ট্র-সমাজ এমনকি প্রতিটি নাগরিককে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে।
একসময় এজাতীয় সন্ত্রাসের জন্য কেবল নিদির্ষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দিকেই ইঙ্গিত করা হতো। কিন্তু আমরা দেখলাম, উচ্চমানের বেসরকারি, আধুনিক, ইংলিশ মিডিয়ামের শিক্ষার্থীরাও এর থেকে মুক্ত নয়। তার মানে, জঙ্গিবাদের Recruitment Base এখন বিস্তৃত। এটি বড় আশঙ্কার কারণ। অন্ধকারে পুরো ঘরেই সাপ!
কিন্তু এর কারণ কি? ২০-৩০ বছরের তারুণ্যের মাঝে কী করে এসব অলীক-অবাস্তব চেতনার অনুপ্রবেশ ঘটলো? তা আমাদের জানা নেই। তবে, আমাদের কাছে যা স্পষ্ট তা হলো দেশে আজ চরম এক সাংস্কৃতিক সংকট (Cultural Decline) বিরাজ করছে। একটি জাতি যদি ক্রমাগত এ সাংস্কৃতিক সংকটে ভুগতে থাকে তবে তার মাঝে একসময় জাতিগত সংকট (Ethnic Decline ) দেখা দেয়। আমরা নিশ্চয় সে সংকটের মুখোমুখি হতে চাই না।
জানি, এজাতীয় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পুরোপুরি বন্ধ করা যাবে না। তবে আমরা এর হ্রাস টেনে ধরতে পারি। তাই পরিবার থেকেই সচেতনতা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ সময়: ২০৩৬ ঘণ্টা, জুলাই ০৪, ২০১৬