ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

‘কালো জাদুকর’ পাঠের স্মৃতি

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩৭ ঘণ্টা, জুলাই ১৯, ২০১৬
‘কালো জাদুকর’ পাঠের স্মৃতি

ইংরেজ জমানার ইট আর সাদা চুনকামের বিশাল বিশাল স্কুলঘর। সেই ঘরে বিরাট বিরাট জানালা।

স্কুলঘরের পর বিস্তৃত মাঠ। মাঠ ঘেঁষে বিখ্যাত ব্রহ্মপুত্র নদ। নদীর ওপারে সবুজ চর, সারি সারি গাছ। সেই চরে কৃষিজীবী মানুষের ব্যস্ত গ্রাম। নদীর এ পাড়টাও তাই। মাঠ-নদী-গ্রামের উপর খোলা আকাশ। নীল আকাশে সাদা মেঘের পাহাড় কিংবা নক্ষত্রের রাতে স্বর্গপুরী মনে হয় গ্রামটিকে, ঠিক যেনো তারাশঙ্করের ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’। স্যার ক্লাসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বয়ান দিয়ে যান, আর আমি জানলার ধারে বসে নদীর রুপালী জল আর আকাশের সাদা মেঘ দেখি। নিরক্ষরেখা, বিষবুরেখা কিংবা দ্রাঘিমারেখা আমার মাথায় ঢুকতো না। আটল্টান্টিক মহাসাগরের ¯্রােতের গতিপথ জেনে রাখাটা আমার কাছে অপ্রয়োজনীয়। বরং বসে বসে ভাবতাম মাঠের যে অংশে নদীটা ৩০ ডিগ্রি বাঁক নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে মেঘনার দিকে ছুটে গেছে সে অংশটাই বেশি সুন্দর, বেশি প্রশস্ত।

গ্রামটা অপূর্ব, প্রকৃতি কিছুটা অদ্ভুত, মানুষগুলো আরও। প্রতি বর্ষায় বান ডেকে অর্ধমৃত নদীতে কিছু পানি এসে যৌবন জাগে। তবে পোড়ামুখো বন্যা হয় না, পাড়ও ভাঙ্গে না। ১ দেড় যুগ পরে বড় বন্যা হলে পাড় যাও একটু আধটু ভাঙ্গে তাতে কেউ গৃহহীন হয় না। শুধু কিছু ফসলী জমি চলে যায় নদীর পেটে, এতে কেউ কোন দিন আক্ষেপও করে না। বরং উল্টো বন্যা পরবর্তী ফসলের হাসি কিংবা মাছ ধরার নেশায় দন্ত বিকশিত হাসি দেখা যায়। কে স্কুলে গেল আর কে গেল না কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় পাস দিয়ে পুরাদস্তুর সাহেব হলো ওতে তাদের কোনো কর্ণপাত নেই। ওরা ওদের মত।

ব্রহ্মপুত্রের কূল ঘেঁষা এ গ্রামেই আমার জন্ম, বড় হয়ে বেড়ে ওঠা। খুব ছোট বেলায় এই নদীতে স্টিমার দেখেছি বটে ক্লাস এইটের আগে আমি কখনো শহর দেখিনি। সে গল্প থাক।

গ্রামের অন্য কিশোরদের মত আমার দিনও কেটে যেতো একই রুটিনে। বই নিয়ে স্কুলে যাই, ক্লাস করে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরি। পড়া-লেখাটা নিরানন্দ, বিষাদময়। বিকেল বেলা খেলতে বেরোই। এখনকার মত আমাদের মা-বাবারা পড়ালেখার জন্য অতটা নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন না তাই সন্ধ্যাবাতির ক্ষণে আমরা বই নিয়ে বসতাম না বরং দল বেঁধে বাড়ি বাড়ি ঘুরে অদ্ভুত সব খেলা খেলতাম। আমার সেই বন্ধুদের মধ্যে খুব বেশি সংখ্যাক কলেজ পর্যন্ত যেতে পারে নাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও কম। আমারও তাদের দলে থাকার কথা ছিলো কিন্তু আমি বিশ্ববিদ্যালয় চৌকাঠ মাড়িয়ে পড়া-লেখাও শেষ করেছি। কেনো পেরেছি তা আমি জানি। শুধু আমি নই, আমার মত হাজার হাজার তরুণ সে কারণটা জানে। আর তাই আজ কোনো জোছ্না রাতে সেটা মনে করেই তাদের চোখ জলে ভরে যায়।

সুন্দর গ্রাম কিংবা আরও সুন্দর ইশকুল থাকলেই যে খুব পড়–য়া আর ভালো রেজাল্টধারী ছাত্র হওয়া যায় বিষয়টা এমন নয়। পড়া-লেখার জন্য দরকার আনন্দপূর্ণ পাঠদান। আমাদের পড়া লেখায় আনন্দ অনুপস্থিত, তাই নেশা ধরে না। স্কুল গ-ি পেরুনোর আগেই বিরস মুখে এ পথ থেকে সরে দাঁড়িয়েছে লাখো লাখো শিক্ষার্থী। এ কারণেই অল্প বয়সে কোনো মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইলেও পড়া-শোনা করে বড় হবো এমন প্রতিবাদে রুখে দাঁড়ায় না। স্বপ্ন দেখার পথ হয়ে যায় রুদ্ধ। জন্মের আগেই মরে যায় বড় হবার স্বপ্ন।
খুব ভালো ছাত্র ছিলাম না। কিছু পড়াশোনার জন্যই স্কুলে যাওয়া। স্কুলে যাই, পরীক্ষায় পাস করতে পারলে ভালো, না করতে পারলে আরও ভালো টাইপ অবস্থা। কারণ আমি মেধবীদের মত ঘণ্টার পর ঘণ্টা বইয়ে মুখ গুজে রাখতে পারতাম না, বিরক্ত লাগত। স্যারেরা ক্লাসে, পদ্য-গদ্য, প্রাচীন ইতিহাস, অর্থনীতির সমীকরণ পড়াতেন, বুঝতাম না। পড়া লেখা ছিল আামার কাছে আনন্দহীন অধ্যায়।

একবার পাস একবার ফেল করতে করতে আমি তখন ১০ম শ্রেণীর ছাত্র। সামনের মাস দুয়েক বাদে প্রি-টেস্ট পরীক্ষা। বন্ধুবান্ধব সব ধুমছে পড়ছে। পাস করতেই হবে কিন্তু বই পড়ি বিরক্ত লাগে। এই বিরক্ত লাগার মুহূর্তে আমি একদিন আমার এক বন্ধুর কাছে খুঁজে পেলাম ‘কালো জাদুকর’ নামের বইটি। লেখকের নাম হুমায়ূন আহমেদ। নাম শুনেছি তাঁর কিন্তু কোনো বই পড়িনি। আগ্রহ নিয়ে পড়তে শুরু করি বইটি। মন্দ না। সময় যায়  দ্রুত পৃষ্ঠা ফুরাতে থাকে। এক সময় চটকরে বইটি পড়া শেষ হয়ে যায়।

এটাই প্রথম বই পড়া। আমার অন্যরকম লাগে। সারাদিন ঐ ভাবনায় বুদ হয়ে থাকি? খুঁজতে থাকি আরও হুমায়ূন। এর পরদিন পেলাম হিমু সিরিজের প্রথম বই ‘ময়ূরাক্ষী’ এরপরে ‘নন্দিত নরকে’ ‘শঙ্খনীল কারাগারে’ ‘লিলাবতি’ ‘তোমাকে’ ‘অচিনপুর’ ‘চৈত্রের দ্বিতীয় প্রহর’ ‘ফেরা’ ‘অপেক্ষা’ মিসির আলি একটার পর একটা। এক সময় প্রায় সব।

বই পাই আর পড়ি। কখন যে একটা সময় মুগ্ধ পাঠক হিসেবে তৈরি হলাম খেয়ালই করি নি। এখন  বড় বড় বই পড়তেও আমার বিরক্তি লাগে না। উল্টো আনন্দ পাই। এজন্য কি তিনিই দায়ী নন? নিঃসন্দেহে।

বইগুলো পড়ায় আমার একটা কাজ হয়েছে, আমি একাডেমিক বই পড়ে আর বিরক্ত হইনা। আমাকে আরও পড়তে হবে এই স্বপ্নটাই আমাকে অনেক দূর নিয়ে এসেছে। পূরণ করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন।  

অনেকেই হুমায়ূন আহমেদ স্যারের লেখা নিয়ে বির্তক করে। আসলে বির্তকটা তাদের কাছে ফ্যাশন। নিজের জ্ঞান জাহির করাই তাদের উদ্দেশ্য। তাদের কাছে জানতে চাই সব কিছুতে এত শিক্ষা শিক্ষা করেন ক্যানো?  

সেই যে কবে প্রথম বার সেই কালো জাদুকরের প্রেমে পড়েছিলাম জানি না। জাদুকর আমাকে অনেক ঘুরিয়েছে। এখন জোছনা হলে আমিও কাঁদি। আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামলে ঠায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টির নাচন দেখি। মাঝে মাঝে হিমু হতে ইচ্ছে করে, পারি না। তবে আবেগ আমায় ছুঁতে পারে, চোখ আড়াল করে পানি মুছি।  

আপনি কাছাকাছি ছিলেন কিন্তু কাছ থেকে দেখতে পারিনি। সেই কষ্ট আমাকে তাড়িয়ে বেড়াবে সারাজীবন।

স্যার, আজকে আপনার ৪র্থ মৃত্যুবার্ষিকী। আপনার প্রিয় বর্ষায়, প্রিয় জোছনায় আপনাকে খুব মনে পড়ছে। স্যার, আপনার ইচ্ছে ছিল যেনো কোন এক পূর্ণিমায় আপনার মৃত্যু হয় কিন্তু আপনি চলে গেলেন ঘোর অন্ধকারে। প্রবাস ছিল আপনার অপছন্দ অথচ আপনি সেই প্রবাসেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। একটুখানি কষ্ট হয়।
স্যার, আপনিই তো বলে ছিলেন জোছনা সবচেয়ে বেশি প্রবল হয় বর্ষাতে। দেখেন স্যার আজ পূর্ণিমা না থাকলেও আকাশ ভরা জোছনা। জোছনায় খাঁ খাঁ করছে চারদিক। স্যার আমারও এমন দিনে গৃহত্যাগী হতে ইচ্ছে করে। এমন দিনে নিশ্চয় আপনি খুব বেশি দূরে নয়। তবে স্যার, যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন।
 
লেখক: সহ-সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ।

** নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ

বাংলাদেশ সময় ১২৩১ ঘণ্টা, জুলাই ১৯, ২০১৬
এমএমকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।