ভোর হলে পর যে মৃদু আলোটুকু নিয়ে দিনের শুরু তাতেই থাকে নিভৃত স্বপ্ন। তাতেই শুরু জীবনের পথ চলার।
সকালটা যদি জেগে ওঠে রবীন্দ্রনাথের প্রিয় কোনো গানে। তবে সারাটাদিন তার রেশ আমাদের মনে-মননে লেপ্টে থেকে সতেজতাকে বাড়িয়ে তোলে বহুগুণ।
রবীন্দ্রপ্রেমে কী লাভ; আর রবীন্দ্রনাথে প্রেম না থাকলে কী লাভ –এ দু’য়ের পার্থক্য অল্পবিস্তর তুলে ধরা যাক।
রবীন্দ্রপ্রেমী না হয়েও একটা মানুষ তার মনুষ্যত্ব, বিবেক ঠিক রেখে বেশ চলতে পারেন; তবে রবীন্দ্রপ্রেমী হওয়ার প্রয়োজনটা কোথায়? রবীন্দ্রনাথ না পড়েও তো দিব্বি ভালো আছেন আমাদের চারপাশের অনেকেই।
গভীর বিশ্বাসের সঙ্গে বলা যায়, জীবনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতির প্রতিটি প্রকাশ রয়েছে রবীন্দ্ররচনার শতসহস্র অলিগতিতে। যা বিশ্লেষণ এবং চর্চা করলে ‘মানুষ’ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে উপকারী উপাদানগুলো খুব সহজেই পাওয়া যায়। যা চর্চা করলে এই সময়ের যে ‘বিপথগামিতা’, তাতে পিছলে পড়ে আটকে যাওয়ার ভয় থাকে না।
সম্পর্ক গভীর তৎপর্যপূর্ণ একটি শব্দ। যা যুগে-যুগে কালে-কালে মানবমানবীর হৃদয়কে নানান রঙে, নানান রূপে বর্ণিল করে তুলেছে। বর্তমান সময়-সভ্যতা ভোগবাদিতাকে দারুণভাবে সমর্থন করে চলেছে।
এ ‘সম্পর্ক’ শব্দটার কথাই ধরা যাক। স্বাভাবিক পর্যালোচনায় দেখা যায় - একটা সম্পর্ক তৈরি হওয়ার পর অদূরবর্তী সময়ের ব্যবধানে খুব সহজেই সেই পুরুষটি নারীর শারীরিক স্বাদ পেতে কোনো না কোনোভাবে অদম্য হয়ে ওঠেন। সে ক্ষেত্রে নারীটি প্রতিবাদমুখর ভূমিকায় অবতীর্ণ হলে হঠাৎ এগিয়ে আসা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নৌকাডুবি ঘটে।
অন্যদিকে, নারীটি প্রতিবাদী না হলে সম্পর্ক শরীরের নিভৃতে এসে মেশে। ‘বন্ধুত্ব’, ‘ভালোবাসা’ খুব অল্পদিনের ব্যবধানেই দু’জনের মাঝ থেকে চিরতরে হারিয়ে যায়।
কেবল শরীরনির্ভর যে সম্পর্ক তা ক্ষণস্থায়ী। অপরদিকে শরীরহীন হৃদয়ের যে সম্পর্ক তার আবেদন চিরকালের। রবীন্দ্রনাথ স্বাত্বিক ভালোবাসার কথা বারবার বলেছেন। অর্থাৎ যে প্রেম শরীরজুড়ে নয়; কেবল হৃদয়ের চিলেকোঠায় প্রতিদিনের হয়ে জেগে থাকে।
বন্ধুত্বের মাঝে ‘ভোগ’ শব্দটা এসে বাসা বাঁধলে সম্পর্ককে চিরকাল বিনষ্ট করে তুলে। বাঁকা-প্রত্যাশা বা অনৈতিক চাওয়াটুকুর কারণে অনেক সম্পর্কের ফুল ফোটার আগেই ঝরে যায়!
ভোগহীন সম্পর্ক মানব-মানবীর গোপন বন্ধুত্বকে চিরকাল বাঁচিয়ে রাখে।
এই সময়ের দিনরাতে বাস করতে করতে আমরা মাঝে মাঝে নিজেদের চেতনা হারিয়ে ফেলি! আত্মসংযম, আত্মগৌরব প্রভৃতি শব্দগুলো হারিয়ে ফেলি ক্রমশই। আমরা ভুলে যাই পুরুষ মানেই ক্ষতিকর অস্তিত্ব নয়। পুরুষ মানেই লোলুপ দৃষ্টি নয়।
প্রযুক্তির মহাব্যবহারের এই আত্মসংকটে একমাত্র আশ্রয়, পরম নির্ভরতা রবীন্দ্রনাথ। তার গান, তার কবিতা, তার প্রতিটি লাইন আমাদের দিকভ্রান্ত মনুষ্যত্বকে সদা জাগ্রত করে। জাগিয়ে রাখে আমার আমি-কে। আমাদের মনের ভেতরের সেই অদেখা অন্ধকার মানুষটা ধীরে ধীরে মরে যায়। জেগে ওঠে আত্মগৌরবে বলিয়ান এক নির্মল মানুষ।
কুরুচির কালি যাকে কখনো আর স্পর্শ করতে পারে না। গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে যে মানুষটির প্রয়োজন ধরা পড়ে বারবার। শরীরহীন ভালোবাসাটুকু বন্ধুত্বের নির্মল সম্পর্ককে সগৌরবে মাথায় তুলে রাখে চিরকাল।
রবীন্দ্রনাথের ‘আমরা দুজনা স্বর্গ-খেলনা’ গানের অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো-
“রুক্ষদিনের দুঃখ পাই তো পাবো
চাই না শান্তি, সান্ত্বনা নাহি চাবো
পাড়ি দিতে নদী হাল ভাঙে যদি, ছিন্ন পালের কাছি
মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিবো তুমি আছো, আমি আছি। ”
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৪ ঘণ্টা, আগস্ট ০৬, ২০১৬
বিবিবি/এইচএ/