ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

মুক্তমত

ফিরে ফিরে দেখা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯০৭ ঘণ্টা, আগস্ট ২৬, ২০১৬
ফিরে ফিরে দেখা

আশির দশকে কোনো একসময়ে আমি আমেরিকা থেকে দেশে বেড়াতে এসেছি। রিকশা করে কোনো এক জায়গায় গিয়ে আমি রিকশা থেকে নেমে মানিব্যাগ থেকে একটা দশ টাকার নোট নিয়ে রিকশাওয়ালাকে দিয়ে হাঁটতে শুরু করেছি, তখন শুনলাম পিছন থেকে রিকশাওয়ালা আমাকে ডাকল।

ঘুরে তাকিয়ে দেখি রিকশাওয়ালা লাল রংয়ের দশ টাকার নোটটা দুই হাতে ধরে সেটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আমাকে বলল, “স্যার এইটা কী দিলেন? এই নোট তো বাংলাদেশে চলে না!”

ছিয়াত্তরে দেশ ছেড়ে যাওয়ার সময় মানিব্যাগে দেশের কিছু নোট ছিল, সেই নোট এতদিন ব্যবহার হয়নি। মানিব্যাগ থেকে সেই নোট বের করে রিকশা ভাড়া দিয়েছি– আমি জানতাম না এই দেশে নোটগুলো অচল হয়ে গেছে। নোটগুলোর দোষ কী? দোষ একটাই, সেই নোটে বঙ্গবন্ধুর ছবি!

পঁচাত্তরে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর এই দেশ থেকে বঙ্গবন্ধুর শেষ চিহ্নটিও মুছে ফেলার জন্যে যে বিশাল আয়োজন শুরু হয়েছিল আমি সেটা তখনও সেভাবে জানতাম না। আমি চুরানব্বইয়ের শেষে পাকাপাকিভাবে দেশে ফিরে এসেছি। তখনও রেডিও-টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধুর কোনো উপস্থিতি নেই। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকে দেখানো হয় না, এই দেশের মানুষ, ছেলেমেয়ে, ছাত্রছাত্রীরা হয়তো বঙ্গবন্ধুর চেহারা কেমন সেটাও জানে না। আমি অবাক হয়ে দেখি এটি কী হয়ে গেল দেশের?

তখন ছিয়ানব্বইয়ের নির্বাচন হল, একুশ বছর পরে প্রথমবার আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসেছে। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর আমি আমার স্ত্রীকে বললাম– “চল, দোকান থেকে একটা টেলিভিশন কিনে আনি, এখন টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধুকে দেখাবে। ”

আমি আর আমার স্ত্রী একজন সহকর্মীকে নিয়ে দোকান থেকে একটা টেলিভিশন কিনে আনলাম। বাসায় এসে সেই টেলিভিশন ‘অন’ করা হল এবং সত্যি সত্যি আমরা প্রথমবার টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধুকে দেখতে পেলাম!

একটি দেশ আর একটি মানুষ সমার্থক হতে পারে কি না জানি না, বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধুর বেলায় সেটি কিন্তু হয়েছিল। অথচ সেই বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রযন্ত্র একদিন নয়, দুদিন নয়, একুশ বছর সকল প্রচারমাধ্যম থেকে সরিয়ে রেখেছিল। নিজের চোখে দেখেও সেটা বিশ্বাস হয় না।

বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার মতো নৃশংস ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে খুব বেশি নেই। কিন্তু একজন দেশের স্থপতিকে সেই দেশের মানুষের কাছে থেকে আড়াল করে রাখার মতো ঘটনাও কি পৃথিবীতে খুব বেশি আছে? বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েই ঘাতকদের কাজ শেষ হয়নি। এই দেশের মাটি থেকে তাঁর স্মৃতি পুরোপুরি সরিয়ে দিয়ে তাদের দায়িত্ব শেষ হবে। যারা ট্রিগার টেনে গুলি করেছে শুধু তারাই ঘাতক, অন্যেরাও কি অন্য রকম ঘাতক নয়?

শেষ বার আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর পাঠ্য বইগুলো থেকে ইতিহাস বিকৃতি দূর করার জন্যে যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আমিও তাদের মাঝে ছিলাম। আমি তখন একসাথে আমাদের স্কুল, কলেজের সব পাঠ্যবই দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমরা সবাই মিলেই পাঠ্যবই থেকে ইতিহাস নিয়ে বিচিত্র এক ধরনের মিথ্যাচার সারিয়ে সঠিক ইতিহাসগুলো বসিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় কথাগুলো লিখেছি, হানাদার বাহিনী যে আসলে পাকিস্তানের মিলিটারি সেটা স্পষ্ট করে দিয়েছি, বঙ্গবন্ধু ছাড়া যে বাংলাদেশের জন্ম হত না সেটা সবাইকে জানিয়েছি।

মনে আছে, এরপর একটা সময় গিয়েছে যখন ছেলেমেয়েগুলো একধরনের বিভ্রান্তিতে ভুগেছে, এতদিন একটা বিষয় জেনে এসেছে, এখন অন্য বিষয় জানছে, আসলে কোনটা সত্যি?

মাঝে মাঝেই তারা জিজ্ঞেস করত–
“স্যার, স্বাধীনতার ঘোষক কে?”

এরপর অনেকদিন পার হয়েছে, পাঠ্যবইগুলো অনেকবার পড়া হয়েছে। রেডিও-টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধুর কথা শুনছে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানছে এবং শেষ পর্যন্ত আমরা হয়ত এই দেশের ছেলেমেয়েদের বিভ্রান্তি দূর করতে পেরেছি। ইদানীং আর কেউ আমার কাছে স্বাধীনতার ঘোষক কে সেটি জানতে চায় না।

আগস্ট মাস বাংলাদেশের জন্যে একটা অশুভ মাস। ১৯৭৫ সালে এই মাসের ১৫ তারিখ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকারীরা সেখানেই থেমে যায়নি, জেলে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে পুরোপুরি নেতৃত্বশূন্য করার চেষ্টা করেছিল।   অনেক বছর সময় নিয়ে যখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আবার পুর্নগঠিত হয়েছে, তখন ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে আবার আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার চেষ্টা করেছে। শেখ হাসিনা অলৌকিকভাবে বেঁচে গেছেন এবং আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, শুধুমাত্র সে কারণেই আমরা বাংলাদেশের মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পেরেছি।

আগস্ট মাস ছাড়াও এই দেশে বোমা হামলা হয়েছে– সিপিবির মিটিংয়ে, উদীচীর অনুষ্ঠানে কিংবা ছায়ানটের নববর্ষের অনুষ্ঠানে। তবে সেগুলো কোনো নির্দিষ্ট মানুষকে লক্ষ্য করে হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের বড় নেতাদের হত্যা করার ঘটনা দুটিই ঘটেছে আগস্ট মাসে। আগস্ট মাস অন্য যে কোনো মাসের মতোই নিরীহ একটা মাস হতে পারত কিন্তু সেটি হয়নি। লক্ষ্য ঠিক করে হত্যাকাণ্ডগুলো কেন বেছে বেছে আগস্ট মাসে ঘটানো হয়; সে ব্যাপারে আমার নিজের এক ধরনের থিওরি আছে।

বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে ঘাতক রাষ্ট্র পাকিস্তানকে পরাজিত করে। পরাজয়ের সেই অপমান পাকিস্তান যেরকম ভুলতে পারেনি, ঠিক সেরকম ভুলতে পারেনি পাকিস্তানের পদলেহী যুদ্ধাপরাধীরা। তাই তারা যখন বাংলাদেশের উপর আঘাত হানতে চায় তখন বেছে নিতে চায় পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসটিকে। সেটি সম্ভব না হলে অন্তত পাকিস্তানের জন্ম মাসটিকে! সে জন্যে নিরীহ একটা মাস এই দেশের জন্যে অশুভ একটা মাস হিসেবে চিরদিনের জন্যে চিহ্নিত হয়ে গেল।

১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের কারণে আমরা মানুষের চরিত্রের আরও বিচিত্র দিকগুলো নিজের চোখে দেখার সুযোগ পেয়েছি। কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ একদিন আমরা সবিস্ময়ে আবিষ্কার করলাম, বেগম খালেদা জিয়া এই দিনটিতে তাঁর জন্মদিনের উৎসব পালন করতে শুরু করেছেন। শুধু তাই নয়, তাঁর দলের লোকজন মিলে বিশাল বিছানার মতো সাইজের কেক কাটতে শুরু করেছেন? যাদের সত্যি সত্যি ১৫ আগস্ট জন্মদিন তারাও এই দিনটিতে জন্মদিনের উৎসব পালন করতে সংকোচ বোধ করে।

আমি কয়েকদিন আগে একটা ছোট বাচ্চার চিঠি পেয়েছি। বাচ্চাটি আমার কাছে জানতে চেয়েছে– ১৫ আগস্ট তার জন্মদিন; এই দিনটিতে তার জন্মদিন পালন করা ঠিক হবে কি না!  একটি ছোট বাচ্চা যে বিষয়টি বুঝতে পারে বেগম খালেদা জিয়া, তার দলের শত শত নেতা সেই বিষয়টি বুঝতে পারেন না; এর চাইতে দুঃখের ব্যাপার আর কী হতে পারে? বেঁচে থাকতে হলে আমাদের নানা কিছু দেখতে হয় শুনতে হয়, কিন্তু যে দিনটিতে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে সেই দিনটিতে নূতন করে জন্মদিন তৈরি করে বিছানার মতো সাইজের কেক কাটার মতো করুচিপূর্ণ কিছু আমি আমার জন্মে দেখিনি। মনে হয় ভভিষ্যতেও কোনোদিন দেখব না।

বহু বছর পর এইবার বেগম খালেদা জিয়ার ‘জন্মদিনে’ বিছানার সাইজের কেক কাটা হয়নি। খবরটা শুনে আমি ভেবেছিলাম শেষ পর্যন্ত তাদের রাজনৈতিক দলটির সুমতি হয়েছে। কিন্তু পুরো খবরটা পড়ে জানতে পারলাম দেশে বন্যা, জঙ্গি হামলা, গুম-খুন, রাজনৈতিক নির্যাতন এইসব চলছে বলে এই বছর উৎসবটি পালন করা হচ্ছে না। যার অর্থ বন্যার পানি নেমে গেলে, জঙ্গি হামলা না থাকলে গুম-খুন নির্যাতন বন্ধ হয়ে গেলে ১৫ আগস্ট বিছানার মতো বড় কেক কাটতে কোনো বাধা নেই!

আমি মোটেও রাজনৈতিক বিশ্লেষক নই, রাজনীতির মারপ্যাঁচ আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব না। কিন্তু পৃথিবীর অন্য অনেক কিছুর মতোই রাজনীতিতেও ‘কমন সেন্স’ আছে এবং শুধুমাত্র এই কমন সেন্স দিয়ে বুঝতে পারি, মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করে এই দেশে কেউ রাজনীতি করতে পারবে না।   যে জামায়াতে ইসলামী সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে সেই জামায়াতে ইসলামীর সাথে জোন করে বিএনপি নির্বাচনে জিতে এসে সরকার গঠন করেছিল। সেটি ছিল একটা খুবই বিপজ্জনক সময়! একজন বিএনপি নেতার কাছে শুনেছি, সেই সময়ে রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা সরকারের কাছে তাদের একাত্তর সালের বকেয়া বেতন দাবি করেছিল! জামায়াত-বিএনপি সরকার তাদের বকেয়া বেতন পরিশোধ করেছিল কি না আমার জানা নেই।

সেই ভয়াবহ সময়টা আমরা পার করে এসেছি, ভবিষ্যতে যেন ভুল করেও এই দেশে এ রকম ঘটনা আবার ঘটে না যায় সেটা আমাদের নিশ্চিত হওয়া দরকার। আমি বড় বড় সুশীল ব্যক্তিদের ‘গণতন্ত্র’, ‘গণতন্ত্র’ বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলতে দেখি, কিন্তু সেই গণতন্ত্র যে হতে হবে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের গণতন্ত্র সেটি কাউকে বলতে দেখি না। এই দেশটি তো আমরা লটারির টিকেট কিনে কিংবা জুয়া খেলে পাইনি! রীতিমতো যুদ্ধ করে রক্ত দিয়ে পেয়েছি। কাজেই যে উদ্দেশ্য নিয়ে যুদ্ধ করা হয়েছে, রক্তের বন্যা বইয়ে দেওয়া হয়েছে– সেই উদ্দেশ্যটি ভুলে গিয়ে রাজাকারদের বকেয়া বেতন দেওয়ার একটা সরকার তৈরি করার জন্যে গণতন্ত্র চাইলে তো হবে না!

অবশ্যই আমরা গণতন্ত্র চাই, কিন্তু সেই গণতন্ত্রে সরকার গঠনের দলটিকে হতে হবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এবং বিরোধী দলটিকেও হতে হবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের। নির্বাচনের সময় আমরা রাতে শান্তিতে ঘুমোতে চাই যেন সকালে উঠে কে নির্বাচনে জিতেছে সেটা নিয়ে আমাদের কোনো দুর্ভাবনা না থাকে। যেই সরকার গঠন করবে তাকেই হতে হবে আমাদের বাংলাদেশের সরকার, মুক্তিযুদ্ধের সরকার।

এই দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আমাদের আরও একটা বিষয় নিশ্চিত করার ব্যাপার আছে। সেটি হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান এবং ভালোবাসাটুকু দেওয়া। পৃথিবীর কত দেশে কত জাতীয় নেতা আছেন। তাদের দেশের মানুষ সেই জাতীয় নেতাদের সম্মান করে নিজেরা সম্মানিত হয়। পৃথিবীর সেইসব নেতাদের সাথে যদি বঙ্গবন্ধুর তুলনায় তাদের অনেকের অবদান রীতিমতো ম্লান। সারা পৃথিবীর মাঝে একজন সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা হচ্ছেন ফিদেল কাস্ত্রো, তিনি প্রথমবার বঙ্গবন্ধুকে দেখে তাঁকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন–

“আমি হিমালয়কে দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি!”

এই হিমালয়কে আমাদের সারা পৃথিবীর সামনে তুলে ধরার কথা অথচ আমরা শিহরিত হয়ে আবিষ্কার করি– তাঁকে যে শুধু সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে তা নয়, হত্যাকারীদের পুরস্কৃত করা হয়েছে; বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে তাঁর সকল স্মৃতি সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। কাজেই আমি মনে করি, বাংলাদেশে রাজনীতি করতে চাইলে শুধু যে মুক্তিযুদ্ধকে বিশ্বাস করতে হবে তা নয়, বঙ্গবন্ধুকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দিতে হবে। তার কারণ, বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধু আসলে সমার্থক দুটি শব্দ। বঙ্গবন্ধুকে ভালো না বেসে বাংলাদেশকে ভালোবাসা যায় না।

বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্যে যে টেলিভিশনটি কেনা হয়েছিল সেটি সিলেটে আমার বাসায় নেই। তাই এখন টেলিভিশন দেখা হয় না সেটি অনেকেই জানে। টেলিভিশনে দেখার মতো কিছু থাকলে অনেকেই তার একটি লিংক পাঠায়।   সেদিন একজন চ্যানেল আইয়ে কর্নেল অলি আহমদের সাক্ষাৎকারের একটা লিংক পাঠিয়েছে। লিংকে পুরো সাক্ষাৎকারটি নেই। সাক্ষাৎকারের মাঝখানে একটি মেয়ের টেলিফোনে কর্নেল অলি আহমদকে উদ্দেশ্য করে বলা কিছু প্রশ্ন, কিছু কথাবার্তা আছে। আমার মনে হয় সবারই এই মেয়েটির কথাগুলো শোনা উচিৎ। তার কণ্ঠস্বর শুনে তাকে কমবয়সী একজন তরুণী মনে হয়েছে কিন্তু সে এত চমৎকারভাবে এতটুকু উত্তেজিত না হয়ে এত গুছিয়ে কথাগুলো বলেছে যে আমি মুগ্ধ হয়ে শুনেছি। আমি যদি তার বক্তব্যটুকু এখানে লেখার চেষ্টা করি তার মতো গুছিয়ে পরিস্কারভাবে লিখতে পারব না; তাই তার চেষ্টাও করছি না।

মেয়েটির বক্তব্য শুনে বুঝতে পারলাম কর্নেল অলি আহমদ এই সাক্ষাৎকারে জিয়াউর রহমানকে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ হিসেবে দাবি করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে বীর বিক্রম উপাধী পাওয়া কর্নেল অলি আহমদের প্রতি পুরো সম্মান বজায় রেখে মেয়েটি তাঁকে অনুরোধ করেছে– নির্জলা মিথ্যা বলে নূতন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত না করার জন্যে। বঙ্গবন্ধু কবে কীভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন, সেটি কীভাবে প্রচারিত হয়েছে, ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর কোন সংখ্যায় সেই ঘোষণাটির কথা ছাপা হয়েছে; মেয়েটি অলি আহমেদকে জানিয়েছে।

শুধু তাই না, জিয়াউর রহমান ২৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণাটিতে কী বলেছেন মেয়েটি গড়গড় করে সেটি শুনিয়ে দিয়েছে। সেখানে ঘোষণাটি যে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে দেওয়া হয়েছিল সেটি মনে করিয়ে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, ঘোষণা দেওয়া আর ঘোষণা পাঠ করার মাঝে যে দিন-রাত পার্থক্য সেটি পরিস্কারভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে। মেয়েটি কর্নেল অলি আহমদকে প্রশ্ন করেছে, সত্যিই যদি মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে থাকেন তাহলে সেটি কেন তারা ১৯৭২ সালে যখন স্বাধীনতার দলীলপত্র সংকলিত করা হয়েছে সেখানে বললেন না, কিংবা যখন সংবিধান লেখা হয়েছে তখন জানালেন না। কেন সেটি ১৯৯১ থেকে শুরু হল?

আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লেগেছে যখন মেয়েটি বিস্ময়কর আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলেছে–
“আমরা নূতন প্রজন্মের মানুষ, স্বাধীনতার সব তথ্য আমাদের হাতের মুঠোয়– আমরা সব জানি!” শুধু তাই নয়, কমবয়সী একটি মেয়ে বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদকে উপদেশ দিয়ে বলেছে, আপনারা রাজনীতি করতে চান করুন, সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে রাজনীতি করুন, কেন আপনারা বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করতে চান?

আমি আগেই বলেছি আমি শত চেষ্টা করলেও এই নূতন প্রজন্মের তরুণীটির মতো করে বলতে পারব না। শুধু এইটুকু বলব যে এই নূতন প্রজন্মকে দেখে, তাদের কথা শুনে মনে হয়েছে তাদের হাতে আমরা নূতন বাংলাদেশের দায়িত্ব দিয়ে পরম নির্ভরতায় বিশ্রাম নিতে পারি। নূতন প্রজন্মকে আমি এতদিন শুধু ভালোবাসা জানিয়ে এসেছি, এখন আমি তাদেরকে শ্রদ্ধাও জানাতে চাই!

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।