চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং দুই দিনের সফরে এখন বাংলাদেশে। এটি প্রায় তিন দশক পর কোনো চীনা শীর্ষ নেতার বাংলাদেশ সফর।
চীনের সাথে বাংলাদেশের রয়েছে ঐতিহাসিক সম্পর্ক যা দুই হাজার বছরেরও পুরোনো। চীনের অনেক পর্যটকেরা এখানে এসেছেন, বিভিন্ন বৌদ্ধবিহারে ধর্মশিক্ষা নিয়ে গেছেন। আবার এখান থেকে চীনেও গেছেন অতীশ দীপংকর। ফা হিয়েন, হিউয়েন সাং, অতীশ দিপংকর, এডমিরাল চাং হ সবাই এই ঐতিহাসিক সম্পর্কের পথিকৃত। ইতিহাস বলে, এডমিরাল চাং হ চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছিল। তখন বাংলার শাসক সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজমশাহ। কাজেই সম্পর্কে এ ঐতিহাসিক ভিত্তি অত্যন্ত গভীরে প্রথিত।
বৃটিশ শাসনামলেও সে সম্পর্ক অব্যহত ছিল।
পাকিস্তান আমলে ১৯৫২ ও ১৯৫৭ সালে বঙ্গবন্ধু চীন সফর করেন। মওলানা ভাসানীতো গিয়েছেনই। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় চীন বলেছিল, যদি বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) আক্রান্ত হয় তবে চীন আমাদের পাশে থাকবে। সে সময় ঢাকা ঘুরে গেছেন রাষ্ট্রপতি লি শাওছি।
বাংলা-চীনের সম্পর্কে প্রথম বিভেদটি দেখা দেয় মুক্তিযু্দ্ধের সময়। এমনকি স্বাধীনতার পর আমাদের জাতিসংঘ সদস্যপদেও বাধা দিয়েছিল চীন। এটি দুই দেশের সম্পর্কের একটি অন্ধকার অধ্যায়।
কিন্তু স্বাধীনতার পরই চীনের সাথে সম্পর্ক পুন:প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু সে উদ্যোগ নেন। কিন্তু পচাঁত্তরের হত্যাকাণ্ডের পর তা সফল হয়নি। ১৯৭৮ সালে ভাইস প্রেসিডেন্ট লি শিয়েননিয়েনই প্রথম বাংলাদেশে আসেন। এরশাদের সময় শিয়েননিয়েন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে আবার তিনি ঢাকায় আসেন।
নব্বই দশকে এ সম্পর্ক আরো জোরদার হয়। প্রথম মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের পরই চীন সফর করেন শেখ হাসিনা।
চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। বিশ্লেষকরা মনে করেন, ২০২০ সালের মধ্যেই চীন সর্ববৃহৎ অর্থনীতিতে পরিণত হবে। শুধু এ প্রেক্ষাপটটি বিবেচনায় নিলেও আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যত অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক সুদৃঢ় করার বিকল্প নেই।
রাষ্ট্র হিসেবে আমরা ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয়’ এই নীতিতে বিশ্বাস করি। একমুখী পররাষ্ট্র নীতি বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার সাথে সাংঘর্ষিক। শীতলযুদ্ধ পরবর্তী বিশ্বে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। এক সময় বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোই তাদের মাঝে সম্পর্কের টানাপোড়েনে ভুগতো। কিন্তু এখন ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোও এর সাথে জড়িয়ে পড়েছে। তাই ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোকে যথেষ্ট সতর্কতার সাথে পা ফেলতে হয়। তবে আমাদের জন্য এ প্রক্রিয়াটি যথেষ্ট সহজ, কারণ ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র-এ তিনটি দেশের সাথেই আমাদের রয়েছে বন্ধুত্বের ঐতিহাসিক ভিত্তি।
কাজেই চীনের সাথে আমাদের বন্ধুত্বে ভারতের নাখোশ হওয়ার কারণ নেই। তেমনি আমেরিকার সাথে বন্ধুত্বেও চীনেরও নাখোশ হওয়ার কিছু নেই। ‘শত্রুর বন্ধুও শত্রু’ তত্ত্ব এখানে প্রযোজ্য নয়। ঠিক একই কারণে চীনের সাথে সম্পর্ক মানেই পাকিস্তানের সাথে বন্ধুত্ব না (যদিও চীন-পাকিস্তানের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে গভীর)।
মধ্যপ্রাচ্য বা ইউরোপের দেশগুলোর মতো আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘কৌশলগত’ বিষয়টি মূখ্য নয়। আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘অর্থনৈতিক’ দিকই মূল বিবেচ্য। তবে, বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় পরাশক্তিগুলো সম্পর্কের ক্ষেত্রে শুধু অর্থনৈতিক বিষয়ই বিবেচনা করে না, ‘কৌশলগত’ বিষয়টিও বিবেচনা করে।
এ প্রেক্ষাপটেই চীনা প্রেসিডেন্ট আজ বলেছেন, “ আমরা এই দুই দেশের সম্পর্ককে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা ও অংশীদারিত্বের জায়গা থেকে কৌশলগত সহযোগিতা ও অংশীদারিত্বের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে কাজ করবো। আগামী দিনগুলোতে এই হবে মূল কাজ”।
সম্পর্কের এই কৌশলগত বিষয় ও অবস্থানটি নির্ণয় করা জরুরি। কারণ, অর্থনৈতিক বিষয়ের সাথে শুধু ব্যবসায়-বাণিজ্য সম্পর্কিত আর ‘কৌশলগত’ বিষয়ের সাথে জড়িত ভূ-রাজনৈতিক, সামরিক, আঞ্চলিক তথা আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট। আমাদের জন্য মূল বিবেচ্য অর্থনৈতিক বিনিয়োগ। রাষ্ট্রপতির এ সফরে ২৬টি চুক্তি সাক্ষর হয়েছে। এগুলো আমাদের বিনিয়োগ, মানবসম্পদের উন্নয়ন তথা অর্থনীতির ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে এমনটাই প্রত্যাশা।
বাংলাদেশ সময়: ০৬৪৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৫, ২০১৬