গত ১৮ ডিসেম্বর লিবিয়ায় বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল মো. শাহিদুল হক, পিএসসি (অব.) তার লিবিয়ার কর্মজীবনের সময়সীমা শেষ দেশে প্রত্যাবর্তন করেছেন। মাত্র দুই বছর চার মাস আগে ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে তিনি রাষ্ট্রদূত হিসেবে লিবিয়ায় এসেছিলেন।
এ স্বল্প সময়ের মধ্যেই তিনি জয় করেন শত-শত প্রবাসীর হৃদয়। স্মৃতি রেখে গেছেন অসংখ্য প্রবাসীর মনের মণিকোঠায়। মাত্র দুই বছর চার মাসে আমূল পাল্টে দিয়ে গেছেন দূতাবাস এবং বাংলাদেশ কমিউনিটি স্কুলটির চেহারা। লিবিয়ায় এসেই তিনি দূতাবাসের প্রতিটি ক্ষেত্রে সংস্কার ও সাজসজ্জায় মনোনিবেশ করেন। ফলে দূতাবাসটি হয়ে ওঠে অত্যাধুনিক ও জাঁকজমকপূর্ণ। যে কোনো উন্নত দেশের দূতাবাসের সঙ্গে এখন আর তেমন কোনো পার্থক্যই খুঁজে পাওয়া যায় না।
সেবার উদ্দেশ্যে জনসাধারণের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ স্থাপনের জন্য তিনি দূতাবাসের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ, ওয়েবসাইট চালু ও ২৪ ঘণ্টা হটলাইন সেবা চালু করেন। এতে প্রতিনিয়ত বিপদগ্রস্ত প্রবাসীরা তাদের সুবিধা-অসুবিধার কথা জানাতে পারছেন এবং পরামর্শ নিতে পারছেন। দূতাবাসের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ক্রমেই কমে আসতে থাকে।
তিনি এসেছিলেন লিবিয়ার চরমতম দুর্যোগপূর্ণ একটি সময়ে। যেখানে রাজনৈতিক পরিস্থিতি সব সময়ই অস্থিতিশীল থাকে। এমন ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে অধিকাংশ দেশের রাষ্ট্রদূতরা নিরাপত্তার খাতিরে দূতাবাস গুটিয়ে অন্যত্র চলে গেছেন। সেখানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শাহিদুল হক দূতাবাসের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে লিবিয়ায় অবস্থান করেছেন। তাদের কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন। এটা নিঃসন্দেহে এই প্রতিকূল পরিবেশেও প্রবাসী বাংলাদেশিদের লিবিয়ায় থেকে যেতে মনোবল জোগায়।
লিবিয়ায় বাংলাদেশ কমিউনিটি স্কুল ও কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৮০ সালে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে একটা সময় পর্যন্ত খুব ভালো অবস্থা থাকলেও, লিবিয়ার বিদ্যমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতির প্রভাব থেকে মোটেও রক্ষা পায়নি স্কুলটি। একদিকে তহবিল সংকট, অন্যদিকে শিক্ষক সংকট। সব মিলে যখন প্রকট অবস্থা ধারণ করলো। তখন স্কুলটির হাল ধরলেন শহিদুল হক।
স্কুলের তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তিনি বিশাল একটি মেলার আয়োজন করলেন। যেটি সেই সময়ের জন্য অতিমাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ ছিলো। যদিও শেষ পর্যন্ত এটি ব্যাপকভাবে সফলতা অর্জন করেছে। দুঃসময়ে এমন দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিয়ে তিনি অন্তত ২/৩ বছরের জন্য স্কুল কমিটিকে তহবিল সংক্রান্ত দুশিন্তা থেকে মুক্তি দেন। পাশাপাশি শিক্ষক সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে তিনি দূতাবাসে কর্মরত স্টাফদের মধ্যে কয়েকজনকে অতিরিক্ত সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেন।
এছাড়া শিক্ষার্থীদের পাঠ-সহায়ক কার্যক্রমের জন্য বেশ কিছু আধুনিক খেলার সরঞ্জামাদিও সরবরাহ করেন। যার কারণে টিফিন পিরিওডের মাঠের পরিবেশ যেন উৎসবের রূপ নেয়।
তার পৃষ্ঠপোষকতায় সম্প্রতি প্রথমবারের মতো স্কুল ও কলেজ থেকে একটি স্কুল ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়েছে। যেটি বর্তমান পরিস্থিতিতে এতো স্বল্প সংখ্যক শিক্ষার্থী নিয়ে সম্পূর্ণ অকল্পনীয় একটি ব্যাপার ছিল। সেই অসাধ্যও সাধন করে গেছেন তিনি। স্কুল লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা এবং নিজস্ব জমিতে স্কুল স্থাপনসহ আরও বেশ কিছু পদক্ষেপের শুরুটা করে গেছেন কাজপ্রেমী মানুষ শহিদুল।
জাতীয় দিবসগুলো উদযাপন করতেও তার উৎসাহের কমতি ছিলো না। বিশেষ করে তার সহধর্মিণী নিজেই উপস্থিত থেকে শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দিতেন। তাদের পরশ পেয়ে স্কুলের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এক ভিন্নমাত্রা যোগ হয়।
এক কথায়- প্রবাসীদের জন্য বিভিন্ন কল্যাণমূলক কাজ ছাড়াও দূতাবাস, স্কুল ও কলেজের উন্নয়নের ক্ষেত্রে তিনি এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এনে দিয়ে গেছেন কর্তব্যনিষ্ঠ ও পরিশ্রমী শাহিদুল হক।
বাংলাদেশ কমিউনিটির কোথায় কী হচ্ছে? কে কী করছে? কোথায় কী হওয়া উচিত? কোন কাজটা কাকে দিয়ে কীভাবে করালে পারফেক্ট হবে। এরকম প্রতিটা ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র বিষয়েও তার দৃষ্টি ছিল অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। তার সরব উপস্থিতি লিবিয়ার প্রবাসী বাংলাদেশিরা কখনও ভুলতে পারবেন না। তাই তার সম্মানে লিবিয়ার বাংলাদেশ কমিউনিটি ও স্কুল কর্তৃপক্ষ এক মনোরম বিদায় সংবর্ধনার আয়োজন করে| সব সময় হাস্যোজ্জ্বল ও কল্যাণকামী রাষ্ট্রদূত শহিদুল হক ও তার স্ত্রীকে আবেগাপ্লুত হয়ে বিদায় জানান লিবিয়া প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৪০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১, ২০১৬
টিআই