ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

কেন এই সড়ক তাণ্ডব?

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৪৭ ঘণ্টা, মার্চ ১, ২০১৭
কেন এই সড়ক তাণ্ডব? ড. মাহফুজ পারভেজ

সড়কে বিদ্যমান ধর্মঘট-অসহযোগ-অচলাবস্থা দিয়ে শুরু হয়েছে ২০১৭ সালের মার্চ মাস। যদিও ১৯৭১ সালের অগ্নিঝরা মার্চ মাসের সঙ্গে এই মার্চের সময় ও পরিস্থিতির দিক দিয়ে গুণগত অর্থে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে, তথাপি সড়ক-মহাসড়কে চলমান নারকীয় ধর্মঘট-অসহযোগে অসহায় ও জিম্মি দশায় সাধারণ মানুষ। ১৯৭১ সালে অসহযোগ ছিল স্বতঃস্ফূত, ২০১৭ সালের অচলাবস্থা আরোপিত। পূর্ব ঘোষণাহীন এবং অন্যায় দাবি আদায়ের আইন-বহির্ভূত-বলদর্পী প্রচেষ্টা। জাতির মুক্তি ও স্বাধীনতার স্মৃতিধন্য মার্চের অমলিন বীরত্ব ও ঐতিহ্যকে কলুষিত করার একটি ঘৃণ্য অপচেষ্টা।

সবাই ইতিমধ্যে সড়কে চলমান তা-বের নেপথ্য কারণ সম্পর্কে জেনেছেন। বাসচালক ও অভিযুক্ত-ঘাতক জামির হোসেন এবং চালক মীর হোসেন কারাগার থেকে প্রমাণ করলেন, তারাই এদেশে ‘ঐক্যের-প্রতীক’।

আদালতের রায় উপেক্ষা করে চলমান ধর্মঘট ও অসহযোগকে পরিবহণ সেক্টরের একটি ‘নেতিবাচক-ঐক্য’ ছাড়া অন্য কোনো নাম দেওয়া যায় না। জামির-মীর গোষ্ঠী ছাড়া অন্য কারো জন্য এদেশে এমন ‘প্রলয়ঙ্করী-ঐক্য’ দেখা গেছে? আইন-আদালত-প্রশাসনকে অবজ্ঞা করে যদি এমন ‘অন্যায্য-ঐক্য’ অব্যাহত থাকে এবং কোনোক্রমে সফল হয়, তাহলে সমাজব্যবস্থায় একটি মারাত্মক অপধারার শক্তি বাড়বে। চালকেরা আর চালক থাকবেন না, খুনের লাইসেন্সধারীতে পরিণত হয়ে চরম বেপরোয়া ও ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করবেন। তাদের দৌরাত্ম্যে মানুষের নাভিশ্বাসের উপক্রম হবে। যাত্রীরা পরিণত হবেন জিম্মিতে।    


এ কথা বলতেই হয় যে, বাংলাদেশে সড়ক দুঘর্টনার হার বৃদ্ধির পেছনে মহাসড়কে চালকদের বেপরোয়া আচরণই শুধু দায়ী নয়, শাসন ব্যবস্থার প্রতি তাদের চরম অসহিষ্ণু মনোভাব এবং প্রচ- অমান্যতাও একটি অন্যতম কারণ বটে। মানুষ তো বটেই কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গেও তারা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যপূর্ণ আচরণ করেন। প্রচলিত ট্রাফিক আইন এবং নিয়ম-শৃঙ্খলা মানতেই চান না। যত্র-তত্র পার্কিং, বিপজ্জনক ওভারটেকিং ইত্যাদি তো নৈমিত্তিক ঘটনা। পরিবহন সেক্টরের সঙ্গে জড়িতদের ‘কুছ পরোয়া নেহি’ মনোভাবে চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশই হলো ‘অন্যায় করেও শাস্তির বাইরে থাকার ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ’, যা তাদের অকস্ম্যাৎ ধর্মঘট ডাকা এবং সড়কে নৈরাজ্যপূর্ণ অচলাবস্থা সৃষ্টির অপচেষ্টার মধ্যেই সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়েছে।


সাধারণত বিচারাধীন বিষয়ে কিছু করা দূর অস্ত, মন্তব্য করাও সমীচিত নয়। সেখানে আইনকে নিজেদের ইচ্ছা ও পছন্দ মতো চলার দাবি উত্থাপন রীতিমতো ধৃষ্টতা। এবং দাবী আদায়ের জন্য যে পন্থা অবলম্বন করা হচ্ছে, সেটা সম্পূর্ণভাবে বেআইনি ও অগ্রহণযোগ্য। এর ফলে বিগত মধ্য রাত পর্যন্ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অসংখ্য মানুষ ভীতিকর অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন। মিডিয়ায় অচলাবস্থার ভয়াবহ খবর পাওয়া গেছে। গাবতলী থেকে আমিন বাজার পর্যন্ত রাস্তা যান-শ্রমিকদের দখলে। দক্ষিণ বঙ্গ ও পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগ স্বাভাবিকভাবেই অক্ষূণœ নেই। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ সমগ্র উত্তর চট্টগ্রামের একমাত্র পথটি সারা দিন বন্ধ করে রাখে ‘আন্দোলনকারীরা’। আলাপ-আলোচনার বহু চেষ্টা করা হলেও তারা ভ্রুক্ষেপ করেন নি। পরীক্ষার্থী, নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও রোগীদেরকেও রেয়াত দেওয়া হয় নি। রাজশাহীতে ধর্মঘটি শ্রমিকরা তা-ব প্রদর্শন করেছে। সেখানে রোগিবাহী অ্যাম্বুলেন্স আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। রাজধানী ঢাকার অবস্থা আরো ভয়াবহ ও শোচনীয়। কর্মক্ষেত্রে আসা-যাওয়ার পথে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার হাজার হাজার মানুষ চরম ভোগান্তির শিকার হন।   পুলিশের রেকারসহ কমপক্ষে সাতটি অ্যাম্বুলেন্স ভাঙচুরের ঘটনা সংবাদ মাধ্যমে এসেছে। দাবী আদায়ের আন্দোলনের নামে যে চরম অরাজকতা ও অমানবিকতা প্রদর্শিত হচ্ছে ও পুরো কার্যক্রমটিই যে ন্যাক্কারজনক-সহিংসতায় পর্যবসিত হয়েছে, সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সেই কা-জ্ঞানও মোটেই পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এর ফলে বরং সাধারণ মানুষের মধ্যে সন্দেহ উদ্রেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, কোন পূর্ব-ঘোষণা ছাড়া একটি ধর্মঘটে স্বল্প সময়ের মধ্যে এতো সহিংসভাবে অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ ও প্রস্তুতি আন্দোলনকারীরা পেলো কি করে? দেশব্যাপীই তারা তাদের শক্তি ও দাপট প্রদর্শনের সাংগঠনিক দক্ষতা ও সাহসই বা পেলো কোথা থেকে? এহেন আপত্তিকর ও অকস্ম্যাৎ আচরণের পেছনে মদদ দিচ্ছে কে বা কারা? নাকি আন্দোলনের মধ্যে সন্ত্রাসী-নাশকতাকারী গোষ্ঠীর এজেন্টরা অনুপ্রবেশ করে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করছে? এসব প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়া খুবই স্বাভাবিক। কারণ, পরিবহণ শ্রমিকরা মূলত একটি পেশাজীবি ও ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন। প্রকাশ্যে সুপরিকল্পিত ও সুসংহত তাণ্ডব ও সহিংসতা পরিচালনার ট্রেনিং তারা কবে ও কোথা থেকে পেলো? এমন ট্রেনিং তো তাদের মতো খেটে-খাওয়া-উপার্জনশীল মানুষের থাকার কথা নয়? মানুষের মধ্যে সারা দিনই এসব প্রশ্ন ও সন্দেহ ঘুরে-ফিরে আলোচিত হয়েছে।  


সকলেই জানেন যে, দাবী আদায়ের জন্য গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চার বৈধ ও নিয়মসিদ্ধ পন্থা আছে। চালক ও পরিবহন সেক্টর ধর্মঘট ও কর্মবিরতিতে যেতেই পারে। কিন্তু অন্যান্য ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক যানবাহন বন্ধ করে মানুষের চলাচলকে ব্যাহত করার অধিকার কারোই থাকতে পারে না। চরম অবস্থাতেও সংবাদ মাধ্যম ও অ্যাম্বুলেন্সসহ কিছু বিষয় আওতামুক্ত রাখার চিরাচরিত রীতিকেও কেউ ভাঙতে পারে না। এবার অ্যাম্বুলেন্সের পাশাপাশি সাংবাদিকদের আক্রমণ করার উদ্বেগজনক খবরও পাওয়া গেছে। এ শুধু দুঃখজনকই নয়, সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য, অমার্জনীয়।     


বাংলানিউজ২৪ গত মধ্যরাতে সংশ্লিষ্টদের বরাত দিয়ে জানিয়েছে যে আজও ধর্মঘট অব্যাহত রাখা হবে। সন্দেহ নেই, খবরটি নাগরিকদের জন্য উদ্বেগজনক। বিরাজমান আতঙ্কজনক পরিস্থিতি আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করার বদলে এক তরফা ধর্মঘটে যাওয়ার ঘোষণা প্রকারান্তরে একটি প্রচ্ছন্ন হুমকীই বটে। এর ফলে সাধারণ মানুষ, ছাত্র ও পেশাজীবিরা বিরক্ত হয়ে ফুঁসে দাঁড়ালে পরিস্থিতির আরো অবনতি হবে। আইন ও বিচারিক কার্যক্রমের ব্যাপারে সড়ক-তা-বে যে সমাধান নেই, আছে আলোচনা ও আইনি লড়াইয়ে, সেই বোধোদয় সংশ্লিষ্টদের মধ্যে উদিত হওয়া দরকার। সরকারের আশু কর্তব্য হলো, অচলবস্থার ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতি যেন আর শোচনীয় না হয় এবং হিংসা ও সংঘাতের দিকে না যায়, তার জন্য এখনই যথাবিহীত ব্যবস্থা গ্রহণ করা। পরিস্থিতি আরো নাজুক ও স্পর্শকাতর হয়ে গেলে মতলববাজ-স্বার্থবাদী-চক্র ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের অপচেষ্টা করতে পারে, যা কথিত আন্দোলনকারীদের জন্য সুখকর হবে না। অতএব সড়ক-তা-ব বন্ধ করে নিয়মতান্ত্রিকতায় ফিরে আসা নিজের মঙ্গলের জন্যই সংশ্লিষ্টদের জরুরি কর্তব্য হওয়া উচিত।    

বাংলাদেশ সময়: ০৬৪৩ ঘণ্টা, মার্চ ০১, ২০১৭
বিএস        

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।