ঢাকা, শুক্রবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

সুফি মিজানের জন্মদিন

আজীবন গেয়ে যেতে চান জীবনের জয়গান

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩৩৫ ঘণ্টা, মার্চ ১০, ২০১৭
আজীবন গেয়ে যেতে চান জীবনের জয়গান সুফি মিজানুর রহমান

 ক্লাস সিক্স পর্যন্ত বাবাই তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতেন। পড়তে বসাতেন। বাড়ির পুকুরের ঘাটে নিয়ে নিজ হাতে গোসল করাতেন। হাত ধরে স্কুলেও নিয়ে যেতেন।স্কুল ছুটির পর বের হয়ে দেখতেন বাবা তাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। এই হলো তার ছোটবেলার কাহিনী। কয়েক বছর পর হঠাৎ মা মারা গেলেন। সচ্ছল আর সুখী সংসারে শুরু হল অর্থের টানাপোড়েন। বাবা অসহায়,একইসঙ্গে দিশেহারাও।
 

ছেলে তখন মেট্রিক পাশ করলো। নিজের খরচ নিজে জোগাড় করছে, পড়ার খরচও।

এভাবে বিএ পাস করার পর চাকরি হলো নারায়ণগঞ্জের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। মাসে বেতন ১০০ টাকা। ৫০ টাকা নিজে রাখতেন আর ৫০ টাকা পাঠাতেন বাবার জন্য। এভাবে চলতে থাকলো। তারপর ব্যাংকে চাকরি নিয়ে চট্টগ্রাম চলে এলেন। বিয়ে করলেন। ঘর আলো করে জন্ম নিল প্রথম ছেলে। সেই ছেলের জন্মের অনুষ্ঠানে আত্মীয়-স্বজনরা মিলে যা দিলেন, তা যোগ করে দাঁড়াল ১ হাজার ৪৮৩ টাকা।
 
সাফল্যের গল্প শুরু এখান থেকেই। এই গল্পের নায়ক সুফি মিজানুর রহমান। দেশের অন্যতম শিল্প প্রতিষ্ঠান পিএইচপি ফ্যামিলির প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান। ১৯৪৩ সালের ১২ মার্চ তিনি জন্মগ্রহণ করেন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে। তার বাবার নাম সুফি দায়েম উদ্দিন।
 
সুফি মিজানের ভাষায়, ‘বাবাই হলেন আমার জীবনের মহানায়ক। স্বপ্ন দেখিয়েছেন, সাহস যুগিয়েছেন, মানবিকতার শিক্ষা দিয়েছেন। ’ তাতেই তিনি মহানায়ক আপনার কাছে? স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ বাবাই আমার প্রেরণার উৎস। চাকরি ছেড়ে ব্যবসায় মনোযোগী হতে বললেন। শুনে আমি ঘাবড়ে গেলাম হাতে আমার নগদ টাকা নেই বলে। এই নগদ টাকার কথা শুনে বাবা এমন এক উজ্জীবনী কথা শোনালেন, যা আজও আমার মনে গেঁথে আছে। ’ কী সেই কথা? ‘বাবা বললেন, তুমি যদি ব্যবসার কৌশল জানো, টাকা তোমার পেছনে দৌঁড়াবে। ’
 
‘১৯৭১ সালের ৬ জুন জন্মগ্রহণ করে আমার বড় ছেলে মোহাম্মদ মহসীন চৌধুরী। তার জন্মদিনের সেই ১ হাজার ৪৮৩ টাকা দিয়ে জাপানের ব্রিজস্টোন টায়ার আমদানির এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খুললাম। সঙ্গে আরও একজন পার্টনার ছিল। তারপর পুরনো কাপড় আমদানির ব্যবসা। সাড়ে চার হাজার বেল কাপড় আমদানির এলসিতে প্রতি বেলের জন্য খরচ পড়েছে ১৪০০ টাকা। কাপড় চট্টগ্রাম বন্দরে আসার আগেই অগ্রিম ডকুমেন্ট বিক্রি করে দিয়েছি প্রতি বেল সাড়ে ৪ হাজার টাকায়। ’
 
এতো বিপুল আমদানি দেখে আমেরিকার এক রপ্তানিকারক বাংলাদেশে দেখতে এসেছিল সুফি মিজানকে। বাসায় নিয়ে মেঝেতে বসিয়ে সেই আমেরিকানকে বেশ খাইয়েছিলাম। তিনি ফিরে যাওয়ার সময় মুগ্ধ হয়ে বলে গেলেন, ‘তোমার সঙ্গে আছি। তোমাকেই ব্যবসা দেবো। ’সন্তানদের সঙ্গে সুফি মিজানুর রহমান
 
সে থেকে এ পর্যন্ত সফল ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি হিসেবে সুফি মিজান দেশ-বিদেশে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এখন তার বার্ষিক ব্যবসার লেনদেন ৪ হাজার কোটি টাকার মতো। ঢেউটিন, সি আর কয়েল, কাঁচ, রড তৈরির কারখানা,বিটুমিন, শিপব্রেকিং ইয়ার্ড, শেয়ার বিজনেস, ব্রোকারেজ হাউজ, রিয়েল এস্টেট,মিডিয়া হাউজ, গাড়ির কারখানাসহ প্রায় ২২ ধরনের শিল্প ব্যবসা রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন প্রায় ১০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী।
 
সাত ছেলে এক মেয়ে সুফি মিজানের। প্রথম তিন ছেলে পড়া-লেখা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরের চারজন অস্ট্রেলিয়ায়। সাতজনের কেউই বিদেশে থাকেননি। ফিরে এসেছেন দেশে। কেন? এ প্রশ্নের জবাবে সুফি মিজান বলেন, ‘তাদের ফিরে আসার বিষয়ে আমাকে অনেকে প্রশ্ন করেছেন। আমিও ছেলেদের প্রশ্ন করেছি, কেন ফিরলে তোমরা। তাদের সাফ জবাব, অনেক ঘুরেছি, অনেক দেখেছি। কিন্তু তোমার মতো বাবার মায়া-ভালোবাসা কোথাও পাই না। ’
 
এ রকম জবাব শোনার পর কৌতুহল হলো, বাবা শব্দটাকে এতো মহান আর মায়াবী করার দীক্ষা সুফি মিজান কোথায় পেলেন! সুফি মিজানের জবাব, ‘আমার বাবা দায়েম উদ্দিনের কাছ থেকে। ’
 
ছেলেদের গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘বড় ছেলে মোহাম্মদ মহসীন চৌধুরী সবসময় বড় ভাইয়ের মতো অভিভাবক। ছোট ভাইয়েরা রাগ-অভিমান করলেও কখনো মন খারাপ করে না মহসীন। আদর ভালোবাসায় তাদের আগলে রাখে। সেজ ছেলে ইকবাল হোসেন চৌধুরী তার বয়সের তুলনায় অনেক বেশি ম্যাচিউরড। বাংলাদেশের আধুনিক কর্পোরেট কালচারে ইকবালের এ ম্যাচিউরিটির বিষয়টি স্বীকৃত। আনোয়ারুল হক চৌধুরী কাঁধে প্রফেশনাল ক্যামেরা ঝুলিয়ে চলে প্রায়সময়। একাধারে ইঞ্জিনিয়ার, বিমানের পাইলট ও বংশীবাদক। ’
 
সুফি মিজান বলে চলেন, ‘পিএইচপি ফ্যামিলির টেকনিক্যাল ইস্যু নীরবে দেখা-শোনা করে আনোয়ারুল হক চৌধুরী। আনু নামেই সবার কাছে পরিচিত। আলী হোসেন সোহাগ ব্যাংক কর্মকর্তাদের বস। সবাই তাকে সমীহ করে, স্যালুট দেয় তার দৃঢ়তা ও দূরদর্শিতার জন্য। কঠিন প্রশাসক হলেও ভেতরে ভেতরে মনটা খুবই সরল আর নরম। একটা উদাহরণ দেই, সোহাগ তখন ইস্পাহানি পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজে ইন্টারমিডেয়েটে প্রথম বর্ষে। হঠাৎ প্রিন্সিপাল হাসিনা জাকারিয়া’র ডাক পড়লো। ভয়ে ভয়ে গেলাম আমি। যাওয়ার পর আমাকে একটি গোলাপ ফুল উপহার দিয়ে অভিনন্দন জানিয়ে প্রিন্সিপাল বললেন, আপনার ছেলে সব ক্যাটাগরিতে এ প্লাস। একদিনও স্কুল মিস করেনি। মানবিক গুণাবলীতে সেরা। আর মার্কসেও সে সবার সেরা। গর্বে আর আনন্দে আমার চোখ থেকে পানি ঝরে পড়লো। ’
 
‘৪৮ মাসের পরিবর্তে মাত্র ২৮ মাসেই চট্টগ্রামের বাড়বকুন্ডে কাচ কারখানা নির্মাণ কাজ শেষ করে এক অনন্য নজির স্থাপন করে আমীর হোসেন সোহেল। এরপর তার কাছে মাসে ১০ লাখ টাকার বেতনে সৌদি আরব থেকে একটি কাচ কারখানা গড়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তাব আসে। কিন্তু সে যায়নি। সে মোবাইল ব্যবহার করে খুবই কম। কিন্তু তারপরও তার কাচ কারাখানার ম্যানেজমেন্ট দিনের ২৪ ঘণ্টা থাকে সচল ও সতর্ক। এতটাই কৌশলী আর দক্ষ সে ইন্ড্রাস্ট্রি ম্যানেজমেন্টে। জহিরুল ইসলাম রিংকু অস্ট্রেলিয়ায় পড়া-শোনায় অসাধারণ কৃতিত্ব দেখায়। ভালো প্রস্তাব থাকার পরও থাকেনি সেদেশে। শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডের আগামী দিনের বিশ্বনেতায় পরিণত হবে সে। আকতার পারভেজ হিরুরও গুণের সীমা নেই। কার কারখানা গড়ার জন্য নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে সে। ’
 
ব্যক্তি সুফি মিজান ধর্মপ্রাণ মানবিক, সৎ, বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী। ভাগ্যের সঙ্গেও তার সখ্য। সফল ব্যবসা, সুখী পারিবারিক জীবন, সন্তানদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য পরিশ্রম করেছেন দিন-রাত। প্রিয়তমা স্ত্রীর অবদানও ভোলেন না তিনি কখনো, ‘ছেলে-মেয়েরা যখন পড়ছিলো, তখন প্রতিদিন বাসায় ১৩ জন গৃহশিক্ষক আসতো। এদের প্রত্যেককেই গরম ও টাটকা নাস্তা বানিয়ে খাওয়াতেন আমার স্ত্রী তাহমিনা রহমান। এসব গৃহশিক্ষকের প্রতিজনের মাসিক বেতন ২ হাজার টাকা হলেও দেওয়া হতো ৫ হাজার টাকা করে। তবে মাসের পরিবর্তে পুরো বছরের টাকা দিয়ে দেওয়া হতো এক সঙ্গে। একসঙ্গে এতো টাকা পেয়ে গৃহশিক্ষকদের কেউ কিনেছেন টেলিভিশন, কেউ কিনেছেন ফ্রিজ। কেউবা বানিয়েছেন বসত-বাড়ি। ’
 
৭৪ বছর পেরিয়ে আজ ৭৫ বছরে পা দিলেন সুফি মিজান। জন্মবার্ষিকী কখনো পালন করেননি বড় করে। এবার প্রথমবারের মতো পালন করবেন নগরীর একটি কমিউনিটি সেন্টারে। চার হাজার লোকের মেজবান। তার আগে পবিত্র কোরআন খতম। কোরআন তেলোয়াত করবেন বিখ্যাত ক্বারী আহমেদ ইউসুফ আল আজহারী। নাত শোনাবেন নাতি-নাতনিরা। দাদা সম্পর্কে গল্প বলবেন ইংলিশ মিডিয়ামের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী নাতি নুমায়ের।
 
এ রকম এক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ও অর্থবহ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সুফি মিজান যখন পা রাখছেন ৭৫ বছর বয়সে, তখন তিনি একজন কর্মক্ষম সক্রিয় শিল্প উদ্যোক্তা। ফিকির করছেন প্রায়ই সারাক্ষণই। দিনে ঘুমান মাত্র ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা। ৫৩ বছর বয়সে মা না ফেরার দেশে চলে গেলেও বাবা বেঁচে ছিলেন প্রায় ৯৮ বছর।
 
কতো বছর বাঁচবেন এটা কেউ আগাম বলতে পারে না। তবে পবিত্র হাদিসে একটি কথা উল্লেখ রয়েছে, নেকির হায়াত আছে অর্থাৎ ভালো কাজ করলে জীবনী শক্তি বা আয়ু বাড়ে। আর আধুনিক জমানায় এখন বলা হয়, রেইট অব সাকসেস ভালো হলে অটোমেটিক্যালি জীবন দীর্ঘায়ু হয় ও সুস্থ থাকে। হাদিসের কথার প্রতিফলন আর আধুনিক জমানার এ বিশ্বাস আমরা সুফি মিজানের আয়ুষ্কালের ক্ষেত্রেও দেখতে চাই।
 
লেখক
রফিকুল বাহার
আবাসিক সম্পাদক, ইটিভি।
[email protected]

 
বাংলাদেশ সময়: ০৫৩৬ ঘণ্টা, মার্চ ১১, ২০১৭
এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।