ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

সারাহ সিলভারম্যান এবং ধর্ষিতার উপাখ্যান

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৫৫ ঘণ্টা, মে ১৭, ২০১৭
সারাহ সিলভারম্যান এবং ধর্ষিতার উপাখ্যান সারাহ সিলভারম্যান

বছর দুয়েক আগের ঘটনা এটা। আমেরিকান কমেডিয়ান সারাহ সিলভারম্যান একটা টুইট করেছিলেন। এই টুইটটা সেই সময় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো। কীভাবে ধর্ষণ প্রতিরোধ করা যায়, সেই বিষয়ে টুইট করেছিলেন তিনি। সেখানে ধর্ষণ প্রতিরোধের দশটা তালিকা ছিলো। ধর্ষণ প্রতিরোধের এইসব তালিকা অবশ্য নতুন কিছু নয়। বিদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে কিংবা পুলিশের কাছে ধর্ষণ প্রতিরোধের ছোট্ট পুস্তিকা থাকে। এগুলোতে মেয়েরা কীভাবে নিজেদের ধর্ষণ থেকে রক্ষা করতে পারে, সে বিষয়ে নানা উপদেশনামা দেওয়া থাকে।

সারাহ সিলভ্যারম্যানের টুইট করা তালিকা এই তালিকার মতো গতানুগতিক ছিলো না। এটা সম্পূর্ণ বিপরীত ধরনের তালিকা।

মেয়েরা কীভাবে নিজেদের ধর্ষণ থেকে বাঁচাতে পারে, সেই পদ্ধতি বলে দেবার বদলে তাঁর তালিকাতে পুরুষরা কীভাবে নিজেদের ধর্ষণ করা থেকে বিরত রাখতে পারে, সে বিষয়ে উপদেশ দেওয়া ছিল। যেমন সেখানে ছিল, মনে রেখো, মেয়েরা লন্ড্রি রুমে যায় জামা-কাপড় ধোয়ার জন্য, সেখানে কাউকে একা পেয়ে যৌন নির্যাতন করো না। বা লিফটে তুমি একা আছো। একটা মেয়ে ঢুকেছে। তাকে একা পেয়ে ধর্ষণ করো না। কিংবা ধর্ষণ বাঁশি সাথে রাখো। যখনই টের পাবে যে তুমি কোনো মেয়েকে ধর্ষণ করতে যাচ্ছো, বাঁশিতে ফুঁ দিতে থাকো যতক্ষণ পর্যন্ত না কেউ এসে তোমাকে ধর্ষণ করা থেকে বিরত করে। সারাহ যে তালিকা দিয়েছিলেন, সেটা তাঁর নিজের করা নয়। এটা বছর পাঁচেক আগে গ্যাগ নামের একটা ব্লগে প্রকাশ করা হয়েছিলো।

স্বাভাবিকভাবেই সারাহ-র এই তালিকাকে সহজভাবে নেওয়া হয়নি। সহজভাবে কারা নেয়নি, সেটা বলাটাও খুব সোজা কাজ। তাঁর টুইটে এসে বহু ক্ষিপ্ত পুরুষ তাদের রাগ এবং ক্ষোভ প্রকাশ করে যায় এই বলে যে, এই তালিকা অত্যন্ত আক্রমণাত্মক, উস্কানিমূলক, পক্ষপাতপূর্ণ এবং এখানে অযৌক্তিকভাবে সব পুরুষকে সম্ভাব্য ধর্ষণকারী হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

এটা সত্যি কথা যে, পৃথিবীর সব পুরুষই ধর্ষক হয় না। তবে, এটাও সত্যি যে ধর্ষণ মূলত পুরুষের মাধ্যমেই ঘটে থাকে। সারাহ-র টুইটে প্রতিক্রিয়া দেখানো পুরুষেরা যে বিষয়টাকে খেয়াল করতে ব্যর্থ হয়েছেন, সেটা হচ্ছে, সারা বিশ্বেই ধর্ষণ কিংবা যৌন নির্যাতন ঘটছে। উন্নত কিংবা অনুন্নত বিশ্ব বলে কোনো কথা নেই, মেয়েরা কোথাও নিরাপদ নয় এখন আর। উন্নত বিশ্বে ধর্ষণ তুলনামূলকভাবে অনুন্নত বিশ্বের চেয়ে কম হয়, তবে সেই কমটা খুব একটা কম কিছু না। ধর্ষণকে নির্মূল করতে প্রায় সব সমাজই ব্যর্থ হয়েছে। ২০১১ সালের এক রিপোর্টে দেখা যায়, আমেরিকার প্রতি পাঁচজন মেয়ের মধ্যে একজন যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে।

বিশ্বব্যাপী এতো ব্যাপক হারে ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতন শুধু আইন দিয়ে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। এর জন্য ভিন্ন ব্যবস্থার প্রয়োজন রয়েছে। আজকাল বিভিন্ন দেশে নানা ধরনের সামাজিক বা ব্যক্তিগত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার কথাও নানাভাবে চিন্তা করা হয়েছে। সমস্যা হচ্ছে, সেইসব প্রতিরোধ ব্যবস্থায় খুব সূক্ষ্মভাবে নারীকেই ধর্ষণের জন্য দায়ী করা হচ্ছে বা হয়েছে।  

সারাহ সিলভারম্যানযখন নারীদের ধর্ষণ থেকে বাঁচাতে বলা হচ্ছে: এরকমভাবে চলাফেরা করো না, পার্টিতে গিয়ে বেশি ড্রিংক করো না, কিংবা অপরিচিত বা স্বল্প পরিচিত কারো সাথে অনিরাপদ কোথাও যেও না, সংক্ষিপ্ত এবং উত্তেজক পোশাক পরো না, তখন মূলত ধর্ষকের বদলে ধর্ষিতাকেই দায়ী করার সচেতন কিংবা অসচেতন একটা প্রয়াস এইসব নিষেধাজ্ঞার আড়ালে লক্ষ্য করা যায়।  

ধর্ষণরহিত করার এই নেতিবাচক পদ্ধতি বা ধর্ষিতাকে দায়ী করার এই সূক্ষ্ণ প্রয়াসকে বহুদিন ধরেই ধর্ষণ প্রতিরোধের জন্য আন্দোলনকারীদের হতাশ করে আসছিল। কারণ, ধর্ষণ শুধু যৌনতার কারণে ঘটে না। যৌনবুভুক্ষ পুরুষ শুধুমাত্র যৌনতা পাবার আশায় নারীকে ধর্ষণ করে, এমনটা নয়। পুরুষের জন্য তাদের ক্ষমতা দেখানো এবং সহিংসতা প্রকাশের একটা প্রধান উপায় হচ্ছে নারীর উপর অত্যাচার, বিশেষ করে তার উপরে যৌন আক্রমণ সাধন করা এবং তাকে ধর্ষণ করা।

আমাদের বনানীর ধর্ষণের ক্ষেত্রেই দেখুন। যারা ধর্ষণ করেছে, তারা যৌনতাবঞ্চিত বুভুক্ষু মানুষ না। এদের অফুরন্ত টাকা আছে, সেই সাথে অসংখ্য বান্ধবী আছে। ঢাকা শহরে বিপুল পরিমাণ টাকা থাকলে, শারীরিক এই চাহিদা মেটানোর জন্য ধর্ষণের মতো ঝামেলায় যাওয়া লাগে না। সহজেই তা মেটানো সম্ভব। এই ধর্ষণের জন্য প্রধান অভিযুক্ত যে, সেই শাফাতের ঢাকাই ছবির চার নায়িকাসহ আরো অনেক মডেল এবং নারীর সাথে নিয়মিত যৌন সম্পর্ক ছিলো এমন সংবাদ পত্রিকাতেই উঠে এসেছে গত ক’দিনে। শুধু শাফাত একা নয়, অন্য অভিযুক্তরা শাফাতের চেয়ে কম কিছু না। তারপরেও, ধর্ষণের মতো ভয়াবহ নোংরা এবং অপরাধমূলক কাজে তারা গিয়েছে এই ক্ষমতার দম্ভ দেখানো এবং সহিংসতা প্রকাশের মানসিকতা থেকেই। যৌনতা এখানে গৌণ; নারীকে চরম অপমান করা, তাকে পদদলিত করে কুক্ষিগত করা এবং সমূলে ধ্বংস করে দেবার মধ্যযুগীয় পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাই এখানে মুখ্য।

সারাহ সিলভারম্যানের এই টুইটের পরে কেউ কেউ এই রকম যুক্তি নিয়েও হাজির হয়েছিলো যে, “আমরা যখন বাড়ির মালিককে চোর-ডাকাতের হাত থেকে রক্ষা করার নানা উপায় বাতলে দেই, তখন কি সেটা খারাপ কাজ? আমাদের কি তাহলে বাড়ির মালিকদের কিছু না বলে চোর-ডাকাতদের উপদেশ বিলাবো এই বলে যে, বাবারা তোমরা চুরি-ডাকাতি করো না। কারণ এটা খারাপ কাজ। ”

টুইট-পরবর্তী এইসব প্রতিক্রিয়া দেখে সারাহ বলেন, “এই তালিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে আমার উদ্দেশ্যে এটা নয় যে, সম্ভাব্য ধর্ষকরা এটা পড়বে এবং এটা পড়ে তারা নিজেদের শুধরে নিয়ে ধর্ষণ করা থেকে বিরত থাকবে। আমি বরং যে কাজটা করতে চেয়েছি সেটা হচ্ছে, বর্তমানের ভিক্টিম ব্লেমের কালচারকে ব্যঙ্গ করা। যারা এইসব অপকর্ম করছে তাদের মানসিকতা পরিবর্তনের চেষ্টা না থাকাটাকে সবার সামনে তুলে ধরা। ভিক্টিম বা সম্ভাব্য ভিক্টিমদের নিরাপত্তামূলক উপদেশ দেওয়াকে আমি খারাপ কিছু মনে করি না। নিজের ঘর-বাড়িকে চুরি-চামারির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য কীভাবে সাবধানতা অবলম্বন করা যায় সে উপদেশ দেওয়া যেতেই পারে। এগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে বাড়ির মালিকেরা তাদের বাড়িকে আরো নিরাপদ করতে পারে। কিন্তু, এটা ধর্ষণের সাথে তুলনীয় না। কেন নয়, সেটা খুব সহজেই বোধগম্য। ধর্ষণের ক্ষেত্রে আমাদের পুরো ফোকাসটাই থাকে ধর্ষিতার প্রতি। ধর্ষকের সংস্কৃতি, শিক্ষা, মানসিকতা পরিবর্তনের কোনো প্রয়াসই সেখানে থাকে না। এতে করে মূল সমস্যার কোনো সমাধান হয় না। মেয়েরা প্রচণ্ডরকমভাবে নিরাপত্তাবেষ্টনীর মধ্যে না থাকলে অথবা নিরাপত্তা দেবার জন্য সাথে কেউ না থাকলে আবারও ধর্ষণের শিকার হয়। আর এগুলো ঘটায় ওইসব আক্রমণাত্মক মানসিকতার পুরুষেরা।

নানা ধরনের প্রত্যক্ষ বা প্রচ্ছন্ন ভাষার ব্যবহার করে মেয়েদের দোষারোপ করে। তাদের কোন কাজটা ঠিক হয়েছে বা হয়নি, তারা দিনে বের হয়েছে না রাতে বের হয়েছে, একা গেছে, নাকি সঙ্গে কাউকে নিয়ে গেছে, নৈশ পার্টিতে গেছে, নাকি পত্রিকা অফিসে গেছে, নিরাপদ জায়গায় গেছে, না অনিরাপদ জায়গায় গেছে, পোশাক সঠিক ছিলো, কি ছিলো না--এইসব তর্ক-বিতর্ক করে আর অজুহাতকে সামনে তুলে আনে এরা। ভিক্টিমকে ব্লেম করার এই সংস্কৃতি থেকে যতদিন না আমরা বের হয়ে আসতে পারবো, ততদিন পর্যন্ত আমাদের সমাজকে ধর্ষণমুক্ত করা সম্ভবপর হবে না।

শুধু আমাদের দেশে বা সমাজেই না, বিশ্বজুড়েই ধর্ষণ প্রতিরোধের সব দায় যেন কেবল নারীর একার। যারা ধর্ষণ করে, সেই পুরুষদের কোনো দায় নেই যেন এখানে কোনো। অথচ হওয়া উচিত ছিলো এর উল্টোটাই। শিশ্নধারী সহিংস শার্দূল আসলে পুরুষেরাই। হরিণীসদৃশ নারী তার অসহায় এবং অবলা শিকারমাত্র।

লেখক
ফরিদ আহমেদ
কানাডা প্রবাসী লেখক

বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৩ ঘণ্টা, মে ১৭, ২০১৭
জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।