ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

ধর্ষণ ও নারকীয় অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তিই কাম্য

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪৭ ঘণ্টা, আগস্ট ২, ২০১৭
ধর্ষণ ও নারকীয় অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তিই কাম্য

পর পর বেশ কয়েকটি নারকীয় অপরাধের খবর প্রকাশিত হয়েছে। কোমলমতি শিশু-কিশোররাও রক্ষা পায়নি পাশবিক মানসিকতার মানুষ নামের পশুর কবল থেকে। সারা দেশের মানুষ এজন্য ক্ষুব্ধ, প্রতিবাদমুখর।

এ দুঃসহ পরিস্থিতির অবসান হওয়া দরকার। ধর্ষণ ও নারকীয় অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান করা প্রয়োজন।

এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন স্থাপন করা উচিত, যেন আর কেউ অপরাধ করতে সাহস না পান।

বাংলাদেশে এখন রাজনৈতিক বা সামাজিক বা পেশাগত পরিচয় ও পদের জোরে যা ইচ্ছা, তাই করার যে মনোবৃত্তি এক শ্রেণীর লোকের মধ্যে বিস্তার লাভ করছে- তা ভয়ের বিষয়। হাতের কাছে নিরীহ ও দুর্বল কাউকে পেলেই বলপ্রয়োগ করা হচ্ছে, পাশবিক অত্যাচার চালানো হচ্ছে। শিশু-কিশোর বা অধীনস্ত নারীরাও বাঁচতে পারছে না। ধর্ষিতা নারীর মা-বাবা-বোনকে পর্যন্ত নির্যাতন করা হচ্ছে। অপরাধের পর দাপটের সঙ্গে সেটাকে বৈধ করার প্রচেষ্টাও নেওয়া হচ্ছে।

আশার কথা হলো, মিডিয়া ও সচেতন-মানবিক মানুষের প্রতিবাদের কারণে বেশ কিছু ঘটনা আইনের আওতায় এসেছে। এখন গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে অপরাধীদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া। অপরাধী গোষ্ঠীকে এ বার্তা জানানো প্রয়োজন যে, অপরাধ করলে রক্ষা নেই। দল-মত নির্বিশেষে অপরাধী মানেই শাস্তির যোগ্য- সমাজে এ বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হলেই অপরাধীরা ভীত ও দুর্বল হবেন।

তা না হলে তাদের অপকর্ম বাড়তেই থাকবে। মানুষ ও সমাজের বিপদ তীব্রতর হতেই থাকবে।

আইন-আদালতের অন্দর মহলে যারা বিচরণ করেন, তারা জানেন, প্রকৃত আসামিকে শাস্তি দেওয়া কতো কঠিন। টাকা ও ক্ষমতার অধিকারী আসামিকে শাস্তি দেওয়া আরো কঠিন।

অন্যদিকে, বহু দুর্বল ও অসহায় মানুষ বিনা বিচারেও শাস্তি ভোগ করেন। নারকীয় ও নিন্দনীয় অপরাধীদের জন্য সত্যি সত্যিই আইনের শাস্তি নিশ্চিত করার সময় এ কথাগুলো অবশ্যই মনে রাখা ভালো। রাস্তার ফকির থেকে কোটিপতি বনে যাওয়া অসৎ লোকটি তার শাস্তি নস্যাৎ করতে অনেক কিছুই করতে পারেন- এ কথাটিও স্মরণে রাখা দরকার।

আবার অনেক সময় দেখা যায়, বিচারাধীন বন্দি সুদীর্ঘকাল জেলে আটক থাকার পর নির্দোষ বলে সাব্যস্ত হন। আবার অনেক সময়, মামলার রায়ের পর দেখা যায়, বিচারাধীন বন্দির ঘোষিত সাজার চেয়ে বেশি সাজা ভোগ করা আগেই হয়ে গেছে।

সবচেয়ে করুণ অবস্থা নিম্ন আদালতে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের। আপিলের করার পর হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টে রায় দানের পর্ব দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হওয়ায় ওই আসামিরা আক্ষরিক অর্থেই জীবন্মৃত অবস্থায় জেলের কনডেমড সেলে দিনাতিপাত করেন।

তবে পৃথিবীর ১২০টি দেশ মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার বিধান একেবারে রদ করেছে। কেউ কেউ এমনও মনে করছেন যে, কোনো চরম অপরাধী কিংবা খুনিকে ফাঁসি দেওয়াও এক ধরনের রাষ্ট্রীয় খুন। শাস্তির সংজ্ঞার্থ ও প্রকৃতিরও বিস্তর রূপান্তর ঘটেছে। এখন শাস্তির অর্থ হয়েছে অপরাধীকে সংশোধন করানো। তাই ক্ষমাশীলতা, সংস্কার, পুনর্বাসন, দয়া প্রদর্শন ইত্যাদি উপাদানগুলো রাষ্ট্রীয় ন্যায়বিচারের কাঠামোয় দেশে-দেশে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কারাগার আজ হয়েছে সংশোধনাগার।

এসব পরিবর্তনের স্বীকৃতি পাওয়া যায় জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদে। রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশও সেখানে অঙ্গীকারাবদ্ধ।

কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তব চিত্র কেমন? কিছুদিন আগে রাজনৈতিক কারণে বন্দি ছাত্রদের পরীক্ষা নিতে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে জানলাম, ধারণ ক্ষমতার তিন-চার গুণ লোকের ঠাঁই হয়েছে সেলগুলোতে। প্রচণ্ড গরম ও লোডশেডিংয়ে বাসিন্দাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। কারা লাইব্রেরিতে যথেষ্ট বই-পুস্তক নেই। ছাত্র বা রাজনৈতিক বন্দিদেরকেও রাখা হয়েছে দাগি আসামিদের সঙ্গে। সংশোধন দূরের কথা, কলুষিত হওয়ার যথেষ্ট কার্যকারণও ছড়িয়ে রয়েছে সেখানে। ফলে সামান্য অপরাধ করে কেউ কারাগারে গিয়ে ফিরে আসছেন মস্ত বড় অপরাধের হাতছানি নিয়ে।

এতে তো অবস্থা আরও খারাপ ছাড়া ভালো হবে না।

আমরা গণতন্ত্র, সুশাসন, মানবাধিকার ইত্যাদি নানা বিষয়ে কথা বলি। কিন্তু ঔপনিবেশিক আমলের আইন, বিধি ও ব্যবস্থা বদলের চেষ্টা করি না। এভাবে সমাজকে পশ্চাৎপদ করাই যাবে, সামনে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না।

কারা ব্যবস্থার সংস্কার যে একটি অতি জরুরি বিষয়- বার বার কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েও রাজনৈতিক নীতি নির্ধারকরা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন না। এক্ষেত্রে কার্যকর ব্যবস্থাও নেন না তরা।

শাস্তির সঙ্গে সংশোধনের সমন্বয় করা না গেলে অপরাধের চেইন রিঅ্যাকশন বন্ধ হবে না। অপরাধও উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকবে, কমবে না।

আবার যারা চরম অমানবিক ও নারকীয় অপরাধ করেন, তারা যদি সমাজে বুক উঁচিয়ে চলাফেরা করেন- তাহলে সমাজ কলঙ্কিত ও নষ্ট হতে বাধ্য। ভালো লোক যেমন কারাগারে অপরাধীদের সঙ্গে থাকলে বিপথগামী হতে পারেন, তেমনি সমাজের খারাপ লোকগুলোর অবাধ বিচরণ থাকলে অন্য ভালো লোকগুলোও নষ্ট হতে পারেন। কারণ, একটি খারাপ আপেলই এক ঝুঁড়ি ভালো আপেলকে নষ্ট করে পচিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

অতএব, কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কোনো অবস্থাতেই রহিত করা যায় না। অবুঝ-অসহায় শিশুকে যারা ধর্ষণ করেন বা ধর্ষণের পর ধর্ষিতার মা-বাবা-আত্মীয়কে লাঞ্ছিত করেন- তাদের ক্ষেত্রে চরম ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিকল্প নেই। আইনকে যেমন মানবিক হতে হয়, তেমনি কঠোরও  হতে হয়। কঠোর শাস্তির ক্ষেত্রে মানবিকতা অথবা সাধারণ ক্ষেত্রে কঠোরতা- এর কোনোটিই গ্রহণযোগ্য নয়। সমাজে শৃঙ্খলা, মানবিকতা, মনুষ্যত্ব সংরক্ষণে পাশবিক ও নারকীয় অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি ও এর দৃষ্টান্তমূলক প্রয়োগই সকলের দাবি।

ড. মাহফুজ পারভেজ: অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৫ ঘণ্টা, আগস্ট ০২, ২০১৭
এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।