দীর্ঘদিন ধরে তিনি এই অমূল্য কাজটি নিরলসভাবে করে যাচ্ছেন। একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা জব্বার এবার যুদ্ধ নেমেছেন বর্ণমালা নিয়ে।
বাংলা হরফ সিসার প্রযুক্তিতে যুক্ত হয় পঞ্চানন কর্মকার ও চার্লস উইনকিন্সের হাত ধরে ১৭৭৮ সালে। আর তা ১৯৮৭ সালে ‘রহস্যময়’ প্রযুক্তির রূপ দেন কম্পিউটারে বাংলা লেখার সফটওয়্যারের উদ্ভাবক মোস্তাফা জব্বার। বিজয় কীবোর্ডের এ বিজয় যেনো বাংলার বিজয়! যা কম্পিউটারের মাধ্যমে মুদ্রণ ও প্রকাশনায় বৈপ্লবিক উত্তরণ এনে দিয়েছে। শুধু বাংলা বর্ণমালায় নয়; তিনি কম্পিউটারে চাকমা লিপিমালা তৈরি করেছেন। আমার কাছে কয়েকটি আদিবাসী বর্ণমালা আছে। তা-ও তিনি কম্পিউটার লিপির আকারে লিপিবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেগুলো আর তাঁকে দেয়া হয়নি।
আমার প্রিয় মানুষদের মধ্যে একজন মোস্তাফা জব্বার। জব্বার ভাইয়ের সাথে আশির দশক থেকে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক। তাঁকে আমি নানাভাবে চিনি ও জানি। দূর থেকে দেখেছি, কাছ থেকে জেনেছি। কিছুদিন তাঁর সম্পাদিত সাপ্তাহিক ঢাকার চিঠিতে যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছি। তাঁর পত্রিকায় কাজ করার সুবাদে অনেক কিছু ঘিরে অনেক স্মৃতি জমা হয়ে আছে। যেমন, কুখ্যাত খন্দকার মোশতাকের সাক্ষাৎকার। এছাড়া রাশেদ খান মেননের সাক্ষাৎকার, দাউদ হায়দারের বিতর্কিত লেখা, হুমায়ুন আহমদের উপর কড়া প্রতিবেদন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের পাঁচ শিক্ষানবিস ছাত্রীর প্রশিক্ষণ প্রভৃতি।
তখন আরো কাছ থেকে দেখেছি। দেখেছি প্রথম সংসার ভেঙ্গে যাবার সময় তার মতো নায়কোচিত একজন যুবক কিভাবে টুইন টাওয়ারের মতো ধসে পড়ছেন। প্রায় সার্বক্ষণিক হাসিমাখা মুখ, তারুণ্যদীপ্ত চোখ কিভাবে কেঁদে উঠলো! আমি ভোরের কাগজে সাহিত্য পাতায় একবার তাঁকে নিয়ে তিন লাইনের একটি সাহিত্য সংবাদ লিখেছিলাম- ‘সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ, নাট্যকার, প্রেমিক, স্বাপ্নিক, সাংসারিক, ব্যবসায়ী, প্রযুক্তিবিদ অর্থাৎ বহুমাত্রিক মোস্তাফা জব্বার কোনোটাতেই অসম্পূর্ণ নন; সব কিছুতেই আংশিক’।
সেই সংবাদ দেখে আমাকে ফোন করে বলেছিলেনঃ ‘দুলাল, তুমি তিন লাইনে আমার জীবনী সুন্দরভাবে তুলে ধরেছো। যা ১০০% সত্য। তুমি আসো, এক সাথে চা খাবো’। কিন্তু সেই চা আর খাওয়া হয়নি। সেই পাওনা চায়ে চুমুক দিতে দিতে আজ বিশ বছর পর বলতে চাই না জব্বার ভাই, সেদিনের কথা ঠিক নয়। অন্তত বাংলা বর্ণমালার বিজয় কি-বোর্ডের ক্ষেত্রে আপনার অর্জিত বিজয় ১০০% সার্থক। শুধু এক্ষেত্রেই নয়; আপনার অন্যান্য কার্যক্রমও সফল। আমার নিজের অজান্তেই ‘বক্ররেখা’ কবিতায় অন্তর্ভূক্ত হলেন তিনিঃ “অসংশ্লিষ্ট মোস্তাফা জব্বারের কাছে ধর্ণা,/ দক্ষ কারিগরকে বিন্দু বিন্দু অসংখ্য সুক্ষ্ণ বিন্দু প্রদান করা হলো-/ শুধুমাত্র একটি সরল রেখার জন্য। সাধারণ সরল রেখা”।
এভাবে বক্ররেখাকে তিনি সরল রেখায় পরিণত করছেন। যেমন, সাংবাদিকেরা যখন নিউজ প্রিন্টে লিখতেন, দেশের সকল সংবাদপত্র যখন সিসার বর্ণমালায় হ্যান্ড কম্পোজ হতো, গেলি প্রুফ দেখা হতো, হেড লাইন কাঠের ব্লকে ছাপা হতো, তখন আপনি ওই দৈনিকগুলোতে গিয়ে গিয়ে সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। নানা প্রতিকূলতা অতিক্রম করে হাউজে হাউজে চালু করেছেন কম্পিউটার। যেনো ঘরে ঘরে জ্বালিয়েছেন আলো আর আলোকিত করেছেন সংবাদপত্র-জগৎ।
সেভাবেই যিনি আজ এনালগ বাংলাদেশকে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এ পরিণত করছেন। তাঁর নাম মোস্তফা জব্বার। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের রূপকার রফিকুল ইসলামের মৃত্যুর পর তাঁর মূল্যায়ন করে বলা হয় যে, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিশেবে প্রতিষ্ঠার জন্যে ১৯৫২ সালে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন সালাম-রফিক। আর সেই ভাষাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য ভ্যাঙ্কুভারের সালাম-রফিকের নাম কাকতালীয়ভাবে অভিষিক্ত। সে সূত্র ধরে বলতে চাই, বায়ান্নের সালাম-রফিক-বরকত-জব্বারের সাথে ভিন্নভাবে যুক্ত হয়েছে আরেক জব্বারের নাম। তিনি হচ্ছেন মোস্তাফা জব্বার। যিনি আমাদের প্রাণের বর্ণমালাকে যুক্ত করেছেন আধুনিক প্রযুক্তির সাথে। যিনি আলোকিত করছেন ভাষার ভুবন। তাঁর জন্য চাই একুশে পদক!
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০২, ২০১৮
জেএম
[ বিঃ দ্রঃ ‘যিনি আলোকিত করছেন বর্ণমালার ভূবন, তাঁর জন্য চাই- একুশে পদক’! এই লেখাটি লিখেছিলাম ২০১৪তে, তাঁর জন্মদিনে! আজ অন্যভাবে কাজে লাগলো মনে হচ্ছে!]