ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

মাতৃভাষা ও মনের ভাব

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪৪১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৮
মাতৃভাষা ও মনের ভাব ভাষার ফেব্রুয়ারি আশার ফেব্রুয়ারি

সাধারণত কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিতে মনের ভাব প্রকাশের প্রধান মাধ্যম হলো মাতৃভাষা। মানুষ তার কল্পনা, স্বপ্ন, চিন্তা, মনোভাব নিজের মাতৃভাষায় যতটুকু সাবলীল ও স্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে পারে, অন্য ভাষায় সেটা পারে না।

এক্ষেত্রে পৃথিবীতে হাতে-গোনা কয়েকটি ব্যতিক্রম আছে। কোনও কোনও বিশ্ববরেণ্য লেখক নিজের মাতৃভাষায় না লিখে নতুন কোনও দেশে গিয়ে সেদেশের ভাষায় লিখেছেন।

অনেক ইংরেজি ও ফরাসি ভাষার লেখক আছেন, যা তাদের মাতৃভাষা নয়। এমন উদাহরণ বেশি হবে না এবং তারা নতুন দেশটিতে বহু বছর বসবাস করছেন। ফলে ভাষাটি তাদের কাছে মাতৃভাষার মতোই হয়ে গিয়েছে।   

কিন্তু সাধারণ ও সর্বজনীন বিবেচনায় ভাষা মনের ভাব প্রকাশের প্রধান বাহন অবশ্যই মাতৃভাষা। এই ভাষা প্রাকৃতিকভাবে প্রদত্ত এবং জন্মগত। শুধু মানুষই নয়, পশু-পাখি, জন্তু-জানোয়ার ইত্যাদিও নিজের জন্মগত ভাষাতেই মনের ভাব ও অভিব্যক্তি প্রকাশ করে। সৃষ্টি জগতে এটাই একটি চিরায়ত নিয়ম।

ভাষা প্রকাশের জন্য কতিপয় ধ্বনি বা আওয়াজ প্রয়োজন হয়। যেসব মানুষ জন্মের পর পরেই শিখে ফেলে। প্রতিটি প্রাণীই নিজস্ব ধ্বনি ও ভাষায় অভ্যস্ত এবং একে অপরের সঙ্গে পার্থক্য বুঝতে পারে প্রধানত এই ভাষার মাধ্যমেই।

ভাষাবিজ্ঞানিরা লক্ষ্য করেছেন যে, ধ্বনি-তরঙ্গ বা প্রতিটি আওয়াজেরই একটি প্রবহমানতা ও বৈচিত্র্য থাকে। ধ্বনির প্রবহমানতার ফলে এক একটি শব্দের সৃষ্টি হয়। প্রতিটি প্রাণীর মধ্যেই এই নিজস্বতা রয়েছে। এখানেই ভাষাবৈচিত্র্য ছড়িয়ে আছে।

প্রাণীজগতের মধ্যে মানুষের মুখ-নিঃসৃত ধ্বনির প্রবহমানতা ও বৈচিত্র্য সীমাহীন। মানুষের আবেগ ও অনুভূতি যেমন বিচিত্র, মানব সমাজের বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীর মধ্যে ভাষা-বিচিত্রও তেমনি অসংখ্য। এক একটি ভাষার আবেগ, অনুভূতি, হর্ষ ও বিষাদ প্রকাশের ধরণ, ভঙ্গি ও ব্যঞ্জনাও পৃথক। এই প্রকাশ সুস্পষ্ট রূপ লাভ করে মাতৃভাষায়।

লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, দেশে দেশে, অঞ্চলে অঞ্চলে ভাষাবৈচিত্র্য বিরাজমান। একই দেশে হয়ত একাধিক ভাষা রয়েছে। প্রতিটি দেশেই রয়েছে তার অধিবাসীদের জন্য নানারূপ ভাষা। তবে জন্মের সময় যে ভাষাটি তার সংস্কৃতির অংশ থাকে এবং যে ভাষাগত সংস্কৃতির উত্তরাধিকার পূর্ব-পুরুষগণ বহন করে আনেন, সেটাই নবজাতকের মাতৃভাষা। সাধারণ বিবেচনায় মায়ের মুখের ভাষাটিকেই সন্তানের মাতৃভাষা নামে স্বীকার করা হয়। এ ভাষাতেই নবজাতক কথা বলে, লিখে কখনও দুঃখজড়িত ঘটনা, কখনও বা আনন্দের বাক্যমালা। তার জীবনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে থাকে নিজস্ব মাতৃভাষা। তার সাংস্কৃতিক পরিচিতির মতোই ভাষিক পরিচিতিও অবিচ্ছেদ্য। তার জীবনের অন্তর্গত বহুবর্ণা-রূপটি এই ভাষার মতো অন্য কোনও ভাষায় মূর্ততা পায় না।

হয়ত মাতৃভাষায় ভাব প্রকাশের জন্য কেউ কেউ উপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেনি। নানা কারণে ভাষাগত শিক্ষার ব্যত্যয় ঘটলেও মাতৃভাষা মানুষের স্বাভাবিক মনোভাব প্রকাশের সুযোগ করে দেয়। মাতৃভাষায় সর্বজনমান্য কাঠামো সম্পর্কে ধারণা না পেয়েও মানুষ তার স্বাভাবিক যোগাযোগটি সম্পন্ন করতে পারে। একজন নিরক্ষর লোকের আবেগ-অনুভূতি, চাহিদা, প্রত্যাশা জ্ঞাপন করার ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দুর্বলতা মাতৃভাষার মাধ্যমে অতিক্রম করা যায়। ভাষাগত জ্ঞানে সমৃদ্ধ হলে লোকটি তার বক্তব্য ও মনোভাব আরও সুচারুরূপেই উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়।

মোদ্দা কথায়, মনের ভাবকে সঞ্চারিত করতে মাতৃভাষা প্রধান অবলম্বন। নিজেকে জানাতে, নিজের কথা ও মনোভাব প্রকাশ করতে মাতৃভাষাই পৃথিবীর সিংহভাগ মানুষের ভরসা। ফলে মাতৃভাষা সংক্রান্ত সাধারণ জ্ঞান ও প্রয়োজনীয় শিক্ষাটি যদি ব্যক্তি ও পরিবার পর্যায়ে সকলে দেওয়া যায়, তাহলে মানুষের মধ্যে মতের আদান-প্রদান সহজ ও বোধগম্য হতে বাধ্য। অতএব, যে কোনও শিক্ষার প্রসারের পূর্বে মাতৃভাষাগত শিক্ষার গুরুত্ব তৈরি হচ্ছে।

একটি রাষ্ট্রের নাগরিকদের মনোভাব কেমন, তারা কি চায়, কি পছন্দ বা অপছন্দ করে, এই ধরনের মনোভাব যতো স্পষ্ট হবে, সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামোটিও ততই তথ্যসমৃদ্ধ হয়ে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। ফলে নাগরিকদের মৌলিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার পথে সুশাসনের পূর্বশর্ত স্বরূপ মাতৃভাষার শিক্ষা ও চর্চায় নিয়োজিত করা অবশ্য কর্তব্য। এজন্য যে কোনও শিক্ষা পরিকল্পনা ও কর্মসূচির সর্বাগ্রে মাতৃভাষা শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান। একাজ যত দ্রুত ও সফলভাবে করা যাবে, তত দ্রুত ব্যক্তি ও সমাজের সম্পর্ক ও সৌহার্দ্য সুসামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।

বাংলাদেশ সময়:১০৩৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৮

এমপি/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।