আসলে ব্যাকরণ হচ্ছে ভাষার ব্যবহার ও প্রয়োগের নিয়ম-বিধি। ভাষার ব্যবহারে শৃঙ্খলা ও নিয়ম বজায় রাখার কাজটি করে ব্যাকরণ।
বাংলা ভাষার নিজস্ব ব্যাকরণের ইতিহাস খুব বেশি প্রাচীন নয়। ইংরেজ আমলেই প্রথাগত ব্যাকরণ রচনার সূত্রপাত ঘটে। বিদেশিরা এদেশে এসে ব্যবসা-বাণিজ্য, কাজ-কর্ম করার প্রয়োজনে ভাষা শেখার তাগিদ অনুভব করেন। তখন তারা স্বদেশিকে বাংলা শেখানোর জন্য ম্যানুয়েল আকারে ব্যাকরণ প্রণয়ন শুরু করেন।
ব্যাকরণ রচনায় প্রথমে আসে একজন পর্তুগিজের নাম। পর্তুগিজ পাদ্রি মানুয়েল দ্য আসসুম্পসাউ ঢাকার দক্ষিণে ভাওয়াল এলাকার নাগরী নামক খ্রিস্টানপল্লীতে ১৭৩৪ সালে পর্তুগিজ ভাষায় রচনা করেন বাংলা ব্যাকরণ। তার গ্রন্থের দুটি অংশ ছিল। একটি ব্যাকরণ। আরেকটি পর্তুগিজ-বাংলা ও বাংলা-পর্তুগিজ অভিধান। মানুয়েলের কাজটি এদেশে ছাপার সুযোগ সে আমলে ছিল না। দশ বছর পর ১৭৪৩ সালে পর্তুগালের রাজধানী লিসবন থেকে সেটি রোমান হরফে ছাপা হয়। বাংলা ভাষার দ্বিতীয় ব্যাকরণগ্রন্থের প্রণেতাও একজন বিদেশি। তার নাম ন্যাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেড। ১৭৭৮ সালে হ্যালহেড যে ব্যাকরণগ্রন্থ প্রকাশ করেন, তা উপমহাদেশের মুদ্রণ ইতিহাসের স্মরণীয় অংশ। কারণ বইটি এদেশে ছাপা হয় এবং এটি মূলত ইংরেজি ভাষায় রচিত হলেও উদাহরণস্বরূপ কিছু বাংলা হরফও ছাপা হয়। কোনও পুস্তকে প্রথমবারের মতো বাংলা হরফ ছাপানোর কৃতিত্বটিও এখানে দেখা যায়। এজন্য বাংলা হরফগুলো ছাপার উপযোগী কাঠের ব্লক বানিয়েছিলেন চার্লস উইলকিনসন ও পঞ্চানন কর্মকার। পুরো আঠারো শতকে এই দুটি নমুনা ছাড়া ব্যাকরণ রচনার আর কোনও উদাহরণ পাওয়া যায় না।
উনিশ শতকে বাংলা ব্যাকরণ লেখার অনেকগুলো নমুনা দেখা যায়। এর কিছু বিদেশি লেখকদের দ্বারা ইংরেজি ভাষায় রচিত। বাকিগুলো স্থানীয় পণ্ডিতদের দ্বারা প্রণীত। ইংরেজ কোম্পানি কর্তৃক কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তাছাড়া শ্রীরামপুরে প্রতিষ্ঠিত উইলিয়ার কেরির ছাপাখানাও বাংলা মুদ্রণ এবং ব্যাকরণচর্চায় ঐতিহাসিক অবদান রাখে। ইংরেজ আমলে বিদেশি লেখক ও সংস্কৃত পণ্ডিতদের দ্বারা প্রণীত ব্যাকরণ ল্যাটিন এবং সংস্কৃত ভাষার রীতি মেনে লেখা এবং বাংলাকে সে ধাঁচে ফেলে আলোচনা করা হয়। অনেক কঠিন নিয়ম তখন বাংলা ব্যবহারে চাপিয়ে দেওয়া হয়। শব্দ গঠন, বাক্য গঠনে বিদ্যমান থাকে অনেক প্রাচীন রীতি।
ক্রমে ক্রমে ভাষার ব্যবহারবিধিতে জটিলতা এড়িয়ে অনেক নিয়ম সহজ করা হয়। ব্যাকরণ যেমন ভাষা ব্যবহারের নিয়ম নির্ধারণ করে, তেমনি মানুষ ও সমাজ তাদের ভাষাচর্চায় দীর্ঘকাল যাবৎ অন্তর্ভুক্ত অনেক কিছুকেই ব্যাকরণ-সিদ্ধ করে নেয়। ফলে ব্যাকরণকে অনড় বা স্থবির হলে চলে না বা উপর থেকে চাপিয়ে দিলেও কাজ হয় না। ব্যাকরণকে মানুষ ও সমাজে প্রচলিত ভাষার গতি-প্রকৃতি ও মনোভাবটিকেও আত্মস্থ করতে হয়। একারণেই ব্যাকরণ একটি জীবন্ত ভাষার জন্য নিজেকে জীবন্ত রাখতে বাধ্য হয়। সময় সময় নানা পরিবর্তন ও অদল-বদল মেনে নিতে হয়।
ঢাকায় ভাষা আন্দোলনের কারণে এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাভাষার যেমন অভূতপূর্ব বিকাশ সাধিত হয়েছে, তেমনি ব্যাকরণেও বিদেশি প্রভাব অনেকাংশে লুপ্ত হয়েছে। বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তরফে বাংলাদেশের মানুষের জন্য ভাষাচর্চার নির্দেশনামূলক সহজ ও বোধগম্য ব্যাকরণ প্রণীত হচ্ছে। এখন হাতের কাছে পাওয়া যাচ্ছে একাধিক ব্যাকরণগ্রন্থ। ইচ্ছে করলেই যে কেউ ব্যাকরণ অনুসরণ করে পরিশীলিত ও শুদ্ধ বাংলা চর্চা করতে পারেন।
বাংলাদেশ সময়: ১০২৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০১৮
এমপি/জেএম