মুখের ভাষায় বা চলতি কথায় আমরা যে বলতে পারি, ‘স্কুল থেকে এসে আমি খেতে বসেছি’, তা মানা হয়নি। বহু বছর মাথা-ভারী পণ্ডিতদের সঙ্গে লড়াই করে চলতি রীতির জয় হয়েছে।
সাধু থেকে চলতিতে আসতে অনেক লড়াই করতে হয়েছে। পণ্ডিতরা বারবার প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘মুখের ভাষা কি কখনও হতে পারে উৎকৃষ্ট সাহিত্যের ধারক কিংবা বাহক? নাকি সাহিত্যের জন্য প্রয়োজন এক পৃথক ভাষার? যে ভাষা হবে মুখের ভাষার চেয়ে আরও গম্ভীর, হবে এক আলাদা সত্তা?’
বাংলা গদ্য-সাহিত্যের ইতিহাসে এই বিতর্ক অতি পুরাতন। বিগত শতাব্দীর গোড়ার দিকে ভাষা ব্যবহার নিয়ে উদ্ভুত বির্তকটি সঙ্কটে রূপ নেয়। সাধুভাষা ও চলিত ভাষার সেই লড়াই ছিল বাংলা গদ্যের ইতিহারে এক যুগসন্ধিক্ষণ। কারণ, অবশেষে সেই লড়াই পেরিয়েই নির্ধারিত হয়েছে বাংলা গদ্য কোন পথে হাঁটবে। অবশ্যই পথটি চলিত ভাষার দিকেই প্রসারিত হয়েছে।
বাংলা গদ্যভাষার ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, ভাষা নিজেই নিজের পথ খুঁজে নিয়েছে। পদ্যকে ঠেলে ধীরে ধীরে গদ্যকে দাঁড়াতে হয়েছে। কারণ, বাংলাভাষার শুরু ছিল পদ্যভিত্তিক। বাংলা সাহিত্যের আদি যুগে তো বটেই, মধযুগেও মাতামাতি ছিল কাব্যচর্চার। চিঠিপত্র, দলিল-দস্তাবেজের বাইরে বাংলা গদ্যের ব্যবহার একেবারেই ছিল না। বাংলা গদ্যভাষা চিঠি এবং দলির-পত্রের গণ্ডি পেরিয়ে প্রথম মুক্তির স্বাদ পেলো বিদেশিদের হাত ধরে। প্রথমে পর্তুগিজ পাদ্রি মানুয়েল দ্য আসসুম্পসাউ-এর ছাপা বইয়ে। সেই বই যদিও লেখা হয়েছিল রোমান হরফে বা আজকের ইংরেজি বর্ণে, তথাপি তিনি যা লিখেছিলেন, তা ছিল বাংলা গদ্য, মোটেও পদ্য নয়। এর আরও কয়েক বছর পর পাদ্রি রেভারেন্ড উইলিয়াম কেরির শ্রীরামপুর খ্রিস্টান মিশনের বিভিন্ন বইয়ে বাংলা গদ্য জায়গা পেলো।
ইংরেজ-শাসিত কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ব্রিটিশ কর্মচারীদের বাংলা শেখানোর জন্য কেরি সাহেব নিজে এবং অন্যদের (রামরাম বসু, মৃত্যুঞ্জয় তর্কালঙ্কার) দিয়ে একের পর এক বাংলা বই লিখিয়েছিলেন, গদ্য ও ব্যাকরণ তৈরি করিয়েছিলেন। যদিও সেগুলো বিশেষভাবে সংস্কৃত ও ল্যাটিন ভাষার রীতি দ্বারা প্রভাবিত ছিল, তথাপি বাংলা গদ্যভাষাটি রূপ লাভ করতে থাকে। এবং যারা সে গদ্য শিখছিলেন, তারা সাহিত্য করার জন্য নয়, চাকরি-ব্যবসা-কাজের প্রয়োজনেই সেটি
শিখছিলেন। জন্ম থেকেই বাংলা গদ্যের ছিল ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তা। কেরি সাহেব তার ধর্মীয় মত প্রকাশের জন্য বাংলা ভাষাকে অবলম্বন করে পত্র-পত্রিকাও বের করেছিলেন (সমাচার দর্পণ, দিগদর্শন)। পরে রামমোহন, বিদ্যাসাগর প্রমুখ বাংলা গদ্যচর্চাকে ক্রমান্বয়ে এগিয়ে নিতে থাকেন। যদিও সে সময়ের বাংলা গদ্য ছিল সাধু রীতিতে রচিত। সবশেষে যেজন বাংলা গদ্যে চলতি রীতিকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেন, তার নাম প্রমথ চৌধুরী (১৮৬৪-১৯৪৬), যে মানুষটি খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে চলিত ভাষায় লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।
আজকের যুগে বাংলা গদ্যভাষা মানেই চলিত ভাষা। সাহিত্যসহ সর্বক্ষেত্রেই চলিত বাংলা ভাষায় গদ্য-পদ্য ইত্যাদি রচিত হচ্ছে। সাধু ভাষা শুধু মুষ্টিমেয় বই এবং পুরনো পত্র-পত্রিকার পাতায় রক্ষিত আছে। আধুনিক গদ্যচর্চায় চলিত ভাষার ব্যাপক প্রসারের মাধ্যমেই এগিয়ে চলেছে বাংলাভাষা। অতীত ইতিহাসের গর্ভেই শুধু লুকিয়ে রয়েছে সাধু-চলিতের লড়াইয়ের কথা।
তবে, লড়াইটি শেষ হলেও একটি বিষয় কিন্তু এখনও শেষ হয় নি। সেটি হলো সাধু-চলিতের মিশ্রণ। বাংলাভাষা ব্যবহারে সাধু আর চলিতের মিশ্রণ করা চলবে না। যদি কোনও লেখা সাধু ভাষার গদ্যে লেখা হয় তো সেটির পুরোটাই একই ভাষা রীতিতে লিখতে হবে। চলিতে লিখতে সম্পূর্ণ লেখাটিই চলিত গদ্যভাষায় হতে হবে। কিছুটা সাধু, কিছুটা চলিততে কোনও রচনা সম্পন্ন করা চলবে না। এই ধরনের মিশ্রণকে বলা হয় ‘গুরু-চণ্ডালী’। গুরু আর চণ্ডাল যেমন একই আসনে বসে না, সাধু আর চলতিও একই লেখায় চলবে না। বাংলা ভাষাচর্চার সময় এই বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে লক্ষ্য রাখতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১০৪৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৮
এমপি/ জেএম