বাংলাভাষা বাংলাদেশের মানুষের কাছে শুধু একটি ভাষাই নয়, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-ঐতিহাসিক চেতনার ভিত্তিমূলও। একমাত্র এই বাংলাভাষাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে একটি জাতিসত্তা, একটি দেশ।
বাংলাভাষার উদ্ভবের পর সুদীর্ঘ কালপরিক্রমায় এর বিকাশ সাধিত হয়েছে। গৌড়ীয় প্রাকৃত ভাষা থেকে বাংলাভাষার উদ্ভব হয়েছে বলে দাবি করা হলেও ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে গৌড়ীয় প্রাকৃতের পরবর্তী স্তর গৌড়ীয় অপভ্রংশ থেকে বাংলা ভাষার উৎপত্তি। বাংলাভাষা প্রায় ১৫০০ বছরের পথ অতিক্রম করে নানা বিরূপতা ও আঘাতকে সামাল দিয়েই আজকের এই পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে।
প্রাচীনকালের বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ, মধ্যযুগে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল এবং পরবর্তী সময়ে উইলিয়াম কেরি, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, প্রমথ চৌধুরীসহ খ্যাতনামা সাহিত্যিক, লেখক ও কবির অসামান্য অবদান বাংলাভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে। সাহিত্যপ্রতিভার অবদানের সঙ্গে সঙ্গে ভাষারক্ষায় জীবন ও রক্তদানকারী অসামান্য অবদান বাংলাদেশের মানুষের।
বাংলাদেশের মানুষের অম্লান ও সাহসী অবদানে বিশ্বসাহিত্যর ভাণ্ডারে বাংলাভাষা অর্জন করেছে এক বিশেষ ও সম্মাজনক স্থান। সারা পৃথিবীতে আমরাই একমাত্র জাতি, যারা বাংলা ভাষার জন্য জীবন বিসর্জন দিয়েছে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের (আজকের বাংলাদেশ) ওপর পশ্চিম পাকিস্তান যে অত্যাচারের খড়্গ চালায়, তার প্রথম আঘাত আসে বাংলাভাষার ওপর। ফলে ১৯৪৭ সালের কিছুকাল পর থেকেই শুরু হয় বাংলাভাষাকে রক্ষার লড়াই। লড়াইয়ের ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-শিক্ষক, জনতা সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদ করে এবং ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিলে অংশগ্রহণ নিয়ে ভাষার জন্য জীবন বিসর্জন দেয়। এরই স্বীকৃতিস্বরূপ আমাদের ভাষার অধিকার রক্ষিত হয় এবং ভাষা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পথ বেয়ে রাজনৈতিক লড়াইয়ের সূচনা ঘটে। যার সফল পরিণতিই হলো স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা।
বাংলাদেশের মানুষ তারপরেও ভাষা-চেতনা ও ভাষা-প্রতিষ্ঠার লড়াই থামিয়ে রাখেনি। আন্তর্জাতিক স্তরে বাংলার মযাদা রক্ষার্থেও চলে অব্যাহত প্রচেষ্টা। এভাবেই ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুরারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে এবং ২০০০ সাল থেকে পৃথিবীর প্রায় সব স্বাধীন দেশ ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদযাপন করে আসছে।
তবে ভাষার জন্য গোটা বিশ্বে বাঙালি জাতি এক বিশেষ মর্যাদায় আসীন হলেও সমাজে বা উচ্চশিক্ষার সব ক্ষেত্রে বাংলাভাষার প্রয়োগ এখনও সম্ভব হয়নি। বর্তমানে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ভাষার ব্যাপক ব্যবহার দেখতে পাই। এর ফলে শির্ক্ষার্থীদের মধ্যে না বুঝেই মুখস্থ করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ফলে শিক্ষার আসল উদ্দেশ্যে ব্যাহত হচ্ছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইংরেজির ব্যবহার আরও বেশি হয়ে থাকে।
এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির মান নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত বেশিরভাগ শিক্ষার্থী বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করে আসার পর হঠাৎ করেই উচ্চশিক্ষায় ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করতে বাধ্য হলেও আত্মস্থ করা, চিন্তা করা ও মনে রাখার প্রক্রিয়াটি বাংলাতেই হয়ে থাকে। এতে শিক্ষার্থীরা না শিখছে বাংলা, না ইংরেজি।
স্বাধীনতার পর দেশে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম বাংলা করা হয়। কিন্তু উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ আমরা কমই দেখতে পাই। অথচ প্রচলিত শিক্ষানীতিতে উচ্চশিক্ষায় আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে সব ডিগ্রি কোর্স পর্যায়ে ১০০ নম্বরের ইংরেজি বিষয় সব শিক্ষার্থীর জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসেবে এখনও বাংলার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়নি।
বাংলাকে সরিয়ে রাখার কুমতলবে অনেকে এই সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে বলেন, উচ্চশিক্ষায় বাংলায় মানসম্মত বইপত্র পাওয়া যায় না। কিছু বইপত্র পাওয়া গেলেও তা দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য সহায়ক নয়। এছাড়া অনেকে বলেন বাংলাভাষার শব্দভাণ্ডার অপ্রতুল। একারণে বাংলা মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা লাভ করা সম্ভব নয়। এসব সমস্যা মোকাবেলায় প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নেই বললেই চলে।
অনন্য বাংলাভাষা একদিনে তৈরি হয়নি। গতিশীল বাংলাভাষাও প্রতিদিন তৈরি হচ্ছে। একুশের চেতনা বাংলাভাষা ও সংস্কৃতির অবিরাম বিকাশের ডাক দিচ্ছে। ভাষাচর্চা, ভাষাবিকাশ ও ভাষার প্রতিষ্ঠা তাই প্রতিদিনের, প্রতিক্ষণের কর্তব্য।
বাংলাদেশ সময়:০৯৩৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৮
এমপি/জেএম