বলতে গেলে ভারতের এই নিভৃত কোণে একটি নিরব বিপ্লব ঘটে গিয়েছে, যার তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী।
ভারতের চারদিকে চারটি ভৌগোলিক এলাকায় রাজনীতির ভরকেন্দ্রগুলো ছড়িয়ে আছে।
এবার তারা প্রথমবারের মতো পূর্বাঞ্চলে শক্তি সঞ্চয় করেছে। বাঙালি অধ্যুষিত ত্রিপুরা-বিজয় পার্শ্ববর্তী অপরাপর বাংলাভাষী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে। এর ফলে বিজেপির আরেক লাভ হলো এই যে, দলটি সর্বভারতীয় স্তরে সাংগঠনিক স্বীকৃতি লিপিবদ্ধ করেছে। কেউ আর এখন বিজেপিকে বিশেষ অঞ্চলের রাজনৈতিক দল বলতে পারবে না।
এর আগে পশ্চিমবঙ্গের বাম দুর্গ জয়ের বিষয়টি আগাম আঁচ করা গিয়েছিল। মমতার উত্থানের ছাপ স্পষ্টভাবে টের পাওয়া গিয়েছিল আগেভাগেই। কিন্তু উত্তর-পূর্ব ভারতের ত্রিপুরায় এমন বিপর্যয় কেউ কল্পনাও করেননি। এ অঞ্চলের নাগাল্যান্ডেও বিজেপির উত্থান হয়েছে। অতীতে একটিও আসন না পেয়ে এবার ভূমিধস বিজয় ছিনিয়ে ত্রিপুরার ক্ষমতা দখল বিজেপি'র বিস্ময়কর রাজনৈতিক সাফল্যেরই প্রমাণবহ। মেঘালয়েও কংগ্রেসের বিজয়কে ছাপিয়ে সরকার গড়ছে বিজেপি'র মিত্র। ত্রিপুরাকে কেন্দ্র করে সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারতে বিজেপিই এখন শেষ কথা।
ভারতের সবচেয়ে গরিব মুখ্যমন্ত্রী ও ভালো মানুষ হিসাবে প্রসিদ্ধ ত্রিপুরার বামনেতা মানিক সরকার পর্যন্ত ফলাফলকে বলেছেন 'অপ্রত্যাশিত'। উন্নয়নের নানা দৃশ্যমান প্যাকেজ দিয়ে অবহেলিত ও পশ্চাৎপদ ত্রিপুরাবাসীর মনোরঞ্জনে বিজেপি'র পলিটিক্যাল ম্যাজিক চমৎকারভাবে কাজে লেগেছে।
বিজেপি'র 'পরিবর্তন' ও 'উন্নয়ন'-এর ডাকে স্রোতের মতো মিশেছে ভোটাররা। ত্রিপুরার রাজনৈতিক রণাঙ্গনে মতার্দশিক আবেদন ও জীবনের বাস্তব চাহিদার মুখোমুখি অবস্থানে জয়ী হয়েছে বাস্তবতা। মানুষ ভালো থাকতে চায়, জীবনমান বাড়াতে চায়, উন্নত জীবনের পথে যেতে চায়, ত্রিপুরায় সেটাই প্রমাণিত হয়েছে। কংগ্রেস ও বামদের মতো পুরনো দলগুলোর মতাদর্শিক বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার ফল রাজনীতি ও ভোটের মাঠে কাজে লাগেনি। কাজে লেগেছে বিজেপি'র গেরুয়া আদর্শের উন্নয়নমুখী আহ্বান।
সন্দেহ নেই, ত্রিপুরায় বিজেপি'র ক্ষমতা দখল ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোতে নতুন করে ভাবনায় ফেলেছে। দলগুলোকে এখন নতুন হিসাব কষে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কৌশল ও ছক তৈরি করতে হবে। এরই মাঝে ত্রিপুরা বিজয়ের ঢক্কানিনাদের মধ্যে একটি ছোট অথচ তাৎপর্যপূর্ণ খবর অনেকেরই নজর এড়িয়ে গিয়েছে। সেটা হল, উত্তরপ্রদেশের আসন্ন দুটি উপনির্বাচনে মায়াবতী আর অখিলেশ জোট বাঁধার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বিজেপিকে রুখতে। সামনের গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী বছর ২০১৯ সালেও যদি এমনই হয় আর কংগ্রেস থাকে এই জোটের সঙ্গে, তাহলে ভারতীয় রাজনীতিতে বিরাট মেরুকরণ ঘটবে। ত্রিপুরায় বিজেপির বিজয় দেখে পশ্চিমবঙ্গে মমতা, কংগ্রেস ও বামদলগুলোকে নতুন মেরুকরণের পথে হাঁটতে হবে।
ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে দেখা গেছে, একদা প্রবল শক্তিশালী কংগ্রেসের দেশজোড়া আধিপত্য, দলীয় নেতৃত্বের অহং ও ঔদ্ধত্য অনেক সময়ই কংগ্রেস বিরোধীদের এক জায়গায় নিয়ে এসেছিল। যেমন ১৯৭৭ কিংবা ১৯৮৯ সালে। তখন কংগ্রেস বিরোধিতাই ছিল বিরোধীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার একমাত্র চালিকাশক্তি।
আজ কংগ্রেসের সেই শূন্যস্থানটি পূরণ করেছে বিজেপি। বিজেপি’র বাড়বাড়ন্ত যত সর্বগ্রাসী হচ্ছে ততই বাড়ছে এ দলের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার তাগিদ। সেই তাগিদই কাছাকাছি নিয়ে আসছে আপাত শত্রু ও পরস্পরবিরোধী 'অহি ও নকুলকে'!
ত্রিপুরার নির্বাচনী ফল ভারতীয় রাজনীতিতে কোন ইঙ্গিত জানিয়ে গেল, সেটাই এখন দেখার বিষয়। এই নির্বাচনী ফলাফল ভারতীয় রাজনীতির সামনের দিনগুলোর জন্যে যে বিরাট প্রভাবক হয়ে কাজ করবে, একথা বলাই বাহুল্য।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪০ ঘণ্টা, মার্চ ০৫, ২০১৮
এমপি/জেএম