দিনভর উদ্ধারকারী জাহাজ হামজা আর রুস্তমের পাশে নৌকায় ঘুরে ঘুরে উদ্ধারকাজ দেখছিলাম। সেইবার মরদেহের সংখ্যা ছিলো শেষতক ১৪৬ জন।
তবে এবারে নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বেসরকারি উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় ৫১ জন মানুষের মৃত্যুর কষ্টটা যেন পুনরাবৃত্তি হয়ে মনে দাগ কেটে যাচ্ছে। শুধু কি আমারই এমনটা হচ্ছে! অন্যদের সঙ্গেও নিজের এই অনুভূতি শেয়ার করলাম। একটি বেসরকারি সংস্থার মনোবিশেষজ্ঞ বন্ধুপ্রতীম সিজা সারজামের সঙ্গে কথা হলো। তিনি বললেন, আমারও এমনটা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে হুট করেই জীবনটা শেষ হয়ে যেতে পারে। মুহূর্তের মধ্যেই আমাদের মৃত্যু হতে পারে!
ঢাকা শহরজুড়ে শোকের ছায়া। সোমবার সন্ধ্যা থেকেই মানুষের মন খারাপ হয়েছে। কোনো কিছুতেই যেন আর আনন্দ খুঁজে পাচ্ছে না। ফেসবুকে ঢুকলেই আরো মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। সাংবাদিক হিসেবে বন্ধু তালিকায় সাংবাদিকের সংখ্যাই বেশি। সেখানে বারবার ঘুরে ফিরে আসছে বৈশাখী টেলিভিশনের রিপোর্টার ফয়সাল ভাইয়ের ছবি। অনেকবারই অ্যাসাইনমেন্টে দেখা হয়েছিলো। কেমন যেন স্মৃতির মতো ঘুরে আসছিলো। এটা মেনে নিতে কষ্ট হয় যে ফয়সাল ভাই স্মৃতি। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর কর্মকর্তা সানজিদা হক বিপাশার সঙ্গে সাংবাদিকদের যোগাযোগ ছিলো নিয়মিত। সেই বিপাশা আপাও ছিলেন ইউএস বাংলার বিএসএস২১১ ফ্লাইটে। বিপাশা আপার স্বামী রফিক উজ জামান ভাই, অনিরুদ্ধ, শশী, পিয়াস রায়, উম্মে সালমা’র ছবিগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার (১৫ মার্চ) সারাদেশে রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া শুক্রবার (১৬ মার্চ) মসজিদ-মন্দিরসহ সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও উপাসনালয়ে দোয়া-প্রার্থনা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এক প্রজ্ঞাপনে জানিয়েছে, গত ১২ মার্চ (সোমবার) নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলার বিএস২১১ নম্বর ফ্লাইট বিধ্বস্ত হয়ে দেশি-বিদেশি ৫১ জন আরোহীর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা এবং তাদের শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা ও সহমর্তিতা প্রকাশ করা হয়েছে।
এই দেশে যারা উড়োজাহাজের যাত্রী তারা এক কথায় স্বীকার করবেন যে বাংলাদেশে বেসরকারি উড়োজাহাজকে মানুষের অনেক কাছে নিয়ে এসেছে ইউএস-বাংলা। গত তিন বছরে এখানকার মধ্যবিত্তদেরও উড়োজাহাজে ওঠার শখ বা প্রয়োজন পূরণ করেছে। যেখানে ঢাকা থেকে কক্সবাজারের উড়োজাহাজের ভাড়া ছিলো ১৮ হাজার টাকা, এখন তা ৯ হাজার টাকায় নেমে এসেছে। এই কোম্পানির সঙ্গে মধ্যবিত্তের একটি সর্ম্পক গড়ে উঠেছে। স্মৃতি জমা পড়েছে। জরুরি কারণে ঢাকা থেকে বরিশাল যাওয়া বা সিলেট থেকে ঢাকা আসার ক্ষেত্রে এই এয়ারলাইন্সে ভর করার সময়গুলো ভেসে আসছে।
মঙ্গলবার সকালে সচিবালয়ে গিয়েছিলাম। আমার এক বন্ধু বললেন, এই এয়ারলাইন্সে করে আমি যশোর হয়ে বাড়ি গিয়েছি। অথচ এই এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজ যে এভাবে আঁছড়ে পড়লো! মন থেকে কষ্টটা যাচ্ছে না, হয়তো যশোরে যাওয়ার দিনও এরকম হতে পারতো।
ঢাকায় এখন পয়সা কার পকেটে বেশি, সেই হিসেব বাদ দিলে এখানে মধ্যবিত্ত আর নিম্মমধ্যবিত্তের সংখ্যাই বেশি। মধ্যবিত্তের জীবনে আবেগ আর বাস্তবতার এক মিশেল থাকে। সেখানে ট্রাজিকের জায়গা বা ঘটনার সঙ্গে নিজের সম্পর্ক ঘটিয়ে বারবার ঢুঁকড়ে ওঠেন।
নিজের জীবন উৎসর্গ করে ১০ জন নেপালি যাত্রীকে বাঁচিয়েছেন বাংলাদেশের বাণিজ্যিক এয়ারলাইন্সের প্রথম নারী পাইলট পৃথুলা রশিদ। তিনি কো-পাইলটের দায়িত্বে ছিলেন। এ কারণে নেপালের গণমাধ্যম পৃথুলাকে ‘ডটার অব বাংলাদেশ’ নামে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। মৃত্যুকে বরণ করে পৃথুলা যেন বাংলাদেশকে আবারও গর্বিত করেছেন। শহরের মানুষ এই খবর দেখে মন ভালো করতে চাইছে, কিন্তু মন কি ভালো হয়!
বাংলাদেশ সময়: ১৭০৭ ঘণ্টা, মার্চ ১৪, ২০১৮
এমএন/জেডএস