বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস কখনোই সম্পূর্ণ ও সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ হতে পারে না ভারতের বহুমাত্রিক অবদানের আলোচনা ছাড়া। ভারতের বহুমুখী ভূমিকা সে রক্তাক্ত ইতিহাসের একটি বড় জায়গা জুড়ে রযেছে।
মুক্তিযোদ্ধা, গবেষক ও সাংবাদিক হারুন হাবীব রচিত 'বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত' বইটি এক বিস্তারিত গবেষণার ফসল। তিন খণ্ডে (ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয় ও পশ্চিমবঙ্গ) প্রকাশিত গবেষণায় বিশেষ যত্ন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ভারত ও ভারতবাসীর নানামুখী অবদান পরিস্ফূটন করা হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই বইটির খণ্ডগুলো নিঃসন্দেহে অনন্য দলিল হিসেবে বিবেচিত হবে।
সময় নিয়ে ও অত্যন্ত যত্ন করে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা-লেখক হারুন হাবীব গবেষণাটি সম্পন্ন করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, কলকাতা, আগরতলা, গুয়াহাটি এবং শিলংয়ের সহযোগী গবেষকদের নিষ্ঠা ও ভালোবাসায় এবং তার নিজস্ব উদ্যোগে, কয়েক বছর ধরে যে অনুসন্ধানী তৎপরতা চলেছিল, সেই কাজের ফসল “বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত” গ্রন্থত্রয়ী। তিন খণ্ডের বিশালাকার এই গ্রন্থ মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় অংশের ঐতিহাসিক ও বহুমাত্রিক কর্মযজ্ঞের দলিল।
পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা এবং আসাম ও মেঘালয় খণ্ডে বিভক্ত এই গ্রন্থত্রয়ী উৎসর্গ করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলোর মানুষকে, যাঁরা ইতিহাসের যুগ-সন্ধিক্ষণে নিজেদের আবেগ ও যুক্তিতে বরণ করে নিয়েছিলেন ১ কোটি শরণার্থীকে, একাত্ম হয়েছিলেন পরম বন্ধু হয়ে বাংলাদেশের রক্তাক্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের কাতারে। এই গ্রন্থ ও গবেষণার মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারতের চিরায়ত মৈত্রীর ঐতিহাসিক রূপটিকে দালিলিত প্রমাণের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন মুক্তিযোদ্ধা-লেখক হারুন হাবীব।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযদ্ধকে ঘিরে বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের মাটিতে যে বহুমাত্রিক তৎপরতা চলেছিল ১৯৭১ এর নয় মাসে, সেইসব অজানা তথ্য ও বিবরণী উঠে এসেছে বইগুলোর তিনটি খণ্ডে। এতে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসের সঙ্গে ভারতের সংশ্লিষ্টতার আনুপূর্বিক বৃত্তান্ত ঐতিহাসিক গবেষণার আলোকে উপস্থাপিত হলো।
এতে আরও গ্রন্থিত হয়েছে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় ভারত সরকারের অসামান্য আন্তর্জাতিক কূটনীতির বিবরণ, যা মার্কিণ-চীন বলয়ের বাইরে দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধকে সেদিন রণাঙ্গনে ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সফল পরিণতির দিকে ধাবিত করেছিল।
মুক্তিযোদ্ধা-লেখক হারুন হাবীব জানিয়েছেন, 'গবেষণার কাজটি হাতে নেয়ার চিন্তা আসে মুক্তিযুদ্ধে আমার নিজের অংশগ্রহণের তাগিদ থেকে; মনে হয়েছে, সেই গৌরবময় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলোর সংরক্ষণও আমার কাজ। '
কাজটি তিনি আবেগ ও নিষ্ঠার মেলবন্ধনে চমৎকারভাবে সম্পন্ন করেছেন। ফলে এই দালিলিক গ্রন্থত্রয়ী গবেষক, ইতিহাসবিদ ও তথ্যানুরাগী পাঠকদের দ্বারা আদৃত হবে এবং প্রকৃত ইতিহাসের আলোকিত রূপরেখার সন্ধান দেবে।
১৯৭১ সালে হারুন হাবীব অস্ত্র ও কলম হাতে মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ রণাঙ্গনে সরাসরি অংশগ্রহণ ও ভূমিকা পালন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের পর সাহিত্য, গবেষণা ও বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে শাণিত এবং সামাজিক-রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিজয়ী করার কাজ করে চলেছেন।
তার হাত দিয়ে বাংলাদেশের কথাসাহিত্য পেয়েছে 'প্রিয়যোদ্ধা, প্রিয়তম'-র মতো মুক্তিযুদ্ধের উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। একদা বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসাবে দেশব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যা ও তৃণমূল ইতিহাস রচনার সাহসিক উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় তার জীবনব্যাপী প্রচেষ্টারই অংশ হলো মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান শীর্ষক বর্তমান গবেষণাকর্ম।
প্রকাশনা সংস্থা ‘সাহিত্য প্রকাশ’ ও তার কর্ণধার, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের টাস্ট্রি মফিদুল হক সবিশেষ যত্নে এই বিশালাকার গ্রন্থত্রয়ী পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করার জন্য ধন্যবাদার্হ।
মুক্তিযোদ্ধা-কথাশিল্পী-সাংবাদিক হারুন হাবীবের নিজস্ব অংশগ্রহণ, নিষ্ঠা ও নিবেদনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধে চেতনাকে তাত্ত্বিক-মতাদর্শিকভাবে ধারণ ও চর্চার ফলিত-ব্যবহারিক প্রমাণপত্র “বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত” গ্রন্থটি জাতীয় ইতিহাস ভাণ্ডারে এক অনবদ্য সংযোজন।
বাংলাদেশ সময়: ১৪০৯ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৮
এমপি/জেএম