‘গনা’ ডাকনামের সেই ছেলেটির গালভারী নাম ছিল ব্যারিস্টার জ্যোতিরিন্দ্র বসু। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে এই বাঙালি উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের বিশ্বজুড়ে পরিচয়, কমরেড জ্যোতি বসু।
১৯৯৬ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পেয়েও নিবেদিতপ্রাণ কম্যুনিস্ট এই রাজনীতিক নিজ দলের অনুমতি না পাওয়ায় প্রত্যাখ্যান করেছেন কেন্দ্রীয় সরকার গঠনে প্রস্তুত রাজনৈতিক জোটের আমন্ত্রণ। যদিও একটানা তেইশ বছর (১৯৭৭-২০০০) বাম ফ্রন্ট থেকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় কোনো রাজ্যে সরকারপ্রধানের পদে থাকার এক রেকর্ড রয়েছে তার।
আলোকচিত্র সাংবাদিক এ কে এম মহসীন তার তোলা জ্যোতি বসুর সঙ্গে আমার প্রচ্ছদের ছবিটি ঢাকা থেকে পাঠিয়েছেন দিন কয়েক আগে। ছবিটি দেখেই স্মৃতিতে জেগে উঠলো ৩১ বছর আগের সেই অনন্য অভিজ্ঞতার কথা।
১৯৮৭ সালে জ্যোতি বসুর এই স্মৃতিময় সফরের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে বারদীতে তার সঙ্গেই ছিলাম সেই দিনটি। তারিখটি ছিল সম্ভবত ৩০ জানুয়ারি। কাছাকাছি হওয়ার সুযোগে স্বল্পভাষী এই জননেতার সঙ্গে আমার অল্প কয়েকটি বাক্য বিনিময় হলেও সেই দফায় আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎকার নেওয়া সম্ভব হয়নি কোনো সাংবাদিকের পক্ষেই।
সেটা ছিল স্বৈরশাসক লে. জে. হু. মু. এরশাদের শাসনকাল। গণমাধ্যম ও তার কর্মীদের জন্য নানাবিধ কড়াকড়ির সময়। তার মধ্যেই বিধিনিষেধের সীমানা ছাড়াতে গণমাধ্যম কর্মীদের দুর্দমনীয় সাহসের পরিচয়।
নারায়ণগঞ্জের কৃতি সন্তান অগ্রজ সাংবাদিক ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ পত্রিকার চিফ রিপোর্টার শফিকুল কবীর নিজ উদ্যোগে দায়িত্ব নিলেন ঢাকা থেকে বারদী অভিমুখী সাংবাদিকদের আসা-যাওয়া এবং তার সুবিদিত ও প্রশংসিত বিপুল আপ্যায়নের।
সেদিন শুক্রবার ভোরে জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে আমরা একদল সাংবাদিক মিনিবাসে করে সোনারগাঁওয়ে মেঘনা নদীর তীরে বৈদ্যেরবাজার পৌঁছাই। সেখান থেকে মেঘনার বুকে ইঞ্জিনচালিত নৌকো চেপে বারদী। সহযাত্রী বেশিরভাগই অগ্রজ সাংবাদিক। ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ থেকে শফিকুল কবীর ভাই ছাড়াও কলকাতার ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র প্রতিনিধি আলমগীর হোসেনও জাকারিয়া মিলন, ‘দৈনিক জনতা’র খন্দকার মহিতুল ইসলাম রঞ্জু, ‘দৈনিক বাংলা’র হাসান হাফিজ, ‘দৈনিক মিল্লাত’র কাজিম রেজা, ‘দৈনিক খবর’ থেকে কূটনৈতিক রিপোর্টার আমি। সেসময় আমি কলকাতার ‘সাপ্তাহিক দেশ’ পত্রিকার প্রদায়কও ছিলাম। আরও বেশ কয়েকজন সাংবাদিক ছিলেন। এই মুহূর্তে মনে নেই সবার নাম। এক ঝাঁক আলোকচিত্র সাংবাদিকের মধ্যে ছিলেন আলহাজ্ব জহিরুল হক এবং এ কে এম মহসীন। একচল্লিশ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে সময় লেগেছিল প্রায় আড়াই ঘণ্টা।
বেলা ১০টার খানিক পর হেলিকপ্টারে করে ঢাকা থেকে এসে পৌঁছালেন অতিথি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। সঙ্গে স্ত্রী কমল বসু ও শ্যালিকা। কপ্টার থেকে নামতেই স্বাগত জানালেন নারায়ণগঞ্জ ও স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তারা। পায়ে হেঁটে তিনি ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন গ্রামটি।
বারদীর সবচেয়ে বেশি পরিচিতি হিন্দু যোগী সাধক শ্রী শ্রী বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর (১৭৩০-১৮৯০) আশ্রমের জন্য। আশ্রমের চৌহদ্দির মধ্যে মানুষ সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাতসহ নানাভাবে প্রণতি জানাচ্ছে প্রয়াত যোগী সাধুর প্রতি। দেখলাম দেয়ালে উৎকীর্ণ সাধুর কিছু বাণী। একটি বাণীতে দৃষ্টি আটকে গেল আমার, ‘সারা বিশ্ব ঘুরিয়া নিজেকে ছাড়া মাত্র দুইজন শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ দেখিয়াছি, মক্কায় আবদুল গফুর ও ভারতে তৈলঙ্গ স্বামী’!
সেই আশ্রমের সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় থমকে দাঁড়ালেন তিনি। তাঁর স্ত্রী কমল বসু ছোট বোনকে সঙ্গে নিয়ে চৌহদ্দির ভেতরে গিয়ে শ্রদ্ধা তর্পণ করলেন সাধু লোকনাথ ব্রহ্মচারীর প্রতি। প্রখর দৃষ্টি ছিল আমার কম্যুনিস্ট জ্যোতি বসু কী করেন দেখার জন্য। প্রণাম বা কপালে করস্পর্শ নয়। তিনি কেবলই নীরবতা অবলম্বন করে স্থির হয়ে আশ্রমের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। মৌনতায় শ্রদ্ধা।
পিতা ডাক্তার নিশিকান্ত বসুর কর্মস্থল কলকাতায় ১৯১৪ সালে জন্মগ্রহণ করলেও জ্যোতি বসু পূর্বপুরুষের ভিটে বারদীতে কাটিয়েছেন বাল্যকালের এক উল্লেখযোগ্য সময়। তার বাল্যকালের দুরন্তপনার সাক্ষী বারদী গ্রামের চৌধুরীপাড়ায় মাতামহী ক্ষীরদা সুন্দরীর শতাব্দী প্রাচীন প্রায় পরিত্যক্ত দোতলা একটি ভবন, সেই ভবনে বসবাসকারী তাকে ছোটবেলায় দেখাশোনা করা নারী আয়াতুন্নেছার পুত্র প্রবীণ শহীদুল্লাহ এবং ঢেউয়ের পরে ঢেউ সাজিয়ে অবিরত বয়ে চলা উচ্ছল মেঘনা।
পরিবারের কনিষ্ঠ সন্তান জ্যোতি বসু শিশুকালে মা হেমলতাকে হারালে তাকে দেখাশোনার দায়িত্ব দেওয়া হয় বারদী গ্রামের দরিদ্র মুসলমান নারী আয়াতুন্নেছাকে। ১৯৪০ সালের দিকে ডাক্তার নিশিকান্ত বসুর পরিবার কলকাতায় স্থায়ী হয়। দেশবিভাগের পরে জ্যোতি বসু সেই আয়াতুন্নেছাকে তাদের পারিবারিক বাসগৃহে থাকার অনুমতি দেন।
ভগ্নদশা না হলেও পোড়োবাড়ির মতো পারিবারিক বাসভবনের পশ্চিমে একটি পুকুর। শ্যাওলায় প্রায় সবুজ পানি। চারিপাশে অসংখ্য গাছগাছালিতে ঢাকা। কুশল বিনিময়ের পর একটু ঘুরে ঘুরে দেখলেন জ্যোতি বসু। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে জানালেন তার ইচ্ছের কথা। পারিবারিক বাসভবন বা সংলগ্ন জমিতে একটি পাঠাগার স্থাপন। অল্প কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দিলেন। জানালেন, ছেলেবেলায় ভরা বর্ষায় তরঙ্গবিক্ষুব্ধ মেঘনায় সাঁতার কাটার দারুণ অভিজ্ঞতার কথা।
পারিবারিক বাসভবনে সপরিবারে কিছুটা সময় কাটানোর পর জ্যোতি বসু পায়ে হেঁটে ফিরে চললেন হেলিকপ্টারের দিকে। ঢাকার পথে।
আমরা রয়ে গেলাম বারদী। দুপুরে মেঘনা থেকে সেদিনই ধরা প্রকাণ্ড রুই মাছের মুড়ো ও কালিয়া এবং নানান পদ সহযোগে ভুরিভোজন। তারপরই ঢাকার পথে যাত্রা। মেঘনার বুকে দিগন্তবিস্তৃত জলরাশির মধ্যে দিয়ে নৌকোয় করে বৈদ্যের বাজার ফেরার পথে বিদ্যুৎ চমকের মতো স্মৃতি থেকে ভেসে এলো কবি আহসান হাবীবের সেই অবিস্মরণীয় পংক্তিমালা।
‘আমি মেঘনা পাড়ের ছেলে
আমি মেঘনা নদীর নেয়ে।
মেঘনা নদীর ঢেউয়ের বুকে
তালের নৌকো বেয়ে
আমি বেড়াই হেসে খেলে -
আমি মেঘনা পাড়ের ছেলে। ...’
ঢাকায় ফিরে এসে সেদিন সন্ধ্যেয় জ্যোতি বসুর বাংলাদেশ সফর নিয়ে গতানুগতিক প্রতিবেদনের পাশাপাশি তার স্মৃতিময় বারদী ভ্রমণ নিয়ে লিখলাম একটি বিশেষ প্রতিবেদন ‘মেঘনা পাড়ের সেই ছেলেটি’।
মনে পড়ে, বাংলাদেশের পাঠকমহলে সাড়া জাগিয়েছিল ‘দৈনিক খবর’-এ প্রকাশিত সেই প্রতিবেদনটি। ঢাকায় কর্মরত ভারতীয় সাংবাদিকদের কেউ কেউ জাতীয় প্রেসক্লাবে আমাকে খুঁজে নিয়ে প্রশংসা করেছিলেন হৃদয়স্পর্শী সেই প্রতিবেদনের জন্য।
আবারও বারদীতে পারিবারিক ভবনে পাঠাগার স্থাপনের ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন জ্যোতি বসু, দশ বছর পরে ১৯৯৭ সালে, তার দ্বিতীয় বাংলাদেশ ভ্রমণের সময়। সেসময়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সেই শেষ ইচ্ছের প্রতি সম্মান দেখিয়ে ওই ভবন ও সংলগ্ন জমিতে একটি জাদুঘর ও পাঠাগার স্থাপনের নির্দেশ দেন। সরকারের প্রস্তাবনা ছিল জাদুঘর ও পাঠাগারটি উদ্বোধন করবেন জ্যোতি বসু নিজেই। ২০০৯ সালে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তত্ত্বাবধানে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। তবে ২০১০ সালে জ্যোতি বসুর মৃত্যুর পরে শেষ হয় প্রকল্প ভবনের নির্মাণ কাজ। এখন চলছে জাদুঘরের জন্য জ্যোতি বসুর স্মৃতিবিজড়িত নিদর্শন সংগ্রহের কাজ। আর ২০১৩ সালের ২৪ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন ভবনে পাঠাগার ও সেমিনার হল উদ্বোধন করে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন বাংলাদেশের এই অকৃত্রিম বন্ধুর প্রতি।
১৯৭৮ সাল থেকে আমার ১৪ বৎসর একটানা প্রত্যক্ষ সাংবাদিকতা পেশায় ডজনখানেক রাষ্ট্রনায়ক ও সরকারপ্রধানের কাছাকাছি হওয়ার ও আলাপচারিতার সুযোগ হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেন গত চার দশকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী সকলেই (ফখরুদ্দীন-মঈনুদ্দীন বাদে) এবং ভারতের রাজীব গান্ধী, পাকিস্তানের জিয়াউল হক ও বেনজির ভুট্টো, শ্রীলংকার জুনিয়াস জয়াবর্ধনে, মালদ্বীপের মামুন আবদুল গাইউম, নেপালের রাজা বীরেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ ও ভুটানের রাজা জিগমে সিঙ্গে ওয়াংচুক। আর ১২ বৎসর কূটনৈতিক মিশনে কাজ করার সময় যুক্তরাজ্যের যুবরাজ প্রিন্স চার্লস ও প্রিন্সেস অ্যান এবং দুই প্রধানমন্ত্রী জন মেজর ও টনি ব্লেয়ারের সঙ্গে একদিন বা তার বেশি সময় কাটানোর অভিজ্ঞতা আছে। আরও আছে কানাডার সাবেক বিরোধী দলীয় নেতা ও নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টির (এনডিপি) নেতা প্রয়াত জ্যাক লেইটন ও অন্টারিও প্রদেশের বর্তমান প্রিমিয়ার ক্যাথলিন ওয়েনের সঙ্গে আলাপের অভিজ্ঞতাও।
এই সব বিদেশি রাষ্ট্রনায়কের মধ্যে আমার কাছে বাঙালি জ্যোতি বসুকে মনে হয়েছে অনন্য। কী ব্যক্তিত্বে, কী চারিত্রিক দৃঢ়তায়।
লেখক: সৈকত রুশদী
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ০২, ২০১৮
এইচএ/