ঢাকা, বুধবার, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

দলবদলের অতীত বর্তমান

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩২৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৯, ২০১৮
দলবদলের অতীত বর্তমান প্রতীকী ছবি

রাজনীতিতে দলবদল নতুন কিছু নয়। রাজনীতির সাথে রাজনৈতিক আদর্শ ও ক্ষমতার সম্পর্ক থাকে। রাজনীতিকদের আদর্শিক পরিবর্তন হলে অথবা দল তার আদর্শ পরিবর্তন করলে রাজনীতিকরা দল বদল করতেই পারেন। কিন্তু নীতি-আদর্শের কারণে দলবদল এখন অতীত।

রাজনীতিতে যখন ক্ষমতাই মূলমন্ত্র, তখন রাজনীতিকদের দলবদল একটি রুটিন কাজ। বিশেষ করে নির্বাচনের আগে-আগে রাজনীতিকদের দলবদলের তোড়জোড় বেশি দেখা যায়।

 
 
এরশাদের আমলে বিভিন্ন দলের নেতাদের দলবদল করতে দেখা গেছে। বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও বাম দলের অনেক নেতা দলে-দলে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে নিজেদের জন্য অশেষ নেকি হাসিল করেছেন। সাহেব-বিবির বাক্সে প্রায় প্রতিদিনই অন্যান্য দলের নেতাদের জাতীয় পার্টিতে যোগদানের সংবাদ ফলাও করে প্রচার করা হতো। তখন অনেকেই ভেবেছিলেন দেশে জাতীয় পার্টি ছাড়া আর কোনো দল থাকবে না।
 
শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন এখন বিএনপির বড় নেতা। আওয়ামী লীগ দিয়ে তার রাজনীতি শুরু। এরপর খন্দকার মোশতাক সরকারের মন্ত্রী হয়েছিলেন। মাঝে ডেমোক্রেটিক লীগও করেছেন কিছুদিন। এরপর লাঙ্গলের হাল ধরে এরশাদের মন্ত্রী হয়েছিলেন। এদিকে সারাজীবন বাম রাজনীতি করেও জাতীয় পার্টিতে যোগ দেয়ার নজির আছে। ক্যাপ্টেন (অব:) আব্দুল হালিম সারাজীবন বাম রাজনীতি করেছেন। ন্যাপ, ইউনাইটেড পিপলস পার্টি হয়ে জিয়াউর রহমান ও আবদুস সাত্তারের মন্ত্রী হয়েছেন। এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর তার মন্ত্রিসভাও অলঙ্কৃত করেছেন।
 
আওয়ামী লীগের অন্যতম নিষ্ঠাবান নেতা ছিলেন এম কোরবান আলী। অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনিও এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন।
 
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সমন্বয়ক ও স্বাধীনতার ইশতেহারে স্বাক্ষরদাতা প্রফেসর ইউসুফ আলী। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী হয়েছেন। বিশ্বস্ত এ আওয়ামী লীগারও কিন্তু পরে খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রী হতে ছাড়েননি। এমনকি, বিভক্ত আওয়ামী লীগের একাংশের (মীজান চৌধুরী) সাধারণ সম্পাদকও হয়েছিলেন। এরপর জিয়াউর রহমান,আবদুস সাত্তার এবং সবশেষে এরশাদের মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।  
 
এভাবে বিভিন্ন দল-মত থেকে সুবিধাবাদীরা ডিগবাজি দিয়ে এরশাদের হাতকে শক্তিশালী করেছেন। ফলে সব ক্ষমতাশীলের মতো এরশাদও ভেবেছিলেন জাতীয় পার্টি ছাড়া দেশে আর কোনো দল থাকবে না।  
 
সম্প্রতি দলবদলের যে কথা শোনা যায় তা ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতিরই ধারাবাহিকতা। তবে, বর্তমানে কেন্দ্রে যতোটা না, তৃণমূলে এর প্রকোপ অনেক বেশি। আবার মাঠ পর্যায়ে সবাই-ই যে ক্ষমতার জন্যই দলবদল করছে তা নয়। এর সঙ্গে তৃণমূল নেতাদের এলাকায় টিকে থাকা ও রুটি-রুজির প্রশ্ন জড়িত। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থাও তথৈবচ! তাই আজ এক জেলায় ১০ জন, কাল আরেক জেলায় ১৩ জন বিএনপি অথবা জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীর আওয়ামী লীগে যোগ দেয়ার খবর পাওয়া যায়। তার ওপর আছে সামনে নির্বাচনের হিসেব নিকেশ। তাই তৃণমূলের রাজনীতিতে এখন নানা সমীকরণ। সে সমীকরণের ফিরিস্তিও দীর্ঘ। একেক এলাকায় একেক রকম।

এদিকে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বিএনপি এখন ‘দপ্তরে রুহুল আর মাঠে ফখরুল’ সর্বস্ব দলে পরিণত হয়েছে। কিন্তু রাজনীতিতে সক্রিয় না থাকলেও বিএনপির কোনো কেন্দ্রীয় নেতার আওয়ামী লীগে যোগ দেয়ার ঘটনা এখনও ঘটেনি। এর মাধ্যমে বিএনপির শীর্ষ নেতারা এক ধরনের দলীয় ঐক্যের পরিচয় দিয়েছেন সত্য। কিন্তু ক্ষমতার খেলায় সে ঐক্য কতটুকু অটুট থাকবে সেটাই দেখার বিষয়।
 
আগেই বলেছি, ডিগবাজির এই রাজনীতিতে অতীতে জাতীয় পার্টিই বেশি লাভবান হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এক্ষেত্রে তেমন সুবিধা করতে পারেনি। তার কারণও আছে। নতুন দল হিসেবে জাতীয় পার্টিতে নাম লিখিয়ে অনেকে মন্ত্রী হয়েছেন। তখন আওয়ামী লীগ, বিএনপিতে অনেকেই আর ‘আশা’ খুঁজে পাননি। অনেকেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনাও তখন দেখতে পাননি। এমপি-মন্ত্রী হওয়া তো দূরের কথা। তাই নগদ প্রাপ্তির আশায় জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়েই মন্ত্রী, এমপি না হয় উপদেষ্টা গোছের কিছু একটা পদ বাগিয়ে নিয়েছেন।  

এদিকে জাতীয় পার্টিরও সর্বস্তরে নেতৃত্ব প্রয়োজন ছিল। তাই দলবদলের ফলে জাতীয় পার্টি ও দলছুটরা –এই দু’তরফেরই লাভ হয়েছে। আর ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়েছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও বাম দলগুলোর। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের রাজনীতি। যারা একবার দলবদলের ডিগবাজি শিখে গেছেন তাদের পক্ষে সহজপথে হাঁটা যে কঠিন! রাজনীতিতে এই প্রবণতা আজও বহাল আছে।
 
দলবদল আসলে ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সম্পর্কিত। হাওয়ার অনুকূলে বৈঠা ঘোরালেই নৌকা গন্তব্যে যাবে- একথা নৌকার মাঝি যেমন জানেন, জানেন যাত্রীরাও। অজানা নেই তা সাধারণ পথচারীদেরও। তাই অনেক পথচারীই ধানের শীষ বা কাঁচি-কোদাল ফেলে নৌকায় বাকি পথটা পাড়ি দিয়ে সহি-সালামতে তীরে পৌঁছাতে চান।  
 
বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য মওদুদ আহমদ জিয়াউর রহমানের উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং পরে এরশাদের উপ-রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। এরপর আবার বিএনপিতে যোগ দিয়ে আইনমন্ত্রীও হয়েছেন। এখনও তিনি বিএনপিতে আছেন।  

এদিকে কাজী জাফর আহমেদ বাম রাজনীতি করে পরে জিয়াউর রহমানের শিক্ষামন্ত্রী হয়েছিলেন। এরশাদের পতনের আগ পর্যন্ত বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। ২০১৪ সালে এরশাদ নির্বাচনে অংশ নিলে সেই কাজী জাফরই এরশাদকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলেন! এরপর এরশাদ ও কাজী জাফর দু’জনই দু’জনকে জাতীয় পার্টি থেকে বহিষ্কার করেন। প্রশ্ন হলো, বিশ্বাসঘাতক কি এরশাদ একাই? 
 
যিনি ছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের রাষ্ট্রপতি, সেই  মোহাম্মদউল্লাহও একসময় বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন। জাস্টিস সাত্তারের ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়ে পরে ১৯৯৬ সালে আবার আওয়ামী লীগে ফেরার সুযোগ পেয়েছেন।
 
আসলে রাজনীতিতে যেমন ‘শেষ’ বলতে কিছু নেই, রাজনীতিকদেরও ‘শেষ ঠিকানা’ বলতে যেন কিছু নেই। এদেশে অনেক বড়-বড় রাজনীতিকের দলবদল দেখেছি। রাজনীতির চড়াই-উৎরাইয়ের পথে চলতে গিয়ে অনেকেই হোঁচট খেয়েছেন। অনেকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। অনেকে চিরদিনের জন্য বসেও গেছেন। দু:সময়ে বদলদল সহজ তরিকা বটে। তবে তাতে আখেরে লাভবান হওয়ার নজির খুব বেশি নেই। দু’একজন বাদে সবাইকেই যোগ-দেয়া দলের আশপাশে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায় বড়জোড়। এতো এতো নেতার ভিড়ে ‘আসন’ পাওয়াই যে কঠিন।
 
মওদুদ আহমদ বঙ্গবন্ধু, জিয়া, খালেদা জিয়ার স্নেহধন্য হয়েছেন। কোরবান আলী ঘরে ফেরার সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু ঘরে ফেরার সুযোগ সবাই নাও পেতে পারেন। ফলে, সুবিধাবাদীরা হয়তো একদিন নিজেরাই নিজেদেরকে রাজনীতি থেকে বহিষ্কার করতে বাধ্য হবেন। আগে যারা ডিগবাজি দিয়েছেন, তাদের উত্তরসূরীরাও তাদের পদাঙ্ক অনুসরণের চেষ্টা করছেন। শুনেছি, কোকিল কখনো বাসা বাঁধে না, কাকের বাসায় লুকিয়ে ডিম পাড়ে, বাচ্চা পয়দা করে আর কাক না বুঝে কোকিলের সে বাচ্চাকে বড় করে।  

তবে ক্ষমতায় যারা থাকেন তারা কাক ও কোকিলের ভেদ ঠিকই চিনতে পারেন।

বাংলাদেশ সময়: ০৫১৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩০, ২০১৮
জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।