এমনকি লাশ বহনেও যে অ্যাম্বুলেন্স নেওয়া হয় সেখানেও রয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। দালালদের কথা তো অহরহ শুনেছি।
এটা অবশ্য সরকারি হাসপাতালের ঘটনা। সেই অভিজ্ঞতার কথা আবারও মনে পড়লো। কারণ গতবছর এই ১২ আগস্ট আমার শ্বশুর সড়ক দুর্ঘটনায় চিরবিদায় নেন। ওই এক রাতের তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাকে আজও পীড়া দেয়। মনে হয় নিজের হাতে শ্বশুরকে আমি মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছি।
সেই দালাল, চিকিৎসকের আচরণ, লাশ পরিবহনের অ্যাম্বুলেন্সওয়ালার আচরণ, পুলিশের ডায়েরি লেখা সব মনে পড়ছে। এই প্রত্যেকটি ঘটনাই আমাকে মর্মাহত করে। নিজেকে অপরাধী করে তোলে। মন থেকে মুছে ফেলতে পারি না।
১১ আগস্ট বিকেলে খবর পাই শ্বশুর গ্রামের বাড়িতে ট্রাক চাপায় মারাত্মক আহত হন। ঘটনার পরপরই তাকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেয় স্বজনরা। জ্যাম ঠেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসতে রাত সাড়ে ১২টা হয়ে যায়। এর মধ্যে রক্তক্ষরণে শ্বশুরের অবস্থা খুবই খারাপের দিকে যায়।
তাকে নিয়ে আত্মীয়রা হাসপাতালে পৌঁছানোর পরপরই গল্পের শুরু। আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি শ্বশুরকে যারা তাড়াহুড়ো করে জরুরি বিভাগে নিয়ে গেল তারা হাসপাতালের কেউ নয়। যারা রক্ত বন্ধের জন্য ব্যান্ডেজ করছে তারা হাসপাতালের কেউ নয়।
ঘটনাটা আমাকে-আমাদের এতটাই বিহ্বল করে দিয়েছিল যে কেউই কিছু বুঝতে পারিনি। হাসপাতালে এমন কাউকে নিয়ে আসার অভিজ্ঞতা আমাদের তেমন কারোরই ছিলো না।
ওই লোকগুলো রাত দুটো পর্যন্ত এ ফ্লোর ও ফ্লোর করলো। মৃত্যু পথযাত্রী শ্বশুরকে সিটি স্ক্যান করানোর কক্ষে নিয়ে গেলো। প্রতি ব্যাগ রক্ত ৪ হাজার ২০০ টাকায় কিনতে বাধ্য করালো। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না। শ্বশুরকে যে ডিউটি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় তিনিই ফিরিয়ে দেন। একজন বলেন- অর্থপেডিকের বিষয়।
অর্থপেডিকের ডাক্তার বলেন, কানে আঘাত এটা নাক-কান গলার বিষয়। নাক-কান গলার ডাক্তার বলেন, মাথায় ইনজুরি নিউরোলজির বিষয়।
এভাবে এর বিষয়, ওর বিষয় করতে করতে রাত তখন দুটো। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। আমার স্ত্রী শ্বশুরের সব চেয়ে ছোট মেয়ে। তার চোখেও তখন বর্ষার ধারা। বারবার জিজ্ঞেস করছে, ‘আব্বা কি আছে এখনো। ’ কি করছো তোমরা? ডাক্তার দেখছে না কেন? ভর্তি করছে না কেন? কিসের সাংবাদিক হয়েছো?
বউয়ের এত সব প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারছি না। উত্তর জানা নেই। আমি শুধু শ্বশুরের স্টেচার ধরে এ ফ্লোর, ও ফ্লোর করছি। ওরা একটু পরপর বলছে রক্ত লাগবে, জোগাড় রাখেন। আমাদের লোক দিচ্ছি। রক্ত পাওয়া যায় না। আমাদের কাছে আছে। ৫ হাজার টাকা ব্যাগ। তাদের কথা মতো আমি টাকা জোগার করকে চাঁনখার পুলের পাশে একটা ব্লাড ব্যাংকে যাই। রক্ত আনি।
তখন রাত তিনটার কাছাকাছি। ওরা আমার শ্বশুরকে হাসপাতালের নিচে বারান্দায় নামিয়ে এনে বললো, ‘ভাই রোগীরে পঙ্গুতে লইয়া যান। এখানে নিবো না। আমাগো টেকা দেন তিন হাজার। সারা রাইত খাটলাম। ’
জিজ্ঞেস করিনি, ‘কেন নেবে না। তোমাদের কিসের টাকা। মুখ বুজে টাকা দিলাম তিন হাজার। পাঠালাম পঙ্গুতে। ’ সেখানে রোগী নামানোর আগেই এক দালাল এসে বলে, ‘এখানে তো সিরিয়াল দিতে হবে। আমার সাথে আসেন ভালো জায়গায় নিয়ে যাই। সেখানো কোনো সিরিয়াল লাগবে না। ’
সে একটি বেসরকারি হাসপাতাল (ক্লিনিক টাইপের) নিয়ে যায়। গিয়ে দেখি ওরা কারো সঙ্গে কথা না বলে আমার শ্বশুরকে আইসিইউতে ঢুকিয়ে দিয়েছে। আর জানিয়েছে প্রতিদিন ৫০ হাজার করে টাকা লাগবে। রোগীর অপারেশন লাগবে মাথার। এবার আমি বুঝতে পারি কিছুটা। ওদের সাথে কথা কাটাকাটি করে পঙ্গু হাসপাতালে আবার নিয়ে আসি।
সেখানকার ডাক্তার বললেন, ‘ঢাকা মেডিকেল থেকে এখানে পাঠিয়েছে তার কাগজপত্র কই? ওনার চিকিৎসা তো ঢাকা মেডিকেলেই সম্ভব। তবে আমি একটা সাজেশন দেই ওনার যে আঘাত হাত পায়ে সেটা বিষয় না। মাথার আঘাতের কারণে উনি নাও ফিরতে পারেন। সেটার চিকিৎসা আগে দরকার। আপনারা নিউরো সায়েন্সে নিয়ে যান। ’
গেলাম নিউরো সায়েন্সে। ঘুমক্লান্ত ডাক্তার উঠে এলেন পাশের রুম থেকে। বললেন, এটা ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের কেস। ওনারা এখানে পাঠালো কেন? কাগজপত্র নেই কেন? আমি ঘটনার বিহ্বলতায় ততক্ষণে মুর্খে পরিণত হয়েছি। বললাম, ডাক্তার সাহেব আমরা তো কিছু বুঝে উঠতে পারিনি একটু পরামর্শ দেন কি করতে পারি?
তিনি বলেন, আমি উনার কন্ডিশন বর্ণনা করে তাকে আবার ঢাকা মেডিকেলে পাঠাচ্ছি। ওনার চিকিৎসা ওখানেই হবে।
আবার ঢাকা মেডিকেলে এলাম। আরেক গ্রুপ এলো। সেই একই কায়দায়। এবার অবশ্য ভর্তিটা করালো। কাগজপত্র দিল। আমরা কার পাল্লায় পড়ে দৌড়াদৌড়ি করেছি তার জন্য আমাদের বোকা আখ্যা দিল। রোগীকে ফেলে রাখা হলো জরুরি বিভাগে। একজন ইন্টার্ন ডাক্তার এসে বললেন, ওনার রক্ত বন্ধ করেন। তখন রাত ভোর হয়ে গেছে। আবার নতুন করে ব্যান্ডেজ। বিভিন্ন বিভাগে দেখানো। অবশেষে সিদ্ধান্ত অপারেশনের।
শুরু হলো আরেক গল্প। সকাল ১১টায় অপারেশন। ডাক্তার নেই। যাকে জিজ্ঞেস করি বলে ডাক্তাররা ব্যস্ত। আসতে সময় লাগবে। হয়ে গেল দুপুর ১২টা। সবুজ অ্যাপ্রোন পড়া দুজন ডাক্তার এলেন। অপারেশন থিয়েটারে ঢুকলেন। আবার বেরিয়ে এলেন। শ্বশুরকে নেওয়া হয়েছে অপারেশন থিয়েটারে।
আত্মীয়-স্বজনদের খুঁজলেন, বললেন, রক্ত লাগবে। দ্রুত আনান। কাগজে একটা ওষুধ লিখে দিয়ে বললেন, আনান। তাদের মুখ কঠিন।
কিছুক্ষণ পর একজন এসে বললেন, শোনেন উনি ফিরতেও পারেন নাও ফিরতে পারেন। পালস পাওয়া যাচ্ছে না। প্রেসার মাপার জায়গা নেই। পায়ে একটু পালস আছে। আপনারা চাইলে অপারেশন করাতে পারেন। আবার নিয়েও যেতে পারেন। আমরা বললাম, বাঁচা মরা আল্লাহর হাতে। শেষ চেষ্টা করেন।
রক্ত আনা হলো ৪ হাজার ২০০ টাকায়। ওষুধ আসলো ৫ হাজার টাকার। এক ঘণ্টা ডাক্তারা কি যেন করলেন ভেতরে। দুপুর একটায় এসে জানালেন, কিছু করার নেই। উনি আর ফেরেননি।
লক্ষ্য করলাম, সদ্য কেনা ওষুদের প্যাকেট নিয়ে ডাক্তার বেরিয়ে যাচ্ছেন। তার মুখে মৃত্যু শোকের কোনো ছায়া নেই। কঠিন মুখ। যেন পশু জবাই করে ফিরছেন তিনি। আমার আত্মীয়দের কান্নার রোলে আকাশ তখন ভারী হতে শুরু করেছে।
তারপরের ঘটনা আরো মারাত্বক। লাশ গেলো মর্গে। ময়নাতদন্ত হলো। পুলিশকে জানাতে বলা হলো। পুলিশের হাজারটা প্রশ্ন, কেন কিভাবে হলো। পুলিশ বললো আপনারা এলাকায় নিয়ে তো ট্রাকের মালিকের কাছ থেকে থেকে অনেক টাকা আদায় করবেন। আমাদেরটা দিয়ে যান। মামলা করতে হবে। তারপর লাশ পাবেন।
এমন হাজারটা নির্লজ্জ প্রশ্ন। ততক্ষণে লাশ পরিবহনের জন্য অ্যাম্বুলেসের লোক এসে গেলে। জোর জবরদস্তি শুরু করেছে।
আমার গাড়িতে নিতে হবে। সেদিনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি থেকে আমাদের রক্ষা করেছিল পুলিশই। ভাগ্যক্রমে শাহবাগ থানার ওসি ছিল শ্বশুরের গ্রামের। আমার শ্বশুরের লোকজন থানায় গিয়ে তাকে সব জানায়।
তিনি সব আইনি প্রক্রিয়া শেষ করে লাশ অ্যাম্বুলেসে তুলে দেয়। পুলিশ কনস্টেবল, জোর জবরদস্তি করা অ্যাম্বুলেসের মালিক আমাদের সঙ্গে গজগজ করতে থাকে। আপনারা কাজটা ঠিক করলেন না। আমাদের হক মারলেন। হায়রে...। লাশ থেকে আয়ের আবার হক?
আজ একবছর পর এসে ভাবি যদি রাতে দালালের খপ্পরে না পড়তাম, যদি কেউ সঠিক জায়গায় নিয়ে যেতে পারতো তাহলে হয় তো আমার শ্বশুরকে বাঁচানো সম্ভব ছিল। আবার শ্বশুরের পালস নেই, প্রেসার পাওয়া যাচ্ছে না তার মানে সে মৃত।
তবুও রক্ত আনানো হলো। ৫ হাজার টাকার ওষুধ কেনানো হলো। ডাক্তার এক ঘণ্টা দেরি করে এলেন। অপারেশন থিয়েটারের নাটক করে ওষুধ নিয়ে চলে গেলেন। অ্যাম্বুলেসের সিন্ডিকেট আর পুলিশের কারণে দুপুরে পরপারে চলে যাওয়া একটা মানুষের লাশ নিতে সময় লেগেছিল সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত।
রাতে যেসব ইন্টার্ন ডাক্তার দায়িত্বে ছিলেন তারা কেউই ভালোভাবে আমার শ্বশুরকে দেখলেন না। ব্যবস্থা নিলেন না। এমন সিরিয়াস আঘাত পাওয়া মানুষকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত অপারেশনের জন্য ফেলে রাখলেন। হাসপাতালের এই পরিবেশ, দালাল, ডাক্তারদের অবহেলা কোনো কিছুই মন থেকে মুছতে পারি না।
স্ত্রী প্রায়ই অভিযোগ করে বলেন, আমাদের টাকা থাকলে আর বুদ্ধি দেওয়ার কোনো মানুষ থাকলে ‘আব্বাকে হয় তো হারাতে হতো না। ’ তার চোখের পানি মুছিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনো সান্ত্বনা দিতে পারি না। আর ভাবি আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা কোন পথে। হায়রে হাসপাতাল!
লেখক: সাংবাদিক।
বাংলাদেশ সময়: ০০৩৯ ঘণ্টা, আগস্ট ১২, ২০১৮
এমএ/