স্টেরয়েড হিসেবে যা’ গরুকে খাওয়ানো হয়, তা’ ‘হিউম্যান ড্রাগ’(Human Drug), যেটি ডেক্সামিথাসন গ্রুপের। অথচ এটি জীবন্মৃত মানুষকে সচল করতে খাওয়ানো হয়।
স্টেরয়েডের সরাসরি প্রভাবে গরুর পরিপাকতন্ত্রে সৃষ্ট ‘হাইপার অ্যাক্টিভিটি’র ফলে তীব্র ক্ষুধা ও পিপাসা অনুভূত হয়; একারণে গরুর খাবারের চাহিদাও বেড়ে যায়। ফলে পরিপাকতন্ত্র অসহনীয় চাপে পড়ে অতিরিক্ত সঞ্চিত খাবার হজম না হয়ে গরুর কিডনিতে প্রভাব ফেলে। অতিরিক্ত পানি ও মূত্র অনিষ্কাশিত অবস্থায় শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। এতে শরীর ফুলে যায়।
বিশেষজ্ঞ-গবেষণায় দেখা গেছে, অতিমাত্রায় স্টেরয়েডযুক্ত গরু নিরাময়অযোগ্য। স্টেরয়েড ব্যবহারে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের বৈজ্ঞানিক ফর্মূলা ও নির্দেশনা প্রতিপালিত না হওয়ায় ডেইরি সেক্টর ঝুঁকির সম্মুখীন। এ সেক্টরে সুশাসনের শর্ত গবাদিপশুর প্রতিষেধক মেয়াদোত্তীর্ণ কিনা, যথাযথভাবে সংরক্ষিত কিনা, গোখাদ্য সঠিক মানের কিনা, তা’ নিশ্চিত করা। কোনটি অপরাধ, কোনটি অপরাধ নয়, তার উপলব্ধির জন্য ৩ টি বিষয় অপরিহার্য; যেমন পর্যাপ্ত জ্ঞান, প্রশিক্ষণ এবং আইনের অনুশাসন । বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যত উন্নতি হচ্ছে, মানুষের তত নৈতিক অধঃপতন ঘটছে। এর প্রমাণ অতিমুনাফার লোভে স্টেরয়েডের বেপরোয়া ব্যবহার। ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকা ভাষাহীন, প্রতিবাদহীন অবুঝ পশুগুলো এভাবেই বিবেকহীন মানুষের কাছে অসহায়।
কৃত্রিমভাবে মোটাতাজা করা গরুর মাংস অবশ্যই দূষিত, যা’ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণেও হালাল নয়। কারণ কুরবানীর মূল শর্ত, সুস্থ ও সবল গরু। ফুড চেইনের অনিবার্য প্রতিক্রিয়ায় বিষযুক্ত মাংসের প্রভাব পড়ে মানুষের কিডনি, লিভার ও হার্টসহ বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গে। গর্ভবতী মহিলার হরমোন ভারসাম্যও নষ্ট হয়। মানুষের শরীরের প্রাকৃতিক Immune Mechanism দূষিত খাদ্যে ধ্বংস হয়ে যায়। দীর্ঘ সময় ধরে রান্না করলেও এর বিষমাত্রা ধ্বংস হয় না। পুষ্টিগুণ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এ মাংস ফ্রিজে দীর্ঘদিন সঞ্চিত রেখে খাওয়া আত্মঘাতী বটে। কিন্তু জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণ করার মানসিক শক্তি আমরা হারিয়েছি। একদিকে বিষাক্ত মাংসে শরীর রোগাক্রান্ত হচ্ছে, অন্যদিকে চিকিৎসাব্যয় আর্থিক ক্ষত বাড়াচ্ছে। আইনের অনুশাসন এবং সামাজিক সচেতনতাকে বক্তৃতায় সীমিত না রেখে এর বাস্তব প্রয়োগ ও অনুশীলন প্রয়োজন।
কুরবানির আগে মোবাইল কোর্ট, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, সিটি কর্পোরেশন ও পৌর কর্তৃপক্ষগুলোকে এখনই মিশন নিয়ে মাঠে নামতে হবে। মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯ এর ১০২ নং তফশিলে “মৎস্য খাদ্য ও পশু খাদ্য আইন-২০১০” এ এটি অন্তর্ভুক্ত। এ আইনের ১২(১)(ক) ধারামতে মৎস্য বা পশুখাদ্যে মানুষ, পশু, মৎস্য বা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পদার্থ থাকলে এবং একই আইনের ১২(১)(খ) ধারা অনুযায়ী ঐ খাদ্যমান আদর্শ মানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে, তা’ অপরাধ।
একই আইনের ১৪(১) ধারার মৎস্য ও পশুখাদ্য হিসেবে অ্যান্টিবায়োটিক, গ্রোথ হরমোন, স্টেরয়েড ও কীটনাশকসহ অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার নিষিদ্ধ। এছাড়া জীবজন্তুর প্রতি নিষ্ঠুরতা আইন, ১৯২০ অনুযায়ী নিরাময়অযোগ্য রোগাক্রান্ত পশু ধ্বংসে ম্যাজিস্ট্রেট ক্ষমতাপ্রাপ্ত। ২০০৯ সালে বাংলাদেশে জনস্বার্থে বার্ড ফ্লু সংক্রমিত লক্ষ লক্ষ মুরগী ধ্বংস (culling) করা হয়েছিল। যুক্তরাজ্যে ১৯৮৮ সালে ‘ম্যাডকউ’ ডিজিজ উদঘাটিত হলে বিপুল সংখ্যক গরু মেরে ফেলা হয়।
অননুমোদিত স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধের বিক্রি বন্ধে প্রতিটি জেলায় মোবাইল কোর্টকে মাঠে নামানোর জন্য সব জেলা প্রশাসকের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। স্টেরয়েডের অভিশাপ থেকে কুরবানির গরুকে/পশুকে মুক্ত করা প্রশাসনের আইনি এবং নৈতিক দায়িত্ব। পাশাপাশি গরুসহ কুরবানির পশুর জেনেটিক মান উন্নত করতে হবে। বিদেশ থেকে উৎকৃষ্ট মানের সীমেন (শুক্রাণু) আমদানি নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া সীমান্তপথে বৈধ পশু আমদানিকালে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, বিজিবি ও মোবাইল কোর্টের সাহায্যে কিট ব্যবহার করে রক্ত ও হরমোন পরীক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
রাসায়নিক পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়া অভিযান চালানো অর্থহীন। স্যাটেলাইটে তোলা ছবি এখন ২০ মিনিটেই পাচ্ছে পৃথিবী। প্রযুক্তির পর্যবেক্ষণে যেকোন বিষয়ে তথ্য উপাত্ত পাওয়া অত্যন্ত সহজ। সুতরাং প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরকে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। গরুতে স্টেরয়েড বা ক্ষতিকর ঔষধের উপস্থিতি প্রমাণের জন্য প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার, কিট ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। অপরাধ প্রমাণিত হলে শুধু জেল-জরিমানা নয়, ফৌজদারী কার্যবিধি ১৮৯৮’র ৫১৬ থেকে ৫২৫ ধারার আলোকে বিষাক্ত গরু জব্দ করে ধর্মীয় বিধি মোতাবেক জবাই করে তা’ নিরাপদ স্থানে পুঁতে ফেলতে হবে। ভেজাল খাদ্য ধ্বংসের মত বিষাক্ত গরু ধ্বংস (কালিং) না করলে এ অপরাধ বন্ধ হবে না। কারণ জেল জরিমানার সমান্তরালে অসাধু ব্যবসা-সম্পৃক্ত পণ্য জব্দ বা ধ্বংসের আর্থিক ক্ষতি এ হীন অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধে সহায়ক।
এর পাশাপাশি দীর্ঘদিনের শ্রম, ঘাম ও অর্থে লালিত পশু বাজারজাত করার জন্য সৎ খামারিদের প্রণোদনা দিতে হবে। নির্ভেজাল পশু খাদ্য নিরাপত্তার অপরিহার্য অনুষঙ্গ। সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে এর নির্র্দেশনা আছে। তবে কুরবানিতে সুস্থ, সবল গরু নিশ্চিত করা সরকারের একার কর্তব্য নয়। একশ্রেণির উচ্চাভিলাষী কুরবানিদাতা বিশাল আকৃতির মোটাতাজা গরু কিনে কুরবানিকে ভোগের উৎসব এবং প্রদর্শনের প্রতিযোগিতায় পরিণত করেছেন। ভোক্তারা সৎ ও সচেতন না হলে ঘরে ঘরে গিয়ে আইন প্রয়োগ করা সম্ভব নয়।
হৃষ্টপুষ্ট গরুতে কুরবানির সার্থকতা নয়, অসৎ উপার্জনের অর্থে কুরবানির শুদ্ধতা নয়। ক্রয়-বিক্রয়ে সততা, লেনদেনে শুদ্ধতা এবং জীবনাচরণে নৈতিকতা ছাড়া সব আয়োজনই বৃথা। অহংকার, অনাচার ও আত্মম্ভরিতা বর্জনই মহান স্রষ্টার নির্দেশিত কুরবানির শিক্ষা।
লেখক: মহাপরিচালক,দুর্নীতি দমন কমিশন।
বাংলাদেশ সময়: ১২৪৭ ঘণ্টা, আগস্ট ১৫, ২০১৮
জেএম/