বিচারপতি সিনহা তাঁর লেখা “আ ব্রোকেন ড্রিম” বইটিতে দাবি করেছেন, তিনি কোনো রকম দুর্নীতির সাথে কখনও জড়িত ছিলেন না। ২০১৭ সালের ১ অক্টোবর তারিখে বিচারপতি আব্দুল ওহাব মিয়া মৌখিকভাবে তাঁকে কিছু দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগের কথা জানান বটে।
“… these allegations came only after the pronouncement of the Sixteenth Amendment judgment. Following that verdict, the government desperately tried to assassinate my character only to justify their unjustified and unusual actions against me.”
অর্থাৎ বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতির অভিযোগের ব্যাপারটি শুধু ষোড়শ সংশোধনী বাতিল মামলার রায়ের পরই ওঠানো হয়েছে। এটা বিচারপতি সিনহার মতে তাঁর বিরুদ্ধে সরকারের আক্রোশেরই বহির্প্রকাশ। সরকার আসলে এভাবে বিচারপতি সিনহার চরিত্র হননের মাধ্যমে অন্যায় এবং অপ্রত্যাশিত কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দিতে চেয়েছে।
একই সাথে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েব সাইটে বিচারপতি সিনহার দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়টি প্রকাশ করার পিছনে বিচারপতি সিনহা বিচারপতি আব্দুল ওহাব মিয়াকে দায়ী করেছেন। বিচারপতি সিনহার মতে, বিচারপতি আব্দুল ওহাব মিয়া একজন বিশ্বাসঘাতক। বিচারপতি সিনহা তাঁকে তুলনা করেছেন বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাক আহমেদের সাথে। এই কারণে বিচারপতি সিনহা তাঁর “আ ব্রোকেন ড্রিম” বইটির অধ্যায় ২৯-এ লিখেছেন:
“Justice Md. Abdul Wahab Miah was a carbon copy of Khandker Mushtaque Ahmed.”
শুধু তা-ই নয়, সকল চক্রান্তের পিছনে মূল্ চক্রান্তকারী হিসেবে বিচারপতি সিনহা চিহ্নিত করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে। বিচারপতি সিনহা মনে করেন, তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েব সাইটে প্রকাশ করার পিছনে মাস্টার মাইন্ড ছিলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। বিচারপতি আব্দুল ওহাব মিয়া আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের হাতে শুধু একজন আজ্ঞাবহ ক্রীড়নকের ভূমিকা পালন করেছেন। এই কারণে বিচারপতি সিনহা তাঁর “আ ব্রোকেন ড্রিম” বইটির অধ্যায় ২৯-এ লিখেছেন:
“Justice Abdul Wahab Miah turned into an obliging puppet in the hands of the Law Minister … .”
কিন্তু মজার ব্যাপার হল বিচারপতি সিনহার লেখা “আ ব্রোকেন ড্রিম” বইটি পড়লেই আমরা জানতে পারব যে বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়টি শুধু ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের মামলার রায়ের পরই উঠে আসেনি। তিনি নিজেই তাঁর বিচারপতি-জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে নানা রকম দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগের মোকাবিলা করেছেন বলে উল্লেখ করেছেন। আরও মজার ব্যাপার হলো, বিচারপতি সিনহা সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে সকল সরকারের আমলেই দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন। এই ব্যাপারটি বিস্তারিতভাবে আমরা জানতে পারি বিচারপতি সিনহার লেখা বইটির বিভিন্ন অধ্যায়ে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে বিচারপতি সিনহা তাঁর বইয়ে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল মামলার রায়ের পর যে দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগের কথা উল্লেখ করেছেন, তা এর আগেও উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে। তিনি তাঁর অন্য দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগগুলো কোনো না কোনোভাবে ম্যানেজ করতে পারলেও তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগের পাহাড় আকাশ ছোঁয়ার পর তিনি পিছুটান দেন। আসুন বিচারপতি সিনহার নিজের ভাষ্যমতে তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগের খতিয়ান জেনে নিই।
“আ ব্রোকেন ড্রিম” বইটির অধ্যায় ৩ অনুযায়ী ১৯৯৯ সালের ২৪ অক্টোবর বিচারপতি সিনহা সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। তখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ছিল। দুই বছর পর (২০০১ সালে) বিচারপতি সিনহা যখন বিচারপতি হিসেবে কনফার্ম হন তখন নির্বাচনের ফলে বিএনপি ক্ষমতায়। দুর্নীতি দমন কমিশনে তখন চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন বিচারপতি সুলতান হোসেন খান (বর্তমানে প্রয়াত)। “আ ব্রোকেন ড্রিম” বইটির অধ্যায় ৪ অনুযায়ী বিচারপতি সুলতান হোসেন খান বিচারপতি সিনহাকে অবহিত করেন যে, গোয়েন্দা বিভাগ বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগের রিপোর্ট দাখিল করেছেন। বিচারপতি সিনহা লিখেছেন -
“… the special intelligence department submitted reports against me with wild allegations of corruption which I came to know from late justice Sultan Hussain Khan, then Chairman of the Durnity Daman (Anti-Corruption) Commission.”
কিন্তু বিচারপতি সিনহার মতে, দুর্নীতি দমন কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান বিচারপতি সুলতান হোসেন খান বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগের কোনো তদন্ত করতে চাননি। যেহেতু দুর্নীতি দমন কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান বিচারপতি সুলতান হোসেন খান বর্তমানে মৃত, তাই আমাদের পক্ষে এর প্রকৃত কারণ জানা সম্ভব নয়। তবে বিচারপতি সিনহা তাঁর “আ ব্রোকেন ড্রিম” বইটির অধ্যায় ৪-এ লিখেছেন:
“He said, it would create a very bad precedence and that the Constitution also does not permit such a procedure.”
অর্থাৎ বিচারপতি সিনহার তথ্য অনুযায়ী, দুর্নীতি দমন কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান বিচারপতি সুলতান হোসেন খান বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে উত্থাপিত দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগের কোনো তদন্ত করতে চাননি কারণ সেটা একটা খুব বাজে দৃষ্টান্ত হতো এবং বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সেটি নাকি সম্ভবও নয়।
এখন কথা হলো, একজন বিচারপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত নিঃসন্দেহে একটা বাজে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতো। এখনও করবে। কিন্তু আমাদের সংবিধান তো বিচারপতিদের আইনের ঊর্ধ্বে অবস্থান দেয়নি। তাঁরা যা ইচ্ছা তা-ই করবেন, আর সংবিধান তাঁদেরকে রক্ষা করে যাবে, এই কথাটি বাংলাদেশের সংবিধানের ঠিক কোথায় লেখা আছে? তবে এটা খুবই একটি দুঃখজনক ব্যাপার যে, বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে তাঁর বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হওয়ার পর থেকেই যে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল, তা তৎকালীন বিএনপি সরকার আমলে ধামাচাপা দেয়া হল। কিসের বিনিময়ে? কি কারণে? আমরা জানতে পারলাম না। জানলাম, এতো বছর পর বিচারপতি সিনহার নিজের লেখা “আ ব্রোকেন ড্রিম” বইটির মাধ্যমে।
বিচারপতি সিনহা কি আমাদের এই দর্শনই শেখালেন যে বিচারপতিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করতে নেই। তাহলে সংবিধান লঙ্ঘন হবে। বিচারপতি সিনহা তাঁর এই অযৌক্তিক দর্শন নিজে যখন প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তখনও প্রয়োগ করেছেন ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তার সাথে। ব্যাপারটি অত্যন্ত দুঃখজনক!
ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ে বিচারপতি সিনহা বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থার ইতিহাস ও বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে এক বিশাল পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। রায়ের ২২৬ থেকে ২২৯ পৃষ্ঠায় তাঁর এই পর্যবেক্ষণ বিধৃত হয়েছে। তিনি তার পর্যবেক্ষণে বেশ কয়েকটি বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। যেমন, দেশের বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতি, রাজনীতির বাণিজ্যিকীকরণ, দুর্নীতি-পরিস্থিতি, অকার্যকর সংসদ, স্বাস্থ্যখাতের অবনতি, জনপ্রতিষ্ঠান সমূহকে মেধাশূন্য করা, প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা, অপরাধের পরিবর্তিত ধরন, নাগরিকদের নিরাপত্তাহীনতা, আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর ব্যর্থতা, নিয়ন্ত্রণবিহীন আমলাতন্ত্র, নির্বাহী বিভাগের ঔদ্ধত্য ও অদক্ষতা ইত্যাদি।
তাহলে বিচারপতি সিনহার পর্যবেক্ষণ থেকে এটা স্পষ্ট যে, তাঁর মতে প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের কোনো কিছুই আশাব্যঞ্জক নয়। তবে হ্যাঁ, ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ে ২২৯ পৃষ্ঠায় বিচারপতি সিনহা লিখেছেন:
“Even in this endless challenge, the judiciary is the only relatively independent organ of the State which is striving to keep its nose above the water through sinking.”
অর্থাৎ তিনি লিখেছেন: “সীমাহীন প্রতিকূলতার মধ্যেও রাষ্ট্রের একমাত্র অপেক্ষাকৃত স্বাধীন অঙ্গ বিচার বিভাগ ডুবন্ত অবস্থায়ও নিজের নাক পানির ওপর ভাসিয়ে রাখার মরিয়া চেষ্টা করে যাচ্ছে। ”
এই যে পানির ওপর নাক ভাসিয়ে আমাদের বিচার বিভাগ নিরন্তর লড়াই করে নিজেদের প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থান সবার ওপরে রাখছেন, দুর্নীতি নিয়ে তার একটা সাম্প্রতিক প্রতিচ্ছবি দেখে আসা যাক। একই সাথে এটাও দেখা যাক বিচারপতি সিনহা একান্তই তাঁর নিজের দুর্নীতি-দর্শন কিভাবে কার্যকর করেছেন যখন তিনি নিজে প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।
মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি। ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় তিনি হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। পরে, ২০০৯ সালে আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে তিনি অবসরে যান। আলোচিত এই বিচারপতি ২০০৪ সালের একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় ‘বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত’ বলে তদন্তকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছিলেন বলে জানা গেছে। আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০১০ সালের ১৮ জুলাই সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিস দেয় দুর্নীতি দমন কমিশন। জানা গেছে, তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে অর্থ পাচারেরও অভিযোগ রয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। যে কারো দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত করার এখতিয়ার তাদের রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে কোনো অভিযোগ এলে প্রথমে অভিযোগের সত্যতার অনুসন্ধান করা হয়। বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিষয়ে অনুসন্ধানের স্বার্থে ২০১৭ সালের ২ মার্চ সুপ্রিম কোর্টের কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চেয়ে চিঠি দেয় দুর্নীতি দমন কমিশন। এর জবাবে ২০১৭ সালের ২৮ এপ্রিল আপিল বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার অরুণাভ চক্রবর্তীর স্বাক্ষর করা একটি চিঠি দুর্নীতি দমন কমিশনে পাঠায় সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।
এই চিঠিতে বলা হয়, বিচারপতি জয়নুল আবেদীন দীর্ঘকাল বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ এবং আপিল বিভাগের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। দায়িত্ব পালনকালে তিনি অনেক মামলার রায় প্রদান করেছেন। অনেক
ফৌজদারি মামলায় তার প্রদত্ত রায়ে অনেক আসামির ফাঁসিও কার্যকর করা হয়েছে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের দেওয়া রায় সকলের উপর বাধ্যকর। এমন পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ আদালতের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করলে তাঁর দেওয়া রায়সমূহ প্রশ্নবিদ্ধ হবে এবং জনমনে বিভ্রান্তির উদ্রেক ঘটবে। সাবেক বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের কোনোরকম ব্যবস্থা গ্রহণ সমীচীন হবে না মর্মে সুপ্রিম কোর্ট মনে করে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
চিঠি পাওয়ার পর তা যাচাই-বাছাই করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। চিঠিটি কমিশনের সভায় উপস্থাপন করে আনুষ্ঠানিকভাবে এটির সঠিকতা সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চিঠির সঠিকতা যাচাই করে তা আপিল বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার অরুণাভ চক্রবর্তীরই বলে নিশ্চিত হয় দুর্নীতি দমন কমিশন। এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের একটি নথিতে বলা হয়েছে:
“পত্রটির স্বাক্ষরকারী অরুণাভ চক্রবর্তী মৌখিকভাবে জানিয়েছেন, প্রধান বিচারপতির অনুমোদন ও নির্দেশক্রমে প্রেরিত পত্রটিতে তার স্বাক্ষর সঠিক। ”
ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ের ২২৮ পৃষ্ঠায় বিচারপতি সিনহা তাঁর পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেছেন যে, বাংলাদেশে বর্তমানে ‘অবাধ দুর্নীতি’ চলছে। তাঁর এই দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানকে আমরা অবশ্যই সাধুবাদ জানাই। কিন্তু এই বিচারপতি সিনহা যখন বিচার বিভাগের দুর্নীতির তদন্ত বন্ধের বিষয়ে চিঠি দিয়ে দ্বৈত অবস্থান গ্রহণ করেন তখন আমরা শঙ্কিত না হয়ে পারি না। বিচারপতি সিনহার এহেন দুর্নীতি-দর্শন প্রকটভাবে আমাদের বিবেককে নাড়া দিয়ে যায়। বিচার বিভাগের দুর্নীতি কি তাহলে দুর্নীতি নয়? বিচারকগণ কি তাহলে আইনের ঊর্ধ্বে? আমাদের সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা আছে: ‘‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের আশ্রয় লাভের সমান অধিকারী। ’’ তাহলে আমার প্রশ্ন, আমার দেশের বিচারপতিগণ কি ভিনগ্রহ থেকে আসা কোনো মহামানব যে, আমাদের জনগণ তাদেরকে দুর্নীতি করার অবাধ ছাড়পত্র দিয়ে রেখেছে? কী বলবেন বিচারপতি সিনহা?
বিচারপতি সিনহা তাঁর দুর্নীতি-দর্শন নিয়ে ভালমতোই পার করলেন ২০০১-এর বিএনপি সরকারের আমল। তাঁর বিরুদ্ধে তখনকার দুর্নীতির অভিযোগ তিনি খুব ভালো মতোই সামাল দিতে পেরেছেন। এরপর এলো প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দীন আহমদের আমল। প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দীন আহমদ ক্ষমতা গ্রহণের ছয় মাসের মধ্যেই আবার বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠল। বিচারপতি সিনহা তাঁর লেখা “আ ব্রোকেন ড্রিম” বইটির অধ্যায় ৪-এ লিখেছেন:
“After about six months, … President Yajuddin Ahmed … told me that I had to resign. On query, he told me that there were serious allegations of corruption against me.”
অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দীন আহমেদ বিচারপতি সিনহাকে তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের কারণে পদত্যাগ করতে বলেছিলেন। “আ ব্রোকেন ড্রিম” বইটির অধ্যায় ৪ অনুযায়ী বিচারপতি সিনহা যে পদত্যাগ করতে রাজি হননি তার একমাত্র কারণ ছিল পদত্যাগ করলে তিনি তাঁর পেনশন বেনেফিট পাবেন না। কী আশ্চর্য যুক্তি! যেখানে বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে তাঁকে পদত্যাগ করতে বলা হচ্ছে সেখানে কিনা তিনি দুর্নীতির অভিযোগ খণ্ডন করার চাইতে গুরুত্ব দিলেন পেনশন বেনেফিটকে? এটাই কি বিচারপতি সিনহার দুর্নীতি-দর্শন?
যাই হোক, সে যাত্রায়ও বিচারপতি সিনহা তাঁর বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতির অভিযোগ থেকে রেহাই পেলেন ওয়ান-ইলেভেনের এক বড় পীরের মুরিদ হয়ে। তিনি আর কেউ নন, ওয়ান-ইলেভেনের অন্যতম কুশীলব ডঃ কামাল হোসেন। “এ ব্রোকেন ড্রিম” বইটির অধ্যায় ৪-এ বিচারপতি সিনহা লিখেছেন:
“Dr. Kamal Hossain was in the U.K. and on getting information, he sent his daughter Barrister Sara Hossain, an activist and social worker, to my Kakrail residence with the message that I should not do anything till his return. ... Dr. Hossain in the meantime had returned from abroad and met me in my chamber and handed over a written reply.”
অর্থাৎ বিচারপতি সিনহা লিখেছেন যে এই সময়ে ডঃ কামাল হোসেন যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছিলেন। খবর পাওয়ামাত্রই তিনি তাঁর মেয়ে ব্যারিস্টার সারা হোসেনকে বিচারপতি সিনহার কাকরাইলের বাসভবনে পাঠান এই কথা বলে যে, ডঃ কামাল হোসেন দেশে ফেরা না পর্যন্ত বিচারপতি সিনহা যেন কোনো সিদ্ধান্ত না নেন। এরপর ডঃ কামাল হোসেন দেশে ফিরে এলে বিচারপতি সিনহার কোর্ট চেম্বারে এসে বিচারপতি সিনহার পক্ষে একটি লিখিত জবাব তৈরি করে দেন যেন বিচারপতি সিনহার দুর্নীতির বিরুদ্ধে ওয়ান-ইলেভেন সরকারের দিক থেকে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হয়। এ যাত্রায়ও বিচারপতি সিনহা তাঁর বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতির অভিযোগ থেকে পার পেয়ে গেলেন। আর তাই ডঃ কামাল হোসেনের প্রতি তাঁর আন্তরিক কৃতজ্ঞতা থাকাটা খুব স্বাভাবিক বৈকি!
“আ ব্রোকেন ড্রিম” বইটির অধ্যায় ৫ অনুযায়ী বিচারপতি সিনহা ২০০৯ সালের ১৫ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে নিয়োগ পান। এরপর ২০১৫ সালের ১৫ জুলাই মহামান্য রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সিনহাকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেন। এখন আপনারাই বলুন, কোনো রকম দুর্নীতির সাথে কখনও জড়িত ছিলেন না বলে বিচারপতি সিনহা তাঁর “আ ব্রোকেন ড্রিম” বইয়ে যে দাবি করেছেন সেকথা কি ঠিক?
বিচারপতি সিনহা মনে করেন তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। বিচারপতি সিনহা তাঁর বইয়ের অধ্যায় ২৯-এ জোর গলায় দাবি করেছেন তাঁর বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগের ব্যাপারটি শুধু ষোড়শ সংশোধনী বাতিল মামলার রায়ের পরই ওঠানো হয়েছে। এটা বিচারপতি সিনহার মতে তাঁর বিরুদ্ধে সরকারের আক্রোশের বহির্প্রকাশ। সরকার আসলে এভাবে বিচারপতি সিনহার চরিত্র হননের মাধ্যমে সরকারের অন্যায় এবং অপ্রত্যাশিত কর্মকাণ্ডকেই নাকি বৈধতা দিতে চেয়েছে।
এমনকি বিচারপতি সিনহা “আ ব্রোকেন ড্রিম” বইটির অধ্যায় ২৯-এ আরো বলেছেন, ২০১৭ সালের ১ অক্টোবর তারিখে বিচারপতি আব্দুল ওহাব মিয়া মৌখিকভাবে তাঁকে কিছু দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগের কথা জানান বটে। কিন্তু বিচারপতি সিনহা দাবি করেছেন তিনি জানেনই না তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ গুলো কি কি। [I did not exactly know what the allegations were against me.]
কিন্তু আমরা বিচারপতি সিনহার কথা আর কাজের মিল খুঁজে পাচ্ছি না। কেননা:
(১) বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগের কথা শুধু ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ের পরই উঠেছে এই দাবি সত্য নয়। বিচারপতি সিনহা নিজেই লিখেছেন, বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই প্রত্যেক সরকারের আমলেই তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। তবে সেগুলো তিনি যথাযথভাবে সামাল দিয়েছেন।
(২) ২০১৭ সালে বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে কি এমন দুর্নীতির অভিযোগ উঠল যে তিনি তা ঠিকমতো না জেনেই স্বেচ্ছা-নির্বাসনে চলে গেলেন? জানার চেষ্টা পর্যন্ত করলেন না? এমনকি তাঁর পীর সাহেবও কোন সুরাহা করতে পারলেন না? খুব জটিল বিষয়!
(৩) বিচারপতি সিনহা দেশে ফিরে এসে কেন দুর্নীতির অভিযোগগুলো খণ্ডন করছেন না? তিনি নিয়মিত সামাজিক মাধ্যমে সরকারের নামে বিষোদ্গার করছেন। কিন্তু যেই কাজটি তাঁর সবার আগে করা উচিত তা হলো নিজের মাথা থেকে দুর্নীতির অভিযোগের কলঙ্ক মুছে ফেলা। আর সেটি তিনি বিদেশের হাজারো গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়ে করতে পারবেন না। তাকে এই দেশে ফিরে এসে তাঁর সত্যটি প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মরণ লড়াই করে যেতে হবে।
সবশেষে, আমি জানি একটি প্রশ্ন নিশ্চয়ই সবার মনে উঁকি দিচ্ছে। আর তা হলো, যদি বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে এতো আগে থেকেই দুর্নীতির অভিযোগ থেকে থাকে তাহলে তাঁকে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি কেন করা হলো? এর উত্তর হল সকল ব্যক্তিকেই আমাদের নির্দোষ বলে ধরে নিতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত না সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করা যাচ্ছে যে, তিনি অপরাধী (Presumption of Innocence)। যেহেতু বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগগুলো প্রমাণ করার প্রয়াস কখনোই নেয়া হয়নি, অথবা তিনি কোনো না কোনোভাবে তা করতে দেননি, সেহেতু তাঁকে আইনগতভাবে দুর্নীতিবাজ বলা সঠিক নয়।
তিনি এ কারণেই Benefit of Doubt পেয়েছেন। আর এখন তো বিচারপতি সিনহা দেশ ছেড়ে বিদেশে বসবাস করছেন। বর্তমানের দুর্নীতির অভিযোগসমূহ তদন্ত করাও প্রায় অসাধ্য হয়ে পড়বে।
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ
আইনজীবী ও আইনের শিক্ষক
বাংলাদেশ সময়: ০৯১২ ঘণ্টা, অক্টোবর ২২, ২০১৮