অথচ ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বীর-সৈনিক শহীদ তিতুমীর, হাজী শরীয়তুল্লাহ্, দুদু মিয়া, মাওলানা গাজী ইমামুদ্দীন বাঙালি (নোয়াখালী), আল্লামা হাফেজ্জি হুজুর (রহ), আল্লামা আসআদ মাদানী (রহ), আল্লামা লুত্ফুর রহমান বরুণী (রহ.), চরমোনাইর পীর ইসহাক (রহ.), আল্লামা কাজী মু. তাসিম বিল্লাহ, আল্লামা মুফতি নুরুল্ল্যাহ (রহ.), আল্লামা এমদাদুল হক আড়াইহাজারী (রহ.), আল্লামা শামসুদ্দিন কাসেমী (রহ.) প্রমুখ ছিলেন দাড়ি-টুপিধারী আলেম।
১৯৪৭ সালে যখন ভারত ও পাকিস্তান নামে দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হচ্ছিল, তখন বাংলার প্রখ্যাত আলেম মাওলানা মোহাম্মদ শামসুল হুদা পাঁচবাগী পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরোধিতা করেন এবং বাংলা ভাষাভাষি অঞ্চল নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি তোলেন।
শুধু তাই নয়। গত ১১ এপ্রিল ২০১৭ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেম-ওলামার সঙ্গে এক ঐতিহাসিক বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। ওই বৈঠকে তিনি বলেন, ‘যারা দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তাদের বিরাট ভূমিকা ছিল। তারাই প্রথম ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। কাজেই আজকে যে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি, সেখানে তাদের অনেক ভূমিকা রয়েছে। কারণ সেই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকেই এ যাত্রা শুরু হয়। ’ (দৈনিক কালের কণ্ঠ, ১৪/০৪/২০১৭)
শুধু ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনই নয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও অনেক আলেম-ওলামা দেশের জন্য বুকের তাজা রক্ত দিয়েছেন।
বাংলাদেশের বিখ্যাত আলেম ও বুজর্গ মাওলানা মোহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জি হুজুর (রহ.) সে সময় স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, ‘এ যুদ্ধ ইসলাম আর কুফরের যুদ্ধ নয়, এটা হলো জালেম আর মজলুমের যুদ্ধ। পাকিস্তানিরা জালেম, এদেশের বাঙালিরা মজলুম। তাই সামর্থের আলোকে সবাইকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হবে এবং এটাকে প্রধান কর্তব্য বলে মনে করতে হবে। ’ (ইত্তেফাক)
বাংলার মুসলিমদের মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করতে শহীদ বুদ্ধিজীবী মাওলানা অলিউর রহমান রচনা করেছিলেন—‘ছয় দফা ইসলামবিরোধী নহে’, ‘শরিয়তের দৃষ্টিতে ছয় দফা’, ‘জয় বাংলা ও কয়েকটি স্লোগান’ ইত্যাদি। পরে ১৪ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনীর বুলেটে অসংখ্য বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে শাহাদাত বরণ করেন। (কালের কণ্ঠ)
একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামে যোগ দিয়েছিলেন সশস্ত্র যোদ্ধা ছাগলনাইয়ার মাওলানা মাকসুদ ভূঁইয়া, আল্লামা এমদাদুল হক আড়াইহাজারী (রহ), হাতিয়ার মাওলানা মোস্তাফিজ, চট্টলার কমান্ডার মাওলানা সৈয়দ প্রমুখ।
এছাড়া চরমোনাইয়ের মাওলানা ইউসুফ, বায়তুল মোকাররমের মুয়াজ্জিন আহমদুল্লাহ আশরাফ, মাওলানা এমদাদুল হক আড়াইহাজারীসহ অনেকেই একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামে সরাসরি যুদ্ধ করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজবাড়ী জেলখানায় আটক বিহারীদের জয় বাংলার পক্ষে সমর্থন দেওয়ার অনুরোধ করায় প্রাণ দিতে হয়েছিল মাওলানা কাজী ইয়াকুব আলীকে। পাকিস্তানি বাহিনী রাজবাড়ী দখলের পর বিহারীরা জেলখানা থেকে ছাড়া পেয়ে মাওলানা কাজী ইয়াকুব আলীকে গলা কেটে হত্যা করে। তারপর তার পেটের মাঝখানে পাকিস্তানি পতাকা পুঁতে দিয়ে বলে, ‘আভি শালা জয় বাংলা বোলো’। (দৈনিক সংগ্রাম ৭/১১/২০১৫)
স্বাধীনতা যুদ্ধে আলেমদের অবদান অসামান্য। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী আলেম-ওলামাদের নিয়ে প্রামাণ্যনির্ভর একটি বৃহৎ গ্রন্থ রচনা করেছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক শাকের হোসাইন শিবলী। ‘আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে’ শিরোনামের বইটিতে তিনি দেশের বিখ্যাত আলেম-মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান ও জীবন্তিকা তুলে ধরেছেন। তথ্যসমৃদ্ধ গ্রন্থটি পড়লে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আলেমদের অবদান ও কীর্তি সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা পাওয়া যাবে।
আল্লাহ তাআলা মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের ওপর শান্তি বর্ষণ করুন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক চিন্তা-আদর্শ লালনের তাওফিক দান করুন।
লেখক,
ইসলামী ফিকাহ ও ইতিহাসবিষয়ক গবেষক
বাংলাদেশ সময়: ১৭২১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৮
এমএমইউ/