৪০০ বছরের প্রাচীন শহর রাজধানী ঢাকা। ঐতিহ্য আর নানা সংস্কৃতির বৈচিত্র্যের কারণে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম মেগাসিটি এই শহর।
১৯৪৪ সালের ১ এপ্রিল পুরান ঢাকার সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তার জন্ম। পিতা আবদুল আজিজ আর মাতা মুন্নি বেগমের ছোট ছেলে হানিফ।
আদর করে সবাই তাকে ‘ধণী’ নামে ডাকতেন। শিশু হানিফ ছোটবেলায় মমতাময়ী মাকে হারান। মায়ের মৃত্যুর পর ফুফু আছিয়া খাতুনের কাছে পুরান ঢাকার ঐতিহ্য আর আদর্শে বেড়ে উঠেন। ঢাকার প্রখ্যাত পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি মাজেদ সরদার ছিলেন ঢাকার শেষ সরদার।
মোহাম্মদ হানিফের বহুমুখী প্রতিভা তাকে মুগ্ধ করে। তাই ১৯৬৭ সালে মাজেদ সরদার নিজের মেয়ে ফাতেমা খাতুনকে মোহাম্মদ হানিফের সঙ্গে বিয়ে দেন। এই দম্পতির একজন ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে।
ছেলে মোহাম্মদ সাঈদ খোকন পিতার আদর্শ ধারণ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রের দায়িত্ব পালন করছেন।
মোহাম্মদ হানিফ তরুণ বয়স থেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন। আমৃত্যু জাতির পিতার আদর্শেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছিলেন। দলীয় রাজনীতি করলেও তার উদার চিন্তা-চেতনা ও সংবেদনশীল মনোভাবের কারণে তিনি ছিলেন দলমত নির্বিশেষে সব মানুষের নেতা।
সবার কাছেই তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল অসামান্য। তার জীবন ছিল কর্মময়, ধ্যান ধারণা ছিল অত্যন্ত সুন্দর, ব্যক্তিগত চরিত্রে ছিল সজ্জন ও সততা সৌরভে উজ্জ্বল। একজন জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা ‘নগর পিতা’ নির্বাচিত হন, যিনি নগরবাসীর প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত ঢাকার প্রথম একজন মেয়র।
নিজ বিশ্বাসে অটল থেকে এবং তা অকপটে প্রকাশ করতে পারা একজন ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন তিনি। প্রয়াত মেয়র হানিফ ছিলেন একজন ঈমানদার ও ধার্মিক মুসলমান। একই সঙ্গে ইসলামের মর্যাদা এবং দ্বীন প্রচারেও সোচ্চার।
তিনি তার প্রিয় ঢাকা নগরীকে ইসলামী স্থাপত্য কলায় সাজিয়ে তুলতে কাজ করেছেন। যার সুবাদে মুসলিম প্রধান দেশের রাজধানীতে বিদেশি মেহমান কেউ নেমেই যেন বুঝতে পারেন তারা কোথায় এসেছেন! বুকে হাজারো স্বপ্ন থেকে তা বাস্তবে রূপ দিতে মৃত্যুর আগ পযর্ন্ত সচেষ্ট ছিলেন এই রাজনীতিক।
সব ধর্মালম্বী মানুষের তিনি ছিলেন পরম প্রিয়জন। দুর্গাপূজা কিংবা বড়দিন অথবা অন্য কোনো উৎসবে তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতেন। তার সহায়তায় অসংখ্য মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা সংস্কার করা হয় রাজধানীতে।
মোহাম্মদ হানিফ ছাত্রাবস্থায় ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী হিসেবে রাজনীতিতে যোগ দেন। ১৯৬০ সালে পুরান ঢাকার ইসলামিয়া হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে পরবর্তীতে তৎকালীন কায়েদে আযম কলেজে (শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ) উচ্চ মাধ্যমিক এবং বিএ পরীক্ষায় সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। এরপর ভর্তি হন আইনে। কিন্তু লেখাপড়া শেষ করতে পারেননি।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ের পর গঠিত প্রাদেশিক সরকার ভেঙে দেওয়ার পর শেখ মুজিবর রহমানকে দুর্নীতির মামলায় গ্রেফতার করা হয়। এর মধ্যে ২৪ ঘণ্টার নোটিশে বাড়ি ছঅড়তে বলা হয় বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ও তার পরিবারকে।
ওই সময়ে কেন্দ্রীয় সরকারের রক্তচক্ষু, হুমকি-ধমকি উপেক্ষা করে মোহাম্মদ হানিফের পুরান ঢাকার নাজিরা বাজারের বাসায় বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবের পরিবারকে থাকার অনুরোধ করেন মোহাম্মদ হানিফ।
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিবও মোহাম্মদ হানিফকে খুব স্নেহ ও বিশ্বাস করতেন। তিনিও চাইতেন মোহাম্মদ হানিফ যেন সর্বদাই বঙ্গবন্ধুর পাশে থাকেন।
মোহাম্মদ হানিফের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের ঘনিষ্টতা কোনো দিন কমেনি বরং মুজিব পরিবারের বিশ্বস্ত হিসেবে আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছেন তিনি।
১৯৬৫ সালে বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন হানিফ। তিনি একান্ত সচিব থাকাকালে ৬ দফা আন্দোলনের প্রস্তুতি, ৬ দফা মুক্তি সনদ প্রণয়ন এবং প্রচারে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যূত্থান, সত্তরের জাতীয় নির্বাচন এবং একাত্তরে মহান মুক্তি সংগ্রামে হানিফের বলিষ্ঠ ভূমিকা চিরস্মরণীয়।
স্বাধীনতার পরবর্তীকালে সব আন্দোলন, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি রাজপথে প্রথম কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। অতুলনীয় সাংগঠনিক দক্ষতা এবং সম্মোহনী বাগ্মিতা তাকে কিংবদন্তি তুল্য খ্যাতি এবং ঈর্ষনীয় জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে।
১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর ছেড়ে দেওয়া ঢাকা-১২ আসন থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নিবার্চিত হন এবং পরবর্তী সময়ে হুইপের মহান দায়িত্ব পালন করেন।
সংগ্রামী জীবনে ১৯৭৬ সালে মোহাম্মদ হানিফ ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি নিবার্চিত হন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ৩০ বছর এ দায়িত্বে ছিলেন। নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন মোহাম্মদ হানিফ।
মোহাম্মদ হানিফের জীবনের বড় ট্র্যাজেডি ছিল পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের কালরাতে ইতিহাসের বর্বরোচিত কায়দায় বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের নিমর্ম হত্যাকাণ্ড। যা কোনোদিনই মেনে নিতে পারেননি তিনি।
বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর ১০ বছরের শিশুপুত্র শেখ রাসেলের হত্যাকাণ্ড মোহাম্মদ হানিফকে বেদনার গভীর সাগরে ভাসিয়ে দেয়। ১৯৭৩ সালে লন্ডন সফরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের কথা ছিল- ‘আমার যদি কিছু হয়ে যায় তুই আমার রাসেলকে দেখবি। ’
বঙ্গবন্ধুর এই নির্দেশ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মনে রেখেছেন হানিফ। তাই ১৫ আগস্টের বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞের মোহাম্মদ হানিফের কণ্ঠে ছিল- ‘মাগো তোমায় কথা দিলাম, মুজিব হত্যার বদলা নেবো, রাসেল হত্যার বদলা নেবো। ’
১৫ আগস্টের শোককে শক্তিতে পরিণত করে রাজনৈতিকভাবে মুজিব হত্যার বদলা নেওয়া ও হত্যার বিচারের দাবিতে দৃপ্ত শপথে বলীয়ান ছিলেন তিনি।
১৯৯৪ সালের ৩০ জানুয়ারি ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যাবধানে ঢাকার প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন। তার সময়ে ঢাকার উন্নয়নে রাস্তাঘাট, নর্দমা, ফুটপাত উন্নয়ন ও সংস্কার, নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়নে রোড ডিভাইডার নির্মাণ, আন্ডারপাস, সেতু, ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করা হয়।
পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয় ধানমন্ডি লেক এবং আশেপাশের এলাকা। ঢাকাবাসী সুপেয় পানির চাহিদা পূরণে তিনি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেন। ঢাকার সৌন্দর্য বাড়ানো ও নগরবাসীর চাহিদা পূরণে নগরীতে বিজলী বাতি স্থাপন, নগর সৌন্দর্য বর্ধণে ফোয়ারা নির্মাণ, বনায়ন কর্মসূচি, পুরান ঢাকায় ছিন্নমুল শিশু কিশোরদের প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র নির্মাণ করেন।
নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী ছিলেন মেয়র হানিফ। নারী শিক্ষা বিস্তারে লক্ষ্মীবাজারে প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকা মহানগর মহিলা কলেজ। এছাড়া নারীদের মাতৃত্বকালীন সময়ে পরিচর্যার জন্য নগরীতে বেশ কয়েকটি মাতৃসদন ক্লিনিক নির্মাণ করেন।
শিশুবান্ধব ঢাকা গড়তে নিরলস কাজ করেছেন নগরপিতা হানিফ। শিশু-কিশোরদের বিনোদনের জন্য পৌর শিশু পার্ক নির্মাণ ও পুরাতন পার্ক গুলোতে প্রাণ ফিরিয়ে আনাসহ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় নির্মাণ করেছেন তিনি।
মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ ঢাকাবাসীর কষ্ট লাঘবে নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম পরিচালনা, মশক নিধন কর্মসূচি গ্রহণ করেন। হোল্ডিং ট্যাক্স না বাড়িয়েও যে মহানগরীর উন্নয়ন সম্ভব ঢাকাবাসীকে তাই করে দেখিয়ে গেছেন তিনি।
১৯৯৬ সালের মার্চের শেষ সপ্তাহে স্বৈরাচার বিরোধী গণআন্দোলনে মোহাম্মদ হানিফের নেতৃত্বে ‘জনতার মঞ্চ’ গঠিত হয়। যা তৎকালীন বিএনপি সরকারের পতনসহ আওয়ামী লীগের রাজনীতির জন্য টার্নিং পয়েন্ট তৈরি করে এবং এর ফলশ্রুতিতে ’৯৬-এর ১২ জুন দেশের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়।
মেয়র মোহাম্মদ হানিফ আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিশ্বস্ততার প্রমাণ দিয়েছেন ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রত্যক্ষ মদদ এবং হাওয়া ভবনের নির্দেশনায় পরিচালিত গ্রেনেড হামলার মূল টার্গেট ছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা এবং সে সময়ের বিরোধীদলের নেত্রী শেখ হাসিনা।
২০০৪ সালের ভয়াল ২১শে আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের আওয়ামী লীগের সন্ত্রাস বিরোধী সমাবেশের ট্রাক মঞ্চে শেখ হাসিনার ওপর নারকীয় গ্রেনেড হামলার সময় নিজের জীবন তুচ্ছ করে মানবঢাল রচনা করে প্রিয়নেত্রীকে রক্ষা করেন মোহাম্মদ হানিফ।
একের পর এক ছোড়া গ্রেনেডের সামনে নির্ভয়ে পেতে দিলেন নিজেকে, বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রাণে রক্ষা পেলেও মারাত্মক আহত হন তিনি। মস্তিস্কসহ দেহের বিভিন্ন অংশে অসংখ্য ঘাতক স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়। দীর্ঘদিনের চিকিৎসায়ও স্প্লিন্টার অপসারণ করা যায়নি। দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়েই রাজনৈতিক জীবনে সক্রিয় থেকেছেন মোহাম্মদ হানিফ।
একজন প্রকৃত নেতা হিসেবে জাতির প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নে এই অকুতোভয় সৈনিক রাজপথে থেকেই নেতৃত্ব দিয়েছেন। ২০০৬ এর ৮ ফেব্রুয়ারি মুক্তাঙ্গনে এক সমাবেশে সভাপতির বক্তৃতা দেওয়ার সময় তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন।
আগে মাথায় বিদ্ধ হওয়া স্প্লিন্টারের প্রতিক্রিয়ায় পরবর্তী সময়ে তার শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হয়। তীব্র যন্ত্রণা ভোগ করে ২০০৬ সালের ২৮ নভেম্বর দিনগত রাতে ৬২ বছর বয়সে ঢাকার একটি হাসপাতালে শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করেন মোহাম্মদ হানিফ।
বৃহস্পতিবার (২৮ নভেম্বর) তার ১৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। মোহাম্মদ হানিফ চলে গেলেন জাতির এক চরম দুঃসময়ে। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তার মতো আদর্শ, অকুতোভয় ও বিচক্ষণ নেতার বড় প্রয়োজন ছিল। তার শূন্যতা কখনও পূরণ হওয়ার নয়। দেশের রাজনীতিতে তার অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়।
একজন সফল রাজনৈতিক ও মানবিক গুণাবলীর অধিকারী ব্যক্তিত্ব মোহাম্মদ হানিফ মানুষের হৃদয়ে কাল থেকে কালান্তরে বেঁচে থাকবেন তার কর্মের মাধ্যমে। মৃত্যুবার্ষিকীতে তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি, আমিন।
লেখক: জনসংযোগ কর্মকর্তা, মেয়র মোহাম্মদ হানিফ মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৩৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৮, ২০১৯
এমএ/