ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত নবকুমার সমুদ্রতীরের বনে বনে হাঁটতে থাকেন পথের সন্ধানে। দুঃখ কষ্ট যাতনায় প্রহর গুনতে থাকেন মৃত্যুর।
বনের ভিতরে একটি বাড়িতে এসে কপালকুন্ডলা বলল, ‘আজি এইখানে লুকাইয়া থাক, কালি প্রত্যূষে তোমাকে মেদেনীপুরের পথে রাখিয়া আসিব। ’ কঠিনতম সময়ে এমন আশ্রয় নবকুমারকে নতুন জীবন দেয়। কিন্তু কপালের লিখন কে করিবে খন্ডন? নবকুমার আর কপালকুন্ডলার এই রোমান্টিকতা দীর্ঘস্থায়ী হলো না। আসলে বহতা জীবনে কোনো সুখই হয়তো চিরস্থায়ী হয় না। ভুল বোঝাবুঝি তছনছ করে দেয় অনেক কিছু। নবকুমারের জীবনেও এর আগে পরে ছিল অনেক কিছুর ওঠানামা। কপালকুন্ডলার পাশাপাশি ছিল পদ্মাবতী লুৎফুন্নিসার প্রেমবিরহ, জীবন চলা, কঠিন গলায় প্রতিবাদী কণ্ঠ আর গভীর আবেগ। প্রেমের গভীর আবেগের আলো-ছায়ায় যোগ হয় কপালকুন্ডলার সঙ্গে বিশ্বাস-অবিশ্বাস। হৃদয়ের আঘাত তছনছ করে দেয় নবকুমারকে। একটা অজানা ছায়া তৈরি করে সেই হৃদয়ের অচিনপুরে। তাই এই উপন্যাসের শেষ মুহূর্তে একদিকে নবকুমারের অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠ, অন্যদিকে তার কাঁপা হাতের ছোঁয়ায় কপালকুন্ডলার দৃঢ়তা একচুলও কমেনি। বরং সত্য উচ্চারণে কপালকুন্ডলার কণ্ঠে ছিল দৃঢ়তা। নবকুমারের উৎকণ্ঠা আর আকুলতার জবাবে বলল, ‘তুমি কী জানতে চাও বল?’ দীর্ঘ নাটকীয়তার পর নবকুমার বলল, শুধু একবার বল তুমি অবিশ্বাসিনী নও শুধু একবার বল। গঙ্গার একদম কিনারে দাঁড়িয়ে সেই দিন কপালকুন্ডলা বলেছিল, ‘যাহাকে দেখিয়াছ সে পদ্মাবতী। আমি অবিশ্বাসিনী নহি। আমি আর গৃহে যাইব না। ভবানীর চরণে দেহ বিসর্জন করিতে আসিয়াছি-নিশ্চিত তা করিব। তুমি গৃহে যাও। আমি মরিব। আমার জন্য রোদন করিও না। ’
নবকুমার চিৎকার করে উঠলেন। কিন্তু তার শেষ আকুতিও আটকাতে পারল না কপালকুন্ডলাকে। নবকুমারও গঙ্গায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন উদ্ধার করতে। কিন্তু কেউই আর উঠলেন না।
বিশ্বাস-অবিশ্বাসের চোরাবালি শেষ করে দেয় সবকিছু। একবার অবিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি হলে কোনো আর্তনাদেই তা আর সহজে ফিরে আসে না। দুঃখের রাতগুলো সহজে শেষ হয় না আমাদের। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কষ্টের পাহাড় থেকে আলোর ছটার জন্য শুধুই যেন অপেক্ষা। দুঃখ-কষ্ট শুধু প্রেমবিরহে হবে এমন নয়। জাগতিক চাওয়া-পাওয়াও আমাদের কখনো কখনো তছনছ করে দেয়। অতি আবেগে আমরা আসল-নকল চিনি না। সোনা আর খাদের পার্থক্য বুঝি না। ভালো-মন্দের বাছবিচারে যাই না। সবকিছুই উড়িয়ে দিই হাসি-খুশি ভাবধারায়।
হাসি-খুশির গল্পটা শওকত ভাইয়ের কাছ থেকে শোনা। এক ভদ্রলোকের বউয়ের নাম হাসি। শালিকার নাম খুশি। ভদ্রলোক গেলেন শ্বশুরবাড়ি। রাতে ভুল করে বউয়ের পরিবর্তে শালিকার দিকে হাত বাড়ালেন। শালিকা চিৎকার করে উঠল, করেন কী? করেন কী? ভুল করেছেন। আমি তো খুশি। ভদ্রলোক বললেন, সমস্যা কী? তুমি খুশি তো আমিও খুশি। আমাদের অবস্থা অনেকটা হাসি-খুশির মতো। অনেক কিছু মানতে পারি না। আবার মেনেও নেই। শীত, বসন্ত সবকিছুতেই আমরা খুশি। গ্রীষ্মের খরা ও বর্ষার জোয়ার-ভাটা আঘাত হানলেও খুশির শেষ থাকে না।
ছাত্রলীগের এক সাবেক সভাপতি বন্ধুকে বললাম, নতুন কমিটি কেমন হলো? সেই নেতা বললেন, অনেক ভালো হয়েছে। আমি খুশি। জবাবে বললাম, আমার কাছেও ভালো মনে হচ্ছে। তোমার সঙ্গে একমত। আর তোমার খুশিতে আমিও খুশি। শুধু ভয় অতি উৎসাহীদের নিয়ে আর চারদিকের নানামুখী ষড়যন্ত্রে। আওয়ামী লীগ উদারপন্থি অসাম্প্রদায়িক একটি রাজনৈতিক দল। নীতি ও আদর্শের ওপর ভিত্তি করে দলটি প্রতিষ্ঠিত। এ দলে নানা কিসিমের মানুষের উৎপাত অতীতে ছিল, এখনো আছে। আগামীতেও আসবে। কিন্তু সবকিছুকে উৎসাহিত করলেই সর্বনাশ। একটা অদ্ভুত যুগ চলছে। এ যুগে কিছু মানুষ সন্ত্রাসকে সমর্থন দিয়ে মত প্রকাশ করে। অপকর্মের পক্ষে অবস্থান নেয়। কোনো অপতৎপরতা আওয়ামী লীগের রাজনীতি হতে পারে না।
ভাত ছিটালে কাকের অভাব হয় না। পার্টি ক্ষমতায় থাকলে কর্মী-সমর্থক, শুভানুধ্যায়ীর অভাব হয় না। থাকে সংগঠনের ছড়াছড়ি। ’৯৬ সালের পর ঢাকা শহরের ফুটপাথজুড়ে শুধুই সরকার সমর্থকদের অফিস দেখতাম। ২০০১ সালে সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে এক দিনে সব সাইনবোর্ডও বদলে গেলো। পুরাতন সাইনবোর্ডে নতুন সংগঠনের নাম উঠল আকাশে। দেশে চলছে হলুদ-বেগুনের মিশ্রণে নতুন জগাখিচুড়ি অবস্থা। সুবিধাবাদীরা যা খুশি তা করছে। সরকারের কতিপয় মন্ত্রী তাদের আশ্রয় দিচ্ছেন। সাইনবোর্ড মার্কা সংগঠনে মন্ত্রীরা কেন অতিথি হবেন? আওয়ামী লীগের বৈধ সংগঠনের কি অভাব পড়েছে? মোটেও না। বরং বৈধ সংগঠনের নেতা-কর্মীরা মন্ত্রীদের কাছে পেলে আনন্দিত হন। উৎসাহিত হন। তাদের বাদ দিয়ে জগাখিচুড়ি মার্কা সংগঠনের অনুষ্ঠানে মন্ত্রী সাহেবদের কেন যেতে হবে?
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের পবিত্র একটি শব্দ। এ শব্দকে কলঙ্কিত করার অধিকার কারও নেই। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাণিজ্য করার অধিকার কারও নেই। দেশে আইনের শাসন তার নিজস্ব নিয়মে চলবে। কেউ অপরাধ করলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে রাষ্ট্র। কিন্তু কোনো সংগঠনের নামে আইন হাতে তুলে নিয়ে সন্ত্রাসী কাজ হলে রাষ্ট্রের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। প্রশ্ন ওঠে- বাংলাদেশে আইনের শাসন আছে তো?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নামে বাড়াবাড়িটা ছিল দুঃখজনক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার ক্ষমতায়। মুক্তিযুদ্ধ নাম ব্যবহার করে সন্ত্রাস করলে তার দায় কার ওপর গিয়ে পড়ে? মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামে সংগঠনের কান্ডকীর্তি সেই প্রশ্নই সৃষ্টি করেছে। এ ধরনের দোকানগুলো আল্লাহরওয়াস্তে বন্ধ করুন। আওয়ামী লীগের উচিত শুধু বৈধভাবে কাজ করা সহযোগী সংগঠনগুলোর তালিকা আরও স্পষ্ট করে প্রকাশ করা। আর বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ, আওয়ামী শব্দের অপব্যবহারকারী সাইনবোর্ডসর্বস্ব অবৈধ সংগঠনগুলো নিষিদ্ধ করা।
বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নাম ব্যবহার করে সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির অধিকার কারও নেই। ক্ষমতাসীন দলে সবাই বাহাদুরি দেখাতে পারে। ক্ষমতায় না থাকলে বোঝা যায় কত ধানে কত চাল। এখন বিএনপি হাড়ে হাড়ে তা টের পাচ্ছে। খালেদা জিয়ার মুক্তি চেয়ে মিছিল করার লোকও নেই। অথচ ক্ষমতায় থাকার সময় বিএনপি ও জিয়াউর রহমানের নাম ব্যবহার করে সংগঠনের অভাব ছিল না। কমতি ছিল না চাটুকার তোষামোদকারীর। নানা কিসিমের লোক দেখতাম বিএনপির সামনের কাতারে বসে থাকত। তাদের সাজ-পোশাকের অভাব ছিল না। শিল্প-সংস্কৃতির লোকেরা আগে যেতেন জিয়ার মাজারে। এখন যান বঙ্গবন্ধুর মাজারে। আগে চলতেন জাসাস, জিসাসের ব্যানারে; এখন চলেন দাপুটে মন্ত্রীদের সঙ্গে সেলফি তুলে।
সময় পরিবর্তন হয়েছে। মানুষগুলোর খুব বদল আসেনি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে দোকানের অভাব হয় না। বিরোধী দলে গেলে সেসব দোকান বন্ধ হয়ে যায়। দোকানদাররা চলে যান নতুন ব্যবসায়। সময় অনেক কিছু বদলে দেয়। রাজনীতিও থেমে থাকার বিষয় নয়। পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর ভর করেই অনেক কিছু হয়। নামে-বেনামে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু পরিবারের নাম ব্যবহার করে এত সংগঠনের কী দরকার?
সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধারা আওয়ামী লীগের সঙ্গেই আছেন। কারণ একটা সম্মান তারা আওয়ামী লীগের কাছেই পেয়েছেন। তাদের দাফনের সময় রাষ্ট্রের পক্ষে গার্ড অব অনার হয়। মাসে মাসে একটা ভাতা দেওয়া হয়। এই মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে আরও নজর দেওয়া দরকার। মুক্তিযুদ্ধের নাম ব্যবহার করে নতুন দোকানের আর দরকার নেই। কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মালেকের সঙ্গে সেদিন ফোনে কথা হচ্ছিল। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময় দক্ষিণ লাকসামের কমান্ডার। ব্যক্তিগতভাবে আমার সঙ্গে সম্পর্কটা অনেকটা পারিবারিক। ’৭১ সালে যুদ্ধের সময় অনেক দিন তিনি আমাদের বাড়িতে ছিলেন। আমার ভাই আশরাফ উদ্দিন ভূঁইয়া, মামা দেলোয়ার হোসেন ও এক খালাতো ভাই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আমার ফুফাতো বোনের স্বামী শহীদ হয়েছিলেন ’৭১ সালে। মালেক কমান্ডার যুদ্ধের সময় আমার নানীকে মা ডাকতেন। সেই কারণে আমাকে ডাকেন ভাগ্নে। মামা ডাকি আমি। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে আমার মা রান্না করে অপেক্ষা করতেন যোদ্ধাদের জন্য। মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার আবদুল মালেকের কাছে জানতে চাইলাম, মামা কেমন আছেন? তিনি বললেন, ভাগ্নে ভালো নেই আর্থিকভাবে, শারীরিকভাবে।
কুমিল্লার দুজন সাংবাদিককে পাঠালাম মালেক কমান্ডারের খোঁজ নিতে। তারা জানালেন, আসলেই ভালো নেই তিনি। বাড়ির টিনের ঘরটা ভেঙে পড়ছে। বয়স হচ্ছে। শরীরও বিদ্রোহ করছে এই যোদ্ধার। ঢাকা আসতে চান। ওদের বললাম, পাঠিয়ে দাও। মনটা খারাপ হয়ে গেলো। মাঠের সত্যিকারের যোদ্ধাদের জন্য আরও অনেক কিছু করা যায়। সে বিষয়ে ভাবতে হবে। আজকাল ঢাকা শহরে হাঁটলেই অনেক মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পাওয়া যায়। কিছু মানুষ মুক্তিযুদ্ধ শব্দ ব্যবহার করে যা খুশি তা করছে। অনেক চেতনার কান্দন দেখলেই সন্দেহ হয় গ্লিসারিন ব্যবহার করে কিনা। গ্লিসারিন দিয়ে কান্নার বিষয়টি আগে জানতাম না। সিনেমা দেখার সময় এক বন্ধু নায়িকা শাবানার কান্না সম্পর্কে বুঝিয়েছিল, এই কান্না আসল না, গ্লিসারিনের। অকারণে কান্নাকাটি দেখে অনেক প্রশ্ন উঠে আসে। জাতির জনকের সত্যিকারের আদর্শিক ধারায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধরে রাখতে হবে।
মানুষ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারাবাহিকতা দেখতে চায়। অকারণে কোনো কিছু প্রশ্নবিদ্ধ করা যাবে না। বাড়াবাড়ি মেনে নেওয়া যাবে না। পেশাদারিত্বের কোনো বিকল্প নেই। রাষ্ট্র, সমাজ সর্বস্তরে সুস্থতা ও স্বাভাবিকতা ধরে রাখতে হবে।
সুস্থ ধারাবাহিকতার জন্যই প্রয়োজন পেশাদারিত্বের। আর পেশাদারিত্ব থাকলে প্রশাসন দলীয়করণের দরকার হয় না। এখন সিভিল ও পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তারা সরাসরি দলীয় নেতার ভূমিকা নেন। তাদের পীড়িত করে। আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা তাঁদের রাজনীতি করবেন। আমলা ও পেশাজীবীরা তাঁদের দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করবেন। মাঠের আমলাদের দলীয় অনুষ্ঠানে যেতে হবে কেন? তাঁরা যাবেন সরকারি অনুষ্ঠানে। সরকারের সিদ্ধান্তগুলো দ্রুতগতিতে বাস্তবায়ন করবেন। ডিসি, এসপি, ইউএনও, ওসি স্থানীয় আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক হওয়ার প্রতিযোগিতা কেন করবেন?
আমলাদের নেতা হওয়ার দরকার নেই। সচিব সাহেবদের আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা সাজারও দরকার নেই। চিকিৎসা বাদ দিয়ে ডাক্তার সাহেবরা কেন মিছিলে যাবেন? পেশার কথা ভুলে গিয়ে সাংবাদিকদের কেন দলকানা হতে হবে? উন্নয়ন বাদ দিয়ে প্রকৌশলীরা কেন হবেন দলবাজ? পেশাজীবীরা নিজের দায়িত্বটুকু নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করলেই দেশ এগিয়ে যাবে। আর দেশ এগিয়ে গেলে সাফল্য বেলা শেষে সরকারের ঘরেই আসবে। সবার দলবাজ আর দলদাস হওয়ার দরকার নেই। বাপ-দাদা চৌদ্দপুরুষের কেউ আওয়ামী লীগ করে না। এখন কথায় কথায় জয় বাংলার স্লোগান। এত কান্ডকীর্তি না করে বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধুকে বুকে লালন করে কাজ করুন। বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে, এগিয়ে যাবে। সবকিছুতে স্বাভাবিকতা থাকতে দিন।
লেখক: সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৪৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০১৯