ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

সিদ্ধান্ত সাংঘর্ষিক

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৩৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ১০, ২০২০
সিদ্ধান্ত সাংঘর্ষিক

অপরাধ প্রতিকার এবং প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পুলিশ সাধারণত বিগত বছরে সংঘটিত অপরাধের ধরণ, অপরাধের মাত্রা, অপরাধের ভয়াবহতা, অপরাধের বৈচিত্রতা তথা অপরাধের গতি প্রকৃতি দেখে কৌশল ও পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকে যার পরিপ্রেক্ষিতে জনগণের জানমালের সুরক্ষা ও সামগ্রিক আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী ভূমিকা পালন করা সম্ভব হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ব্যবস্থা গ্রহণ করা সত্ত্বেও সময়ের ব্যবধানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেনইবা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, অপরাধের সংখ্যাও প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে কিংবা নিয়ন্ত্রণ করা দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে? প্রশ্নের সঠিক উত্তর হচ্ছে, পুলিশের কাছে অপরাধ এবং অপরাধীর সঠিক তথ্য লিপিবদ্ধ থাকে না। যার কারণে পুলিশ যে ধরনের প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে সেগুলো খুব বেশি কার্যকর না। 

অর্থাৎ ডার্ক ফিগার অব ক্রাইমের কারণে পুলিশের কাছে সঠিক তথ্য লিপিবদ্ধ না থাকায় অপরাধ প্রতিকার ও প্রতিরোধের ক্ষেত্রে পুলিশের গ্রহণীয় ব্যবস্থা খুব বেশি একটা আলোর মুখ দেখছে না। দেখে না বিধায় অপরাধ কিন্তু ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে এবং ভয়াবহ অপরাধের সংখ্যাও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে, সঙ্গে বাড়ছে হিংস্র অপরাধীর সংখ্যাও।

ডার্ক ফিগার অব ক্রাইম নানা কারণে হয়ে থাকে, যেমন: অপরাধীর ভয়ে ভিক্টিম থানায় মামলা দায়ের করা থেকে বিরত থাকেন, অনেক সময় পুলিশ নানাবিধ কারণে মামলা গ্রহণ করে না, স্থানীয়ভাবে ঘটনাগুলো মীমাংসা হয়ে থাকে, ভিক্টিমের অধিকার সুরক্ষায় রেস্টোরেটিভ জাস্টিস সিস্টেমের আওতায় ভিক্টিম-অপরাধী দুপক্ষের জন্যই ন্যায্য অধিকারের ভিত্তিতে বিচারের ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা, আবার বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে, এমন সব পরিস্থিতির কারণে দেখা যায়, বিশাল সংখ্যক অপরাধের ঘটনা থানায় নথিভুক্ত হতে পারে না। সুতরাং সরকার যখন অপরাধ দমন ও নিয়ন্ত্রণে কৌশল অবলম্বন করে থাকে, সেখানে নথিভুক্ত মামলার সংখ্যা বিবেচনায় নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য সুপারিশের পাশাপাশি জনসম্পৃক্তায়নের বিষয়েও উদ্যোগী ভূমিকা পালন করে থাকে। কাজেই, ডার্ক ফিগার অব ক্রাইমের কারণে সরকারের ব্যবস্থা গ্রহণ সত্ত্বেও অপরাধের সংখ্যা, মাত্রা ও এর ফলে ক্ষতির পরিমানও কমানো সম্ভব হচ্ছে না।  

করোনা নিয়ে আলোচনার পরবর্তী সময়ে আইইডিসিআরের সংবাদ ব্রিফিংয়ে সারাদেশে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা, সুস্থ হওয়া রোগীর সংখ্যা, মৃত রোগীর সংখ্যা, হোম কোয়ারেন্টানে অবস্থান নেওয়া মানুষের সংখ্যা, আইসোলেশনে রাখা রোগীর সংখ্যা ইত্যাদি নিয়ে সামগ্রিক তথ্য সরবরাহ করত। সংবাদ সম্মেলন নিয়ে অনেকেই নেতিবাচক মন্তব্য করত: নানা রকমের বেফাঁস মন্তব্য করতেও দ্বিধা করতো না, সেখানে পরিচালকের ড্রেসআপ নিয়েও নেতিবাচক মন্তব্য করতেও আমাদের দ্বিধা হয়নি। ঘটনা কিন্তু আসলেই সত্য, আইইডিসিআর প্রদত্ত রিপোর্ট সঠিক নয়, কেননা সারাদেশে রোগের উপসর্গে থাকা মানুষজনদের কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি প্রতিষ্ঠানটির। তাদের কাছে যাদের যাওয়ার সুযোগ হয়েছে শুধু তাদেরকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার পর ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি প্রদত্ত করোনা রোগের সার্বিক বিবৃতিতে অনেকটা ডার্ক ফিগার অব ক্রাইমের তুলনা চলে। কেননা সারাদেশের সব রোগীর তথ্য প্রতিষ্ঠানটির কাছে না থাকায় কিংবা অপ্রতুল ব্যবস্থাপনার কারণে তাদের প্রদানকৃত তথ্য উপাত্তে অসঙ্গতি থাকাটাই স্বাভাবিক এবং সেটি মেনে নিয়েই আমাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা অবশ্যম্ভাবী বলে মনে করি।  

এদিকে প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের ঝুঁকি নিয়ে তৈরি পোশাক শিল্প, নিটওয়্যার, টেক্সটাইলস মিলসহ সকল কারখানা চালু করেছে গার্মেন্টস মালিকরা। অনেকটা বাধ্য হয়েই শ্রমিকেরা পায়ে হেঁটে, রিকশায়, ভ্যান, অটো এবং মালবাহী ট্রাকে করে করোনার ভয়াবহতার মাঝেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কর্মস্থলে ফিরেছে। আমরা যেখানে সামাজিক দূরত্বের কথা বলে রাস্তায় সশস্ত্র বাহিনীকে নামিয়ে মানুষকে ঘরে থাকার জন্য বাধ্য করছি, ঠিক সেখানেই গার্মেন্টস শ্রমিকদের চাকরি চলে যাবে এমন ভয় দেখিয়ে কর্মস্থলে আনার চেষ্টা চলেছে। বিষয়টা করোনা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে রীতিমতো ভয়াবহ ও সাংঘর্ষিক। কেননা, করোনা ভাইরাস একটি ছোঁয়াচে রোগ বিধায় নিজে সুস্থ থাকলেই হবে না, আশে পাশের সকলকে বিশেষ করে পরিবার-পরিজনকে নিয়েই সুস্থ থাকার মানসিকতা বোপন করতে হবে। অন্যথায় করোনা ভাইরাস সকলের জন্য ভয়ঙ্কর হিসেবে আবির্ভূত হবে।  

বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। ৩৩তম দিনে করোনায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৪২৪ জন। যুক্তরাষ্ট্রে করোনা ভাইরাসের রোগী প্রথম শনাক্ত হয় ২০ জানুয়ারি, এরপরের ৫০ দিনে করোনা রোগীর সংখ্যা ১ হাজার ছড়ায়, পরের সপ্তাহে রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ হাজার, পরের ১২ দিনে রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৫ হাজার জনে। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ২৭ জন।  

শুক্রবার পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে রোগীর সংখ্যা ৪ লাখ ৬৮ হাজারের বেশি, স্পেনে ১ লাক ৫৭ হাজার, ইতালিতে ১ লাক ৪৩ হাজার। পরের অবস্থানগুলোয় আছে জার্মানী, ফ্রান্স, চীন ও ইরান। পরিসংখ্যান দেখে সহজেই অনুধাবন করা যায়, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সরকার ঘোষিত ছুটি অবশ্যই ফ্যাক্টরি মালিকদের অনুসরণ করা উচিত ছিল। কারখানা চালু রাখার সিদ্ধান্ত যে কতটা হটকারি তা কিছুদিন পরের পরিস্থিতি অবলোকনের আলোকে সবার কাছে পরিষ্কার হবে।  

আইইডিসিআরের একজন বিশেষজ্ঞ এরইমধ্যে বলেছেন, করোনার কমিউনিটি সংক্রমন ঠেকাতে অনেক চেষ্টা তারা করেছেন এবং সে ক্ষেত্রে তারা কিছুটা সফলও ছিলেন। কিন্তু গ্রাম থেকে শহরে ফেরত আসা মানুষগুলোর আগমনে ভয়ানক পরিণতি সামনে অপেক্ষা করছে। কেননা দল বেঁধে মানুষজনের আসা যাওয়া ও ফ্যাক্টরির অভ্যন্তরীণ পরিবেশ করোনা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে তেমন কোনো কাজে আসবে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মোটা দাগে বলে দিয়েছে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য। সেখানে গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা শ্রমিকদের কাজে যোগদানের কড়া নির্দেশনা বিষয়টাকে মারত্মক পরিণতির দিকে ধাবিত করেছে।  

সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও সাধারণ মানুষের বাড়ি ফেরার যে চিত্র দেখা গেছে, অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে মহামারি দেখা দিলে বিষয়টা খুব বেশি অবান্তর হবে না। কারণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রদত্ত স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিয়মাবলী আমরা কেউই তেমন পালন করছি না। সুতরাং করোনার মহামারির ব্যাপকতায় বাংলাদেশকে চরম মূল্য দিতে হবে। সাধারণ ছুটি এজন্যই ঘোষণা করা হয়েছে যে যেখানে আছেন সেখানেই অবস্থান করবেন অন্য কোথাও চলাফেরা করার দরকার নেই। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, রাস্তায় মানুষের ঢল নেমে গেছে এবং শহর থেকে গ্রামের দিকে মানুষের দীর্ঘ লাইন। আর সে কারণেই গ্রাম নিরাপদ থাকলেও শহর হতে ফেরত আসা মানুষদের কারণে গ্রামের মানুষের করোনায় সংক্রমণের হারও বেশি এবং বিভিন্ন জায়গায় গ্রামেই করোনা পজিটিভ রোগী পাওয়া যাচ্ছে।  

এহেন পরিস্থিতিতে গার্মেন্টস চালু রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ জাতির জন্য অত্যন্ত শোচনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে। যদিও পরে বিজিএমইএ সভাপতির আহ্বানে গার্মেন্টস বন্ধ রাখা হয়।  

সামগ্রিক অবস্থায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তরুণ প্রজন্ম ব্যবসায়ীদের সংগঠনের দিকে তীর নিক্ষেপ করে। অনেকেই ব্যবসায়ীদের রক্তচোষা এবং অবিবেচক হিসেবে আখ্যায়িত করতেও দ্বিধা করতেও ছাড়েননি। ব্যবসার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত মানুষের মঙ্গল সাধন, আর যেখানে জীবন বিকিয়ে দিয়ে শ্রমিকদের কাজে যেতে হয়, সে ব্যবসার মাধ্যমে আর যাই হোক জনকল্যাণ কখনো সাধিত হবে না। সরকারের সিদ্ধান্ত না মেনে যারা ফ্যাক্টরি খোলা রেখে রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য বাধাগ্রস্ত করেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে উদাহরণ সৃষ্টি করা জরুরি হয়ে পড়েছে।  

ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। এর পরে গার্মেন্টস কারখানা বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এ নাটকটা না করলে কী হতো? যেসব শ্রমিক চাকরি বাঁচাতে ঢাকায় চলে এসেছেন, তারা এখন কী করবেন? তারা যদি পুনরায় গ্রামের বাড়ি ফিরতে চান, তাহলে কী পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে সেটা ভাবলেই ভয়ে গা শিউরে ওঠে।  

প্রভাষক, অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।